দিনাজপুরের চিরিরবন্দরে গড়ে উঠেছে শতাধিক চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা

বাসস
প্রকাশ: ২৭ আগস্ট ২০২৫, ১৩:৫১
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলায় গড়ে উঠেছে চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। ছবি: বাসস

// রোস্তম আলী মন্ডল //

দিনাজপুর, ২৭ আগস্ট,  ২০২৫ (বাসস) : জেলার চিরিরবন্দর উপজেলায় নিজ উদ্যোগে গড়ে উঠেছে চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা। এসব কারখানার প্রায় ১০ হাজার নারী-পুরুষ শ্রমিকের কাজ করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন ।

গতকাল মঙ্গলবার সরেজমিন অনুসন্ধান করে জানা যায়, চিরিরবন্দর উপজেলার রানীবন্দর বাজার এলাকায় প্রায় শতাধিক চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় কাজ করা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নারী শ্রমিকেরা দিন হাজিরার ভিত্তিতে গুটি চুল বাছাই এবং পরিষ্কারের কাজ করে থাকেন। এতে তারা  দিন হাজিরা পেয়ে থাকেন ১৫০ টাকা। সেই হিসেবে একজন নারী শ্রমিক মাসে এ কাজ করে আয় করেন সাড়ে ৪ হাজার টাকা। তবে একজন দক্ষ শ্রমিকের বেতন ১৫ হাজার টাকা থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত রয়েছে ।

নারী শ্রমিকেরা বলেন, বর্তমান বাজার মূল্য অনুযায়ী এই মজুরি দিয়ে তাদের জীবন চলছে। তারা সংসারের অভাব দূর করতে কাজ করেছেন  ।

এই কাজে অভিজ্ঞ নারী শ্রমিক মনোয়ারা বেগম জানান , এই গুটি চুল প্রথমে নারী  শ্রমিকের মাধ্যমে গুটি ছাড়িয়ে আলাদা করে প্রাথমিক ভাবে পরিষ্কার এবং বাছাই কাজ করা হয়। এরপর এই বাছাই করা চুল গুলো ডিটারজেন্ট পাউডার ও শ্যাম্পু দিয়ে পানিতে ভিজিয়ে রেখে পরিষ্কার করা হয়। দ্বিতীয় বারের মতো পরিষ্কার করা এই চুল কারখানার ভিতরে নিয়ে কাটিং মেশিনের মাধ্যমে কাচি করা হয়। কাচি করা চুল গুলোকে একই সাথে রাবার দিয়ে ছোট ছোট গোছায় বেঁধে আলাদা করা হয়। কারখানায় এই ছোট গোছা করা চুল গুলোকে বলা হয় লাচি।

এবার এই লাচি করা চুল পুনরায় শ্যাম্পু ও কন্ডিশনার ব্যবহার করে, ধুয়ে বাতাসে শুকানো হয়। শুকিয়ে চুল যখন উজ্জ্বল হয়, তখন এ গুলোকে শেষ বারের মত কাটিং মেশিনে নেওয়া হয়, ফিতা দিয়ে মেপে গ্রেডিং করে রেমি তৈরির জন্য। এই রেমি করা চুল কারখানা থেকে বিক্রির জন্য প্রস্তুত করা হয়। এরপর কারখানার মালিক নিজেরা ঢাকায় গিয়ে চুল বিক্রি করেন । রেমি প্রক্রিয়াজাতকরণ চুলের দৈর্ঘ্যের উপরই এর মূল্য নির্ভর করে। চুল যত লম্বা হবে বাজার মূল্য তত বেশি হবে। চুলের এ দৈর্ঘ্যের উপর ভিত্তি করে এর বাজার মূল্য সর্বনিম্ন ৬ ইঞ্চি চুল এক হাজার ২০০ টাকা থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ ২২ থেকে ৩২ ইঞ্চি সাইজের চুল প্রতি কেজি ৬০ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে। ২২ ইঞ্চি থেকে ৩২ ইঞ্চি লম্বা চুলকে সর্বোচ্চ গ্রেডের চুল বলা হয়।

রানীর বন্দর বাজারে কারখানার মালিক মো. রবিউল ইসলাম জানান , তার  নিজ উদ্যোগে গড়ে তোলা এ চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানাসহ এই এলাকায় গড়ে ওঠা শতাধিক কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায়   প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার নারী ও পুরুষ শ্রমিক প্রতি দিন কাজ করেছেন। এসব শ্রমিকদের সম্ভাবনার নতুন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে চীনসহ কিছু দেশ বাংলাদেশে এসে এই খাতে বিনিয়োগ করছেন। ফলে ছোট খাত হলেও, সেটি ধীরে ধীরে দেশের  অর্থনৈতিক উন্নয়নে সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে।

নারী শ্রমিক সাজেদা খাতুন  বলেন, আমাদের এলাকায় এখন অনেক চুলের কারখানা গড়ে উঠেছে। আমরা গরীব মানুষ দিন আনি দিন খাই। বাসায় বসে না থেকে এখানে চুলের কাজ করি। সারাদিন কাজ করে ১৫০ টাকা পাই। মাসে ৩০ দিন কাজ করলে সাড়ে হাজার টাকা পাচ্ছি। বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম বেশি কিন্তু আমাদের মত নারী শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

আরেক নারী শ্রমিক রাশেদা  বানু  বলেন, আমরা চুলের কাজ করি। এই চুলগুলো জটলা লেগে থাকে, সে গুলো আমরা কাটা দিয়ে আস্তে আস্তে খুলি।

