দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম দিনেই রক্তাক্ত সংঘর্ষে কুমিল্লা পরিণত হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের সাথে দফায় দফায় সংঘর্ষ, গুলি, লাঠিচার্জ এবং অগ্নিসংযোগে গোটা জেলা দিনভর উত্তপ্ত থাকে। দাউদকান্দি, ইলিয়টগঞ্জ, আলেখারচর ও দেবিদ্বারসহ বিভিন্ন এলাকায় সংঘর্ষে এক পুলিশ সদস্যসহ অন্তত তিনজন নিহত হন এবং সাংবাদিকসহ শতাধিক মানুষ আহত হন।
৪ আগস্ট সকাল থেকেই জেলার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট মিছিল নিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের বিভিন্ন পয়েন্টে অবস্থান নেয়। সকাল ৯টার দিকে ইলিয়টগঞ্জ হাইওয়ে ফাঁড়িতে হামলা চালিয়ে বিক্ষোভকারীরা আগুন ধরিয়ে দেয় এবং পুলিশের গাড়ি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় অন্তত সাতটি যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। দাউদকান্দিতে পুলিশ ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষে শহিদনগর এলাকায় অন্তত ২৫ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এসময় পুলিশের কনস্টেবল এরশাদ (৩২) নিহত হন।
একই সময় দেবিদ্বারের বানিয়াপাড়া এলাকায় আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কর্মীরা বিক্ষোভকারীদের উপর হামলা চালায়। এতে গুলিবিদ্ধ হয়ে আবদুর রাজ্জাক রুবেল (৩৩) নামে এক ভ্যানচালক নিহত হন। বিক্ষুব্ধ জনতা ওইদিন দেবিদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) বাসভবন, উপজেলা পরিষদের হলরুম ও পৌর পাঠাগারে ব্যাপক ভাঙচুর করে।
দুপুর ১২টার দিকে কোটবাড়ি বিশ্বরোড এলাকায় আন্দোলনকারীরা অবস্থান নিতে গেলে আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের বাধার মুখে পড়েন। আলেখারচর এলাকায় শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আন্দোলনকারীরা মহাসড়কে অবস্থান নেয়। তবে আওয়ামী লীগের কর্মীদের ধাওয়া ও পুলিশের লাঠিচার্জে তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেখানে মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দেয়ার ঘটনাও ঘটে।
আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক প্রকৌশলী মো. রাশেদুল হাসান বাসসকে বলেন, ‘৪ আগস্ট সকাল থেকেই আমরা কোটবাড়ি বিশ্বরোডে যাওয়ার চেষ্টা করি, কিন্তু প্রতিটি মোড়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে অবরোধ করে রেখেছিল। আলেখারচর থেকে আসা বিশাল মিছিল আমাদের সাহস জুগিয়েছিল। কিন্তু গুলির মুখে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই।’
একই দিন বিকেলে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আন্দোলনকারীদের সঙ্গেই আহত অবস্থায় ভর্তি করা হয় মাছুম মিয়া নামে এক যুবককে। মাথা ও পায়ে কোপের গভীর আঘাতে রাত সাড়ে তিনটার দিকে তার মৃত্যু হয়। দিনভর সংঘর্ষে জেলার বিভিন্ন স্থানে আহত হন সাংবাদিকসহ অন্তত ১০০ জন।
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, এদিন আন্দোলনে আহত ৫০ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কুমিল্লা মহানগর শাখার সাবেক আহ্বায়ক আবু রায়হান বলেন, ‘৪ আগস্ট ছিল আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। ৩ আগস্ট রাতে পুলিশ লাইনে ছাত্র-ছাত্রীদের উপর বর্বর হামলার দৃশ্য সারারাত আমাকে জাগিয়ে রেখেছিল। তখনই নিশ্চিত হই, স্বৈরাচারী হাসিনার পতন না হলে আমাদের কারো রক্ষা নেই।’
