দিনাজপুর, ৯ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : চীনের পিকিং অথবা পেকিন জাতের হাঁস পালন করে স্বাবলম্বী হয়েছেন জেলার কয়েকটি উপজেলার গ্রামীণ নারীরা। সংসারের গৃহস্থালি কাজের পাশাপাশি পেকিন হাঁস পালন করে ঘরে বসেই লাখ টাকা আয় করছেন গৃহবধূরা।
চিরিরবন্দর উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা সাইদুর রহমানের স্ত্রী আসমা বেগম (৩২) বাসসকে বলেন, গত বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১৪ তারিখে পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) এর সহায়তায় স্বল্প মূল্যে চীনের উন্নত জাতের পেকিন হাঁসের ৩০ টি বাচ্চা নিয়েছিলাম। নিজ বাড়িতে টিনের ঘরে জাল দিয়ে ঘের তৈরি করে হাঁসের বাচ্চাগুলো লালন পালন করেছি। বাচ্চাগুলোর নিয়মিত খাবার, পানি, আলো ও অক্সিজেন পাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। এছাড়াও দিনের বেলা মাঠের ঘাস খাওয়ানো ও পুকুরে সাঁতরানোর ব্যবস্থা করেছি। হাঁসের প্রতিদিনের খাবারের মধ্যে রয়েছে খুদের ভাত, গুড়া, ভুসি ও পানি। এগুলো এক সাথে মিশিয়ে খাওয়ানো হয়।
তিনি জানান, হাঁসের বাচ্চা নেয়ার দু'মাসের মধ্যে প্রতিটি বাচ্চা ৩ থেকে সাড়ে ৩ কেজি ওজনের স্বাভাবিক হাঁসের মতো উপযুক্ত হয়। খাওয়ার উপযুক্ত হলে প্রত্যেকটি হাঁস ১২০০ টাকা দরে পাইকারদের কাছে বিক্রি করা যায়।
আসমা বেগম প্রথমবার পিকেএসএফ-এর কাছ থেকে পাওয়া ৩০টি পেকিন হাঁসের মধ্যে ২৮ টি হাঁস প্রত্যেকটি ১২০০ টাকা দরে ৩৩ হাজার ৬’শ টাকায় বিক্রি করেন।
আসমা বেগম আরো জানান, গত বছর ১৪ সেপ্টেম্বর থেকে এবছর ৩১ মার্চ পর্যন্ত তিনি ৩ দফায় ৯০টি হাঁসের বাচ্চা লালন-পালন করেন। এর মধ্যে দুই বারে ৫৬টি হাঁস পাইকারদের কাছে প্রতিটি ১২০০ টাকা দরে বিক্রি করেন। যার মোট দাম ৬৭ হাজার ২শ’ টাকা। তৃতীয় ধাপের ৩০ টি হাঁস এপ্রিলের দুই তারিখে ১৩০০ টাকা করে বিক্রি করে ৩৯ হাজার টাকা আয় করেন। এসময় ঈদুল ফিতর থাকায় হাঁস প্রতি ১০০ টাকা বেশি দাম পাওয়া গিয়েছে।
চতুর্থ ধাপে তিনি আরো ৩৫ টি পেকিন হাঁসের বাচ্চার অর্ডার দিয়েছেন। ১০ এপ্রিল হাঁসের বাচ্চাগুলো হাতে পাবেন বলে তিনি আশা করছেন। এনজিও থেকে প্রতিটি হাঁসের বাচ্চা ৩৫ টাকা মূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
তিনি বলেন, দেশি একটি হাঁসের এক কেজির বেশি মাংস পাওয়া যায় না। এর মধ্যে মাংসের চেয়ে হাড় বেশি থাকে। চীনের পেকিন হাঁসের মাংস, একটি দেশি হাঁসের মাংসের ৩ গুণের বেশি হয়। ফলে হোটেল ব্যবসায়ীদের কাছেও পেকিন হাঁসের চাহিদা বাড়তে শুরু করেছে। এই জাতীয় হাঁসের মাংস পরিমাণে বেশি হয় এবং খেতে খুবই সুস্বাদু।
পিকেএসএফের কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, গ্রামীণ নারীদের স্বাবলম্বী করতে পিকেএসএফ এই উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে দিনাজপুরে পেকিন জাতের হাঁস পালন করে সফলতা অর্জন করেছেন ২৫ জন গ্রামীণ নারী।
জানা যায়, পেকিন হাঁস পালনে কোন বাড়তি ঝামেলা নেই। রোগ-বালাইও কম। এই হাঁসের মাংস অধিক সুস্বাদু ও পুষ্টি গুণসম্পন্ন। পিকেএসএফের সহযোগিতায় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা মহিলা বহুমুখী শিক্ষা কেন্দ্র (এমবিএসকে) দিনাজপুর জেলার কয়েকটি উপজেলায় ২৫ জন গৃহবধূকে হাঁস পালনের এই কর্মসূচিতে সম্পৃক্ত করেছে। এই কর্মসূচির আওতায় দিনাজপুর সদর, আস্করপুর ও বিরল উপজেলার বিশ্বনাথপুর ও চিরিরবন্দর উপজেলার তেঁতুলিয়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে এখন ‘মাংসের জন্য ব্রয়লার টাইপ পেকিন জাতের হাঁস পালন’ এর হিড়িক পড়েছে।
এমবিএসকের সদস্য লাবণ্য রানি , প্রতিমা রায়, বুলবুলি, মর্জিনা, সোহেলী, ময়ূরী, শর্মিলা দাস, সালেহা বেগম, আসমা বেগম, মর্জিনা খাতুনসহ ২৫ জন নারী পেকিন হাঁস পালন করে সফলতা অর্জন করেছেন। বিশ্বের জনপ্রিয় ব্রয়লার টাইপ চীনের সৃষ্টি এই জাতের পেকিন হাঁস ৬০ থেকে ৬২ দিনের মধ্যে ৩ থেকে সাড়ে ৩ কেজি ওজন হয়। এই জাতীয় হাঁস খেতে খুবই সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হওয়ায় বাজারে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
পেকিন জাতের হাঁস পালনে বাড়তি ঝামেলা নেই। রোগ-বালাইও কম। তাই এই হাঁসের মৃত্যুর হারও কম। এতে দরিদ্র খামারিরা অল্প খরচে ও কম পরিশ্রমে আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। প্রথম পর্যায়ে বিনামূল্যে এবং পরে স্বল্পমূল্যে হাঁসের বাচ্চা ও খাদ্য পেয়ে খুশি সুবিধাভোগী পরিবারগুলো।
জানা যায়, এমবিএসকে অত্যাধুনিক মেশিনের মাধ্যমে এই হাঁসের ডিম থেকে বাচ্চা ফুটিয়ে গ্রামীণ নারীদের সরবরাহ করে। পাশাপাশি হাঁস পালনে সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে থাকে। নারীদের স্বাবলম্বী করতে তাদের এই উদ্যোগ এলাকায় সাড়া ফেলেছে।
দিনাজপুর জেলা প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ডা. মো. আব্দুর রহিম বলেন, চীনের সৃষ্ট উন্নত জাতের পেকিন হাঁস পালন করে গ্রামীণ নারীরা সফলতা অর্জন করেছেন। বিষয়টি নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটি মাইল-ফলক হিসেবে কাজ করছে। গ্রামীণ নারীদের এ ধরনের উন্নত জাতের হাঁস-মুরগি পালনে প্রাণী সম্পদ বিভাগ সব ধরনের পরামর্শ ও সহযোগিতা দিতে প্রস্তত।