তিনি বলেন, প্রতিদিন সকাল বেলা বাড়ির কাজ করে সকাল ৮ টায় কারখানা আসি। আবার নাস্তার জন্য সকাল ১০টায় ৩০মিনিট ছুটি পাই। নাস্তা খেয়ে আমারা কাজ শুরু করি। দুপুর হলে খাবারের জন্য আবার ১ ঘণ্টা সময় পাই। এর পরে বিকাল ৫টায় ছুটি দেয়। আমরা দিনে ১৫০ টাকা মজুরি পাই। এই টাকা দিয়ে সংসার চালাই।

চুলের কারিগর মো. সাহেব আলী বলেন, আমি নরসিংদী থেকে এখানে কাজ করতে আসছি। প্রতি মাসে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করতে পারি।

চুলের কারখানার মালিক জাহিদুর রহমান বলেন, আমি বেকার ছিলাম। গ্রামে ফেরি করে সংসার চালাতাম। তখন চুল সংগ্রহ করে সৈয়দপুর বেহারিদের কাছে বিক্রি করতাম। তাদের কাছ থেকে সব কিছু শিখে আমি শুরু করেছি চুলের কাজ। আমার কারখানায় ৫২ জন শ্রমিক কাজ করেন। এই চুল কারখানায় চুলের সংকট হয়, ঠিক মত চুল পাওয়া যায় না। শ্রমিকদের অল্প মজুরি দিয়ে কাজ করার পরে আমাদের পোষায় না। সরকার যদি আমাদের অন্য  দেশ থেকে চুল আমদানি করতে দিতো। তাহলে আমাদের মত ছোট চুল ব্যবসায়ীরা লাভবান হতাম।

অপর এক কারখানার মালিক সহিদুল  ইসলাম  বলেন, ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে মেয়েদের মাথার কাটা চুল সংগ্রহ করে ঢাকায় বিক্রি করি। তারা সে গুলো বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে। আমরা ফেরিওয়ালাদের কাছ থেকে এক কেজি চুল ৯ হাজার থেকে সাড়ে ১০ হাজার টাকা দিয়ে কিনি। ওই চুল কারখানার নারী শ্রমিকদের দিয়ে প্রক্রিয়াজাতকরণ করি। সেই চুল ছোট বড় সাইজ অনুযায়ী ৬ হাজার থেকে শুরু করে ৬০ হাজার টাকা পর্যন্ত এক কেজি চুল বিক্রি করে থাকি। এর পরও আমাদের লাভ হয় । কারখানায় ৩০ থেকে ৪০ জন শ্রমিক কাজ করে, তাদের মজুরি ১৫০ টাকা করে প্রতিদিন দিতে হয়। আবার চুলের কারিগররা মাসে ২০ থেকে ২৫ হাজার টাকা মজুরি পেয়ে থাকে।

নারী উদ্যোক্তা ও চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান রোকেয়া বেগম বলেন, আমাদের উপজেলায় শাতাধিকের বেশি চুল প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানা রয়েছে।এসব কারখানায় প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার নারী শ্রমিক চুলের কাজ করেন। তাদের মজুরি প্রতিদিন ১৫০ টাকা করে দেয়া হয়। এর আগে ১২০ টাকা করে মজুরি দেয়া হতো। আমি নিজে কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে গত জুন মাস থেকে ১৫০ টাকা করে মজুরি ব্যবস্থা করেছি। কারখানা গুলোতে চুল প্রক্রিয়াজাত কাজ করে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে লাভবান হচ্ছেন। কিন্তু নারী শ্রমিকরা সারা দিন কাজ করে কোনো রকম চলছে। আমি নারী শ্রমিকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার ব্যবস্থা করতে কারখানার মালিকদের বলেছি। নারী শ্রমিকদের পর্যায়ক্রমে মজুরি বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।

চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, আমি সদ্য এই উপজেলায় নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে যোগদান করেছি। জেনেছি এই উপজেলায় প্রায় শতাধিক চুল বাছাইয়ের কারখানা গড়ে উঠেছে। এসব কারখানায় অধিকাংশ নারী শ্রমিক কাজ করেন। তাদের ন্যায্য অধিকার যাতে প্রতিষ্ঠিত হয়, সে বিষয়টি আমি কারখানা মালিকদের সঙ্গে কথা বলে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
রাজধানীর জোয়ার সাহারায় মসজিদ ও মন্দিরের জন্যে রেলের জমি বরাদ্দ 
সাতকানিয়ায় ৮০ হাজার পিস ইয়াবাসহ ২ মাদককারবারী গ্রেপ্তার  
হত্যাচেষ্টা মামলায় ডাকসুর ভিপি প্রার্থী জালাল কারাগারে
ডিসেম্বরে শেষ হবে পারকি পর্যটন কমপ্লেক্সের কাজ : পর্যটন উপদেষ্টা 
চুয়াডাঙ্গায় অটোমেটেড ভূমি সেবা বিষয়ক কর্মশালা
রাজবাড়ীতে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ পালিত
চট্টগ্রামে পৃথক অভিযানে গণধর্ষণ মামলার ২ পলাতক আসামি গ্রেফতার
পিরোজপুরে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে ঢেউটিন ও চেক বিতরণ
চন্দ্রনাথ পাহাড় ঘিরে উসকানিমূলক কার্যক্রমের চিহ্ন দেখামাত্র ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ তিন উপদেষ্টার
দুদক-এর এনফোর্সমেন্ট ইউনিটের ৩ অভিযানে অনিয়ম ও দুর্নীতির প্রমাণ
১০