বস্তির নারী ও শিশুর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে আইসিডিডিআর,বির কার্যকর মডেল 

বাসস
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৯:৫১
ছবি: আইসিডিডিআর,বি

ঢাকা, ৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): নগরীর দরিদ্রের স্বাস্থ্যসেবা ও পুষ্টির চাহিদা পূরণে বাস্তবায়নযোগ্য নতুন মডেল প্রস্তাব করেছে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন স্বাস্থ্য গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআর,বি। 

ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়াবাদ বস্তিতে পরিচালিত ‘নিউট্রি-ক্যাপ’ প্রকল্পের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গেছে, গর্ভবতী নারী, কিশোরী ও দুই বছরের কম বয়সী শিশুদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টি উন্নয়নে স্থানীয় জনগণ নির্ভর একীভূত সেবা কাঠামো উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে।

আইসিডিডিআর,বি নগরের নিম্নবিত্ত গর্ভবতী নারী কিশোরী ও দুই বছরের কম বয়সে শিশুদের পুষ্টি ও স্বাস্থ্যবিধি নিয়ে ‘সলভিং পাবলিক হেলথ প্রবলেম থ্রু ইনোভেটিভ সাইন্টিফিক রিসার্চ’ শীর্ষক গবেষণা চালিয়েছে। 

অ্যাডভান্সিং সেক্সুয়াল এন্ড রিপ্রোডাক্টিভ হেলথ এন্ড রাইট প্রকল্পের আওতায় গবেষণাটি ঢাকার মিরপুরের বাউনিয়াবাদ বস্তির বাসিন্দাদের ওপর করা হয়।

আজ সোমবার রাজধানীর মহাখালীতে আইসিডিডিআর,বির সাসাকাওয়া অডিটোরিয়ামে এই গবেষণার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন গবেষক দলের প্রধান ড. মোস্তফা মাহফুজ।

সামগ্রিকভাবে নগরের স্বাস্থ্যসূচক গ্রামাঞ্চলের চেয়ে ভালো হলেও শহরের বাসিন্দাদের মধ্যে আয়ের তারতম্য ব্যাপক ও বৈষম্য দৃশ্যমান। বস্তিতে বাস করা অর্ধেকের বেশি পরিবার খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগে এবং তাদের এবং শিশুদের প্রায় ৫০ শতাংশ খর্বাকৃতির। শহরের ৫৩ শতাংশ নারী প্রশিক্ষক স্বাস্থ্য কর্মীর কাছ থেকে গর্ভকালীন ৪ বা ততোধিকবার সেবা পান সেখানে বস্তিতে এ হার মাত্র ৪০ শতাংশ। এ অবস্থায় গর্ভবতী মহিলা-কিশোরী এবং শিশুদের খাদ্য ও পুষ্টির জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ ও তা কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন কীভাবে হতে পারে তা নিয়েই মূলত এই গবেষণা।

গবেষণার শুরুতে বাউনিয়ার ১৫ হাজার বিবাহিত নারীর মধ্যে ৭২১ জন গর্ভবতী নারীকে শনাক্ত করা হয় এবং ৪২০০ কিশোরী ও দুই বছরের চেয়ে কম বয়স্ক প্রায় ২৫০০ শিশু অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ১৬৫৩২টি পরিবারের মধ্যে ২০১৮ ২৬ টি নিয়ে ২০২১ সালের নভেম্বর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গভীর বিশ্লেষণ চালানো হয়। এসব পরিবারে কিছু সূচকে স্থিতিশীলতা দেখা গেলেও দারিদ্র্য ও অসুবিধা ছিল প্রকট। প্রতিটি পরিবারের গড় আয় ২১ হাজার টাকা থাকা সত্ত্বেও প্রতি চারটি পরিবারের মধ্যে একটি পরিবার খাদ্য সংকটে ভুগেছে। আর এসব পরিবারের মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ কোন না কোনোভাবে ঋণগ্রস্ত ছিল। ৩৯ শতাংশ পরিবারের একটি ছোট্ট ঘরে তিনজনের বেশি সদস্য ঘুমায় এবং ৪২ শতাংশ পরিবারে নারীরা সংসারে অবদান রাখেন। তাদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ পরিবার প্রাথমিক শিক্ষা সম্পন্ন করতে পারেননি। 

নিউট্রি-ক্যাপ কর্মসূচির শুরুতে গর্ভবতী নারী, কিশোরী ও দুই বছরের কম বয়স্ক শিশুদের লক্ষ্য করে একীভূত সেবা প্যাকেজ চালু করা হয়। গর্ভবতীদের ক্ষেত্রে প্রতি মাসে বাড়িতেই পুষ্টি বিষয়ক পরামর্শ প্রদান, আয়রন, ফলিক এসিড, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর মত পুষ্টি উপাদান এবং ওজন, রক্তচাপ, হিমোগ্লোবিন ও রক্তে শর্করার পরিমাণ পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তাদের নিয়মিত প্রসব পূর্ব চেকআপ ও যথাযথ বিশ্রামের উৎসাহ দেওয়া হয়। এর ফলে ইতিবাচক সাড়া হিসেবে কর্মসূচিভুক্ত নারীদের গড় ওজন বৃদ্ধি ছিল ৮.৯ কেজি। যেখানে অন্যান্য নারীদের তা ছিল ৭.৫ কেজি। নিরাপদ প্রসব, হাসপাতালে সন্তান জন্মদানের হার বৃদ্ধি, গর্ভপাত হ্রাস, মৃতভ্রুণ ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমে যায়। নির্ধারিত সময়ের আগেই গর্ভকালীন বয়সের তুলনায় কম ওজনের সন্তান জন্মের ঝুঁকি কমে যায় ১৬ শতাংশ।