তিনি বলেন, ‘৪ আগস্ট বিশ্বরোড অবরোধের দায়িত্বে ছিলাম। কিন্তু কোনোভাবেই বিশ্বরোডে উঠতে পারছিলাম না। প্রতিটি মোড়ে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে ছিল। পরে বাতাবাড়িয়া রোডে কয়েকশ ছাত্র-জনতার সাথে মিছিল করে বিশ্বরোডের দখল নিই। পদুয়ার বাজার থেকে আরেকটি মিছিল যুক্ত হয়। কিন্তু ছাত্রলীগের অস্ত্রধারীরা আমাদের উপর হামলা চালায়। গুলিবিদ্ধ ভাইদের হাসপাতালে পাঠাতে গিয়ে আমিও স্প্রিন্টারের আঘাতে আহত হই।’
রায়হান বলেন, ‘পায়ে আঘাত পেয়েও বাইকে চড়ে আলেখারচর বিশ্বরোডে গিয়ে এক দফার ঘোষণা দেই-ছাড়তে হবে ক্ষমতা, ঢাকা আসছে জনতা। আমরা জানতাম না শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবে, কিন্তু আমাদের চোখে ছিল মুক্তির স্বপ্ন। দুই হাজার শহীদের রক্ত, ত্রিশ হাজার আহতের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি স্বাধীনতা।’
৪ আগস্ট আন্দোলনে সরাসরি নেতৃত্ব দেওয়া কুমিল্লা মহানগর বিএনপির সভাপতি উদবাতুল বারী আবু বাসসকে বলেন, ‘৩ আগস্ট শিক্ষার্থীদের উপর বর্বরোচিত হামলার পর সারা দেশে তোলপাড় শুরু হয়। কেন্দ্র থেকে আমাদের নির্দেশনা আসে ৪ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনে দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে যুক্ত হতে। সারারাত নেতাকর্মীদের সংগঠিত করি এবং ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের সাথে পরিকল্পনা করি।’
তিনি বলেন, পরিকল্পনা অনুযায়ী জেলা বিএনপির সদস্য সচিব ওয়াসিম ভাইসহ আমরা নাজিরা বাজারে অবস্থান নেই। খবর পাই আলেখারচরে শিক্ষার্থীদের উপর আওয়ামী-যুবলীগ হামলা করছে। মিছিল নিয়ে সেখানে গেলে আমাদের উপর গুলি বর্ষণ করা হয়। পরে ক্যান্টনমেন্ট ফটকে গিয়ে অবস্থান নেই। সেখানেও গুলি শুরু হলে সেনাবাহিনীর ট্যাংক বহর আমাদের সামনে নিয়ে এগিয়ে যায়।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ফের গুলি করলে দেশপ্রেমিক সেনারা পাল্টা ফাঁকা গুলি ছুঁড়ে তাদের হটিয়ে দেয়। এরপর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক পুরোপুরি আমাদের দখলে চলে আসে। ৫ আগস্ট বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও ৪ আগস্ট কুমিল্লায় আমরা বিজয়ী হয়েছিলাম।’
২০২৪ সালের আন্দোলনে কুমিল্লার শহীদদের স্মরণে এবছর নির্মিত হচ্ছে ‘জুলাই স্মৃতিস্তম্ভ’। কুমিল্লা সদর উপজেলার আলেখারচর বিশ্বরোড এলাকায় ১৪ জুলাই এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার।
জেলা প্রশাসক মো. আমিরুল কায়ছার বলেন, ‘২০২৪ সালের ৪ আগস্ট এই স্থানেই ছাত্র-জনতার উপর নির্মম হামলা চালানো হয়েছিল। শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এখানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মিত হচ্ছে। যেখানে প্রত্যেক শহীদের নাম লেখা থাকবে।’
তিনি জানান, প্রতি বছর ৫ আগস্ট স্মৃতিস্তম্ভ চত্বরে পুষ্পস্তবক অর্পণ ও বিশেষ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে। এছাড়াও যেসব স্থানে শহীদরা নিহত হয়েছেন সেখানে ‘রোড মেমোরি স্ট্যান্ড’ স্থাপন করা হবে।
কুমিল্লায় ৪ আগস্টের ঘটনাবহুল দিনটি আজও কুমিল্লার মানুষের কাছে স্মরণীয় হয়ে আছে এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হিসেবে। শহীদদের স্মরণে নির্মিতব্য স্মৃতিস্তম্ভ নতুন প্রজন্মের কাছে আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস তুলে ধরবে বলে মনে করেন কুমিল্লার বিশিষ্টজনেরা।