\ জীতেন বড়ুয়া \
খাগড়াছড়ি, সেপ্টেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলার প্রতিমা তৈরির কারিগররা। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। উৎসবকে ঘিরে খাগড়াছড়িতে ৬৪ টি মণ্ডপে চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। শিল্পীদের হাতের ছোঁয়ায় অপরূপ হয়ে উঠছে মাটির প্রতিমা। একইসাথে দুর্গোৎসবকে পরিপূর্ণ করতে দিনরাত মন্দিরগুলোতে চলছে ব্যাপক প্রস্তুতি। প্রতিমা তৈরির পর এখন মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে রং তুলির আঁচড়ে প্রতিমার সৌন্দর্য বৃদ্ধি। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে ভক্তদের মধ্যে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ।
উৎসবকে নিরাপদ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও তিন স্তরের নিরাপত্তা বলয় তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে । আয়োজক পূজা সংগঠনের নেতৃবৃন্দ নির্ভয়ে পূজা উদযাপনের জন্য সবাইকে সংঘবদ্ধ থাকার আহ্বান জানিয়েছেন।
খাগড়াছড়ি পূজা উদযাপন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, আগামী ২৮ সেপ্টেম্বর মহাষষ্ঠীর মধ্যে দিয়ে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পঞ্জিকা অনুযায়ী আগামী ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্যে দিয়ে দেবী পক্ষের সূচনা হবে। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর দেবীর বোধন ও মহাপঞ্চমী এবং ২৮ সেপ্টেম্বর ষষ্ঠী পূজার মধ্যে দিয়ে মূল আনুষ্ঠানিকতা শুরু হবে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর মহাসপ্তমী এবং ৩০ সেপ্টেম্বর মহা অষ্টমী অনুষ্ঠিত হবে। ১ অক্টোবর মহানবমী এবং ২ অক্টোবর বিসর্জনের মধ্যে দিয়ে শারদীয় দুর্গোৎসবের পরিসমাপ্তি ঘটবে। ধর্মীয় বিশ্বাস অনুযায়ী, এ বছর দুর্গাদেবী গজে বা হাতির পিঠে চড়ে মর্ত্যে আগমন করবেন। আর দোলা বা পালকিতে চড়ে ফিরে যাবেন।
জেলা প্রশাসন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, জেলায় মোট ৬৪ টি পূজামণ্ডপে অনুষ্ঠিত হবে শারদীয় দুর্গোৎসব। এর মধ্যে খাগড়াছড়ি সদর উপজেলায় ২১ টি, মহালছড়িতে ২ টি, পানছড়িতে ১০টি, দীঘিনালায় ৯টি, মাটিরাংগায় ৯টি, গুইমারায় ৫টি, রামগড়ে ২টি, মানিকছড়িতে ৪টি এবং লক্ষ্মিছড়িতে ১টি পূজামণ্ডপে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হবে। জেলা প্রশাসন এবং পুলিশ বিভাগের পক্ষ থেকে পূজা উদ্যাপন পরিষদের নেতা, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে দুর্গাপূজা উদযাপন উপলক্ষে প্রস্তুতিমূলক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে মতবিনিময়, পূজা উদযাপন কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে একের পর এক সভা করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। এর পাশাপাশি বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রেখে খোঁজ খবর নিচ্ছেন। অন্যদিকে খাগড়াছড়ি পুলিশ প্রশাসন পূজার সার্বিক আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে জেলার পূজা উদযাপন কমিটি ও বিভিন্ন মসজিদের ইমামদের সাথে বৈঠক করেছেন ।
খাগড়াছড়ি জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি অশোক কুমার মজুমদার বাসসকে বলেন, জেলায় শান্তিপূর্ণভাবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা নিরাপদ ও নির্বিঘ্ন করতে ব্যাপক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হচ্ছে। এদিকে শারদীয় দুর্গোৎসবে শান্তি-শৃঙ্খলা ও উৎসবের আমেজ বজায় রাখতে সেনাবাহিনীও মাঠে রয়েছে। পূজা চলাকালে গুজব রটনাকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও সজাগ রয়েছে। তিনি শঙ্কাহীন উৎসব উদযাপনের আশা ব্যক্ত করেন।
তিনি জানান, উৎসবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত স্বেচ্ছাসেবক অনুষ্ঠানস্থলে সেবা দেবেন। পূজামণ্ডপগুলোতে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গত বছর দেশে পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে খাগড়াছড়িতে জাঁকজমকে কিছুটা কমতি থাকলেও এবার তার পরিপূর্ণতা পাবে বলে আশাবাদী পূজা উদ্যাপন পরিষদ।
পূজা ্উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক তমাল তরুণ দাশ বাসসকে বলেন, শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনের লক্ষ্যে আমাদের সব প্রস্তুতি শেষের দিকে। জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে আসন্ন দুর্গাপূজা নিয়ে জেলা প্রশাসক ও জেলা পুলিশের সাথে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রশাসনের পাশাপাশি প্রতিটি পূজামণ্ডপে আমাদেরও স্বেচ্ছাসেবক কর্মী দায়িত্ব পালন করবে।
তিনি জানান, গতবছরের চেয়ে এ বছর খাগড়াছড়িতে পূজামণ্ডপের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি মণ্ডপের জন্য ৫০০ কেজি করে চাল বরাদ্দ পেয়েছি। এ ছাড়া খাগড়াছড়ি পৌরসভার পক্ষ থেকে ৬৪ টি মণ্ডপের জন্য ৫ হাজার টাকা ও হিন্দু কল্যাণ ট্রাস্ট এর পক্ষ থেকে ৩ হাজার টাকা করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রাম মন্ত্রণালয় পূজা উপলক্ষে ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দিয়েছে ।
ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাইকে উৎসবে শামিল হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আশা করছি কোনোরকম অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই পূজা উদ্যাপন করতে পারবো। এবারের পূজা উপলক্ষে অন্তবর্তীকালীন সরকারের কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপে সনাতনী ধর্মাবলম্বীরা সন্তুষ্ট।
সরেজমিনে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, জেলার প্রায় সবকটি পূজা মন্দিরে প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। প্রতিমায় চলছে শেষ মুহূর্তের রং তুলির আঁচড়। প্রতিমা তৈরি ও সাজসজ্জার কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন প্রতিমা তৈরির কারিগররা। দম ফেলার ফুরসত নেই এখন কারিগরদের। ইতিমধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ডেকোরেটররা তোরণ নির্মাণ ও আলোকসজ্জার কাজ শুরু করেছে।
প্রতিমা কারিগরদের সাথে কথা বলে জানা যায়, যথাসময়ে প্রতিমা তৈরির কাজ শেষ হবে। নির্ধারিত সময়ের আগেই দুর্গা দেবীর আরাধনার জন্য মণ্ডপগুলো প্রস্তত করা হবে।
তারা বলেন, প্রতিবছরই আমরা অধীর আগ্রহে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজের অপেক্ষায় থাকি। আসন্ন দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেবী দুর্গার প্রতিমা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। কারিগররা আরো জানান, তারা একেকজনে একাধিক প্রতিমা তৈরি করছেন। ছোট-বড় বিভিন্ন সাইজের প্রতিমা বিক্রি করে তারা লক্ষাধিক টাকা আয় করছেন। লাভ-লোকসান যাই হোক বংশগত পেশার প্রতি সম্মান জানিয়েই তারা আনন্দের সাথে প্রতিমা তৈরি করেন বলে জানান।
জেলার বিভিন্ন মণ্ডপে সাজসজ্জার কাজও চলছে বিরতিহীনভাবে। সারাবছর তেমন কাজ না থাকলেও পূজা উপলক্ষে একসাথে কয়েকটি মণ্ডপের কাজ পান একেকজন। আগামী দুই একদিনের মধ্যেই জেলাব্যাপী পূজা মণ্ডপ তৈরির কাজ সম্পন্ন হবে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে মণ্ডপ প্রস্তত করে কমিটির কাছে বুঝিয়ে দেয়া হবে বলেও জানান কারিগররা।
খাগড়াছড়ি জেলা পুলিশ সুপার আরেফিন জুয়েল বাসসকে বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজার সার্বিক নিরাপত্তার নিশ্চিত করতে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। উৎসবকে নির্বিঘ্ন করতে অনেক দুর্গম এলাকায় কিছু ঝুঁকিপূর্ণ মণ্ডপের তালিকা আমরা পেয়েছি। সেগুলোতে স্থায়ী নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেওয়া হবে। এছাড়াও মোবাইল প্রেট্রোলিংসহ তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। প্রতিটি মণ্ডপে থাকবে পুলিশের নিয়মিত টহল। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা নজরদারি । এছাড়াও পূজাকে ঘিরে জেলায় গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক এবিএম ইফতেখারুল ইসলাম খন্দকার জানান, খাগড়াছড়িতে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে দুর্গা উৎসব উদযাপনের লক্ষ্যে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই পূজা উদযাপন পরিষদের সদস্য ও সনাতন ধর্মের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতিতে পূজা উদযাপন উপলক্ষে জেলা পর্যায়ে প্রস্ততিমূলক সভা সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশ বিভাগও নিরাপত্তার জন্য কাজ করছে। পূজায় অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রতিটি মন্দিরেই পুলিশের পাশাপাশি আনসার ও গ্রাম পুলিশ কাজ করবে। সকলের প্রাণবন্ত অংশগ্রহণে উৎসবমুখর এবং শান্তিপূর্ণভাবে শারদীয় দুর্গোৎসব সম্পন্ন হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।