কিশোরীদের ক্ষেত্রে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ গড়ে ১২.০ থেকে বেড়ে দাঁড়ায় ১২.৮ গ্রাম/ডেসিলিটার। এক পর্যায়ে দেখা যায়, খাদ্য বৈচিত্র্য স্থির থাকলেও স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে সচেতনতা বেড়েছে তাদের মধ্যে। এই কিশোরীদের মধ্যে ১৪.৯ শতাংশ ছিল অপুষ্টির কারণে ক্ষীণকায়। আবার ১২.৬ শতাংশ ছিল অতিরিক্ত ওজনের যার সাথে দেশের শহর অঞ্চলের গড় পরিস্থিতির মিল রয়েছে।

শিশুদের স্বাস্থ্যেও আসে সুস্পষ্ট অগ্রগতি এবং তাদের উচ্চতা ও ওজনের উন্নতি ছাড়াও হজম প্রক্রিয়া ও অন্ত্রের স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে। 

এই পদ্ধতিতে অর্থনৈতিক সফলতা পাওয়া গেছে-বিশেষ করে গর্ভবতী নারী ও শিশুদের ক্ষেত্রে ওষুধ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ কমেছে। গবেষণায় মানবসম্পদের খরচ ছিল সবচেয়ে বেশি। তবে গবেষণা থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে- এই মডেল প্রয়োগ ও ব্যবস্থায়িত হলে চিকিৎসা খরচ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব।

গবেষক দলের প্রধান ড. মোস্তফা মাহফুজ বলেন, এই মডেলের সফলতার পেছনে রয়েছে স্থানীয় জনগণের অবদান। এই মডেলটি কাজ করেছে কারণ এটি স্থানীয় জনগণের কথা শুনেছে, স্থানীয় নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং একাধিক বাধাকে একসাথে মোকাবিলা করেছে। তথ্য প্রমাণ ভিত্তিক কর্মসূচি এই দুইয়ে মিল হলে সম্ভাবনা অসীম বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আইসিডিডিআর,বির নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ বলেন, বস্তিবাসী প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবায় দীর্ঘদিন ধরে নিউট্রিক্যাপের মত অভিযোজিত মডেলগুলো শুধু কার্যকরী নয় বরং দেশের অন্যান্য বস্তি এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটেও প্রসারণযোগ্য।

অনুষ্ঠানের সূচনা বক্তব্য দেন আইসিডিডিআরবির নিউট্রিশন রিসার্চ ডিভিশনের সিনিয়র ডিরেক্টর ড. থাডিইয়াস ডেভিড মে। সমাপনী বক্তব্য দেন অ্যাডসার্চ বাই আইসিডিডিআর,বি'র প্রকল্প পরিচালক ও আইসিডিডিআর প্রফেসর ইমেরিটাস ড. শামস এল আরিফিন। তিনি এই মডেলটি বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারণ ও অংশীদারদের সুযোগ তুলে ধরেন।

সেমিনারে সরকারি কর্মকর্তা উন্নয়ন, সহযোগী, এনজিও প্রতিনিধি ও গবেষকসহ বিভিন্ন খাতের অংশীজন অংশগ্রহণ করেন।

যেখানে প্রতিদিনের বেঁচে থাকাই এক সংগ্রাম, সেখানে বাউনিয়াবাদ বস্তির নারী ও শিশুদের জন্য এক টুকরো আশার বার্তা বয়ে এনেছে আইসিডিডিআর,বি’র নতুন স্বাস্থ্যসেবা মডেল। এটি শুধু একটি প্রকল্প নয়, বরং নগর দরিদ্রদের জন্য টেকসই সমাধানের দিকনির্দেশনাও।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
উপজেলা পর্যায়ে অধঃস্তন আদালত সম্প্রসারণে একমত রাজনৈতিক দলগুলো : আলী রীয়াজ
বাংলাদেশ নারী দলকে ৫০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা ক্রীড়া উপদেষ্টার
রাজধানীর শ্যামপুরে আওয়ামী লীগের তিন নেতা-কর্মী গ্রেফতার
‘র‌্যাপিড নিডস অ্যাসেসমেন্ট’ প্রতিবেদনের সঠিকতা নিরূপণে কর্মশালা
আশুলিয়ায় সাব রেজিস্ট্রারের পদত্যাগের দাবীতে দলিল লেখকদের মানববন্ধন 
আশুলিয়ায় সাব রেজিস্ট্রারের পদত্যাগের দাবীতে দলিল লেখকদের মানববন্ধন 
আশুলিয়ায় সাব রেজিস্ট্রারের পদত্যাগের দাবীতে দলিল লেখকদের মানববন্ধন 
বিচারসেবা দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে আদালত বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই : মজিবুর রহমান মঞ্জু
সাভারে পিস্তল ও গুলিসহ সন্ত্রাসী টুটুল গ্রেফতার
মনিপুরে চাঁদাবাজির ঘটনায় ৪ জন গ্রেফতার 
১০