
শেরপুর, ২৭ নভেম্বর ২০২৫ (বাসস) : একজন ফুটবলার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করা জহির রায়হান এখন দেশসেরা এ্যাথলেট। দেশের গন্ডি পেরিয়ে অলিম্পিকে প্রতিনিধিত্ব করা এবং স্বর্ণপদক জয়ের স্বপ্নে দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন জহির।
শেরপুর সদর উপজেলার লছমনপুর ইউনিয়নের দীঘলদি গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক (৬০) ও শিখা বেগম (৫০) দম্পতির চার পুত্র সন্তানের মধ্যে জহির রায়হান দ্বিতীয়।
বড় ছেলে রাসেল ও জহির যখন ছোট, তখন তাদের পড়াশোনার জন্য গ্রামের বাড়ি ছেড়ে শহরের বাড়ইপাড়া মহল্লা বসবাস শুরু করেন আব্দুর রাজ্জাক। এরপর শহরের একটি বেসরকারি স্কুলে ভর্তি হয় দুই ভাই। রাসেল নিয়মিত স্কুল করলেও ৩য় শ্রেণিতে ওঠার পর খেলাধুলার প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে জহির রায়হান। এজন্য স্কুলেও সে অনিয়মিত হয়ে পড়ে। শুরুতে স্বাভাবিক ভাবেই বিষয়টি ভাল চোখে দেখেননি বাবা আব্দুর রাজ্জাক। কিন্তু নিজে শরীরচর্চার শিক্ষক হওয়ায় তারও খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক ছিল।
শেষ পর্যন্ত জহিরকে তিনি ফুটবল অনুশীলন করার জন্য শেরপুরের স্থানীয় খেলোয়াড় কোচিং ক্লাবের কোচ সাধন বসাকের কাছে নিয়ে যান। সেখানে ভর্তির পর সে ভাল ফুটবলার হিসেবে নিজেকে মেলে ধরতে সক্ষম হয়। ফুটবল খেলার সময় তার দৌড়ের ক্ষিপ্রতা দেখে অবাক হয়েছিলেন কোচ সাধন বসাক। ওই ক্লাবে এক বছর প্রশিক্ষণ নেন জহির রায়হান।
পরবর্তীতে শেরপুরে বিকেএসপির প্রতিভা অন্বেষণ কার্যক্রম অনুষ্ঠিত হয়। প্রথমবার সেখানে অংশ নিয়ে বাছাইয়ে টিকতে না পারলেও পরেরবার ২০১২ সালে এ্যাথলেটিক খেলোয়াড় হিসেবে বিকেএসপিতে সুযোগ করে নেন জহির। সেখানে প্রথমে একমাস প্রশিক্ষণ করে বাছাইয়ে টিকে যান এবং আবারও ৫ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে বিকেএসপিতে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ পান জহির। সেসময় তাকে সহযোগিতা করেন কোচ আব্দুল্লাহ হেল কাফি। এরপর থেকেই শুরু হয় তার সামনে এগিয়ে চলা।
দেশজুড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় নিজেকে প্রমান করতে থাকেন জহির রায়হান। ৪০০ মিটার স্প্রিন্টে ৪৬.৮৬ সেকেন্ড সময় নিয়ে দেশীয় আসরে ৩২ বছরের রেকর্ড ভেঙ্গে নতুন রেকর্ড গড়েছেন তিনি। এছাড়া ২০১৭ সালে কেনিয়ায় ওয়ার্ল্ড ইয়্যুথ অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ ও থাইল্যান্ডে এশিয়ান ইয়্যুথ অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ ৪০০ মিটার ইভেন্টে অংশগ্রহণ করে হিটে উত্তীর্ণ হয়ে সেমিফাইনাল খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন। ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কায় সাউথ এশিয়ান জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশীপ, ২০১৯ সালে কাতারে ওয়ার্ল্ড অ্যাথলেটিকস, ২৩তম এশিয়ান অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশীপ এবং নেপালে ১৩তম সাউথ এশিয়ান গেমসে অংশগ্রহণ করেছেন জহির।
জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই সাফল্যের পথ ধরে বাংলাদেশ নৌ-বাহিনী তাকে পেটি অফিসার হিসেবে চাকুরীতে নিয়োগ দেয়।
ছেলের সাফল্যে দারুন খুশি বাবা আব্দুর রাজ্জাক জানান, ছোট থেকেই জহিরের খেলার প্রতি আগ্রহ ছিল। তাই বড় ছেলের পরামর্শে জহিরকে ফুটবল কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে দেই। আমার ছেলে শেরপুরের নাম পুরো দেশে উজ্জ্বল করেছে। আমি চাই সে যেন দেশের জন্য সবচেয়ে বড় সম্মান বয়ে আনতে পারে।
মা শিখা বেগমও ছেলের সাফল্যের জন্য সবার দোয়া কামনা করে বলেন, আমার ছেলে দেশের সম্পদ। সে শুধু জাতীয় পর্যায়ের একজন খেলোয়াড় নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও তার বেশ পরিচিতি আছে।
জহির রায়হান জানান, ‘ছোট থেকেই খেলা পাগল ছিলাম। প্রথমে ফুটবল দিয়ে শুরু করলেও পরবর্তীতে আমার বাবার ইচ্ছেতেই আমি এ্যাথলেটিকসে বিকেএসপিতে ভর্তি হই। আমি আমার বাবা-মার আশা পূরণ করতে পেরেছি। এ জন্য আমার বর্তমান ও সাবেক কোচদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। আর আমার সংস্থা নৌ-বাহিনী আমাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছে। সেইসাথে এ্যাথলেটিকস ফেডারেশনও আমাকে যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। আমি দেশবাসীসহ সবার কাছে দোয়া চাই। আমি যেন আগামী অলিম্পিকে দেশের জন্য বড় সম্মান বয়ে আনতে পারি।’
জহির রায়হানের প্রথম কোচ সাধন বসাক বলেন, জহির প্রথমে আমার কাছে ফুটবল অনুশীলন করেছে। তার অনুশীলন ও তার গতি দেখে প্রথম থেকেই আমি ভেবেছি, সে একদিন বড় কিছু করতে পারবে। আজ সেটাই বাস্তবে পরিণত হয়েছে। সে এখন দেশসেরা অ্যাথলেট।
জেলা ক্রীড়া অফিসার ধীরেন্দ্র চন্দ্র সরকার জানান, শেরপুরে জহিরের মতো আরো উদীয়মান খোলোয়াড় রয়েছে। তারাও যেন জাতীয় পর্যায়ে স্থান পায় সেজন্য কাজ করছে জেলা ক্রীড়া অফিস।
শেরপুরের জেলা প্রশাসক তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, জহির শেরপুর জেলার গর্ব। সে শুধু শেরপুর নয় সারাদেশের ভাবমূর্তিকে উজ্জল করছে। আমি আশা করব, শেরপুরের কৃতি সন্তান হিসেবে জহির ভবিