মো. মঞ্জুর মোর্শেদ
মুন্সীগঞ্জ, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ২৪ সালের জুলাই - আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে দেশ উত্তাল। কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একদফা দাবিতে লাগাতার অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ লাগে মুন্সীগঞ্জে।
এমন একটি পরিস্থিতিতে গত বছর ৪ আগস্ট ভোরবেলা বৃষ্টিতে ভিজে কিছুসংখ্যক ছাত্রী গোপনে শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেওয়ালে গ্রাফিতি অঙ্কন করেন এবং কাচারী মোড়ে রাস্তার দেওয়ালে চিকা মারেন। এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা তাদের শাসায়। সকালে জেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রী এবং জনতা শহরের রাস্তায় নেমে আসেন।
সকাল থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ছাত্রী, জনতা কৃষি ব্যাংক চত্বর মানিকপুর রাস্তা এবং পিটিআই রাস্তায় অবস্থান নেয়। আওয়ামী লীগ যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা অবস্থান নেয় সুপার মার্কেট এলাকায়।
একপর্যায় ছাত্রলীগ যুবলীগ আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করলে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টাপাল্টি ধাওয়া শুরু হয়। ছাত্র-জনতার প্রতিরোধে ছাত্রলীগ যুবলীগ কর্মীরা পিছু হটলে আন্দোলনকারীরা সুপার মার্কেট এলাকায় জাতীয় শোক দিবসের তোড়ণে আগুন ধরিয়ে দেন। পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ চর এলাকা থেকে লোক এনে সুপার মার্কেট এলাকায় জড়ো করে । সশস্ত্র আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করলে ছাত্র-জনতার সঙ্গে পুলিশ ও ছাত্রলীগ যুবলীগ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ শুরু হয়। পুরা সুপার মার্কেট এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়।
আন্দোলনকারীরা কৃষি ব্যাংক, পিটিআই ও সদর হাসপাতাল সড়ক দখল করে রাখে। সকাল থেকে আন্দোলনকারীরা বিভিন্ন দিক থেকে সুপার মার্কেট এলাকা দখলের চেষ্টা করে। পুলিশ আন্দোলনকারীদের প্রতিহত করতে শত শত রাউন্ড টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট ছোড়ে। আওয়ামী নেতাকর্মীরা সুপার মার্কেটে জেলা বিএনপি কার্যালয় ভাঙচুর ও আসবাবপত্রে আগুন লাগিয়ে দেয়।
ছাত্র-জনতা আবারো একত্রিত হয়ে শহরের কৃষি ব্যাংক চত্বর মানিকপুর সড়ক দখলে নেয়। আওয়ামী লীগ যুবলীগ এবং ছাত্রলীগের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা অবস্থান নেয় সুপার মার্কেট চত্বরে। দীর্ঘক্ষণ চলে দুপক্ষের মধ্যে দাওয়া পাল্টাপাল্টি ধাওয়া। ছাত্র জনতার ধাওয়ায় সুপার মার্কেট থেকে একপর্যায় পিছু হটে আওয়ামী লীগের ক্যাডাররা। পরবর্তীতে পুলিশের সহায়তায় আওয়ামী লীগের সশস্ত্র ক্যাডাররা আবারো একত্রিত হয়ে আক্রমণ চালায় ছাত্র-জনতার ওপর। প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছাত্র-জনতা। একপর্যায় পিটিআই সড়কে গুলিবিদ্ধ হয় উত্তর ইসলামপুরের মতিন ফরাজীর ছেলে দিনমজুর রিয়াজুল ফরাজী (৩৫)। গুলিবিদ্ধ রিয়াজুলকে সদর হাসপাতালে ভর্তি করলে ডাক্তার রিয়াজুলকে মৃত ঘোষণা করেন।
পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ পুলিশ আর ছাত্র-জনতার ত্রিমুখী সংঘর্ষে পুরো শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। যখনই ছাত্র-জনতা সুপার মার্কেট চত্বরে দিকে আসতে থাকে তখনই সুপার মার্কেট এলাকায় পুলিশের দায়িত্বে থাকা তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার (সার্কেল) খায়রুল হাসানের নির্দেশে পুলিশ আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার উপর শত শত টিয়ার শেল এবং রাবার বুলেট ছোড়ে। একই সঙ্গে আওয়ামী সশস্ত্র ক্যাডাররা ছাত্র-জনতার উপর ঝাপিয়ে পরে এবং গুলি, ককটেল মারে।
কৃষি ব্যাংক চত্বরে থাকা আন্দোলনকারীরা ধাওয়া খেয়ে কেউ পিছু হটে কেউ পিটিআই সড়কের ভেতরে ঢুকে পড়লে পেছন থেকে আওয়ামী সশস্ত্র ক্যাডাররা গুলি করলে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয় সদর উপজেলার উত্তর ইসলামপুরের আলী আকবর মোল্লার ছেলে শ্রমিক মো. সজল মোল্লা (৩০)।
গুলি, টিয়ারশেল, ককটেল আর ইটপাটকেল নিক্ষেপে পুরো শহর রণক্ষেত্র ও দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়। পুলিশের ব্যাপক টিয়ারশেল আর আওয়ামী লীগের সশস্ত্র আক্রমণ তাদের দমাতে পারেনি। চলে দুপক্ষের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। আওয়ামী সন্ত্রাসীরা পিটিআই রাস্তার মধ্যে পিটিয়ে হত্যা করে উত্তর ইসলামপুরের সিরাজ সর্দারের ছেলে নুর মোহাম্মদ ওরফে ডিপজল সরদারকে (১৯)।
শহীদ মো. সজল মোল্লার (৩০) ছোটভাই সাইফুল ইসলাম বাসসকে জানান, সকাল সাড়ে ৯ টায় দুই ভাই মিলে ভাত খেতে ছিলাম। বাড়ির পাশেই প্রধান সড়কে চলছিল ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ।সজল অর্ধেক খেয়ে উঠে যায় আর বলে এবার স্বৈরাচার হাসিনাকে খেদাবো না হয় শহীদ হবো। দুই ভাই প্রধান সড়কে চলে আসি। আমরা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটে। পরে পুলিশের সহায়তায় আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। আমরা পিটিআই রাস্তায় চলে আসি। ওরা আমাদের ওপর গুলি করতে থাকে। গুলিবিদ্ধ বড়ভাই সজলকে ঢাকায় নেবার পথে সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুরায় গেলে গাড়িতেই সজলের মৃত্যু হয়।
রিয়াজুল ফরাজির স্ত্রী রুমা বেগম বলেন, এলাকাবাসী থেকে গুলিবিদ্ধের খবর পেয়ে হাসপাতালের মর্গে গিয়ে দেখি স্বামীর লাশ পরে আছে। সারা দিন থানা-পুলিশ দৌড়াদৌড়ি করেও হাসপাতাল থেকে স্বামীর লাশ আনতে পারিনি। বাবার মুখ সন্তানকে দেখাতে লাশের জন্য অনেক কান্নাকাটি করেছি লাশ আনতে দেয়নি। মেয়ে দুটিও বাবার লাশ দেখতে হাসপাতালে আসতে পারছে না। সারা দিনরাত লাশের জন্য হাসপাতালে অপেক্ষা করি। পরদিন শেখ হাসিনার পতন না হলে ওরা লাশ গুম করে ফেলতো। সন্তান দুটি বাবার মুখও দেখতে পারতো না।
সরকারি হরগংগা কলেজের ছাত্র নোমান আল মাহমুদ বলেন, ‘সকাল ৭টা থেকে শহরের রাস্তায় নেমে আসি।সকাল ৯টায় গোল চত্বরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা শান্তিপূর্ণ অবস্থান করছিলাম। সশস্ত্র ছাত্রলীগ ক্যাডাররা আমাদের ওপর হামলা করে। ছাত্রদের মারধর করে ছাত্রীদের হেনস্তা করে।
আমাদের ওপর হামলা করলে আমরা কৃষি ব্যাংক চত্বর এলাকায় চলে যাই। সবচেয়ে বেশি সাহস জুগিয়েছে ছোট বড় বোনেরা। তাদের প্রতিবাদী মনোভাব শক্তি যুগিয়েছে। সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের গুলি আর ককটেলের সঙ্গে খালি হাতে শুধু নৈতিক মনোবল দিয়ে মোকাবেলা করেছি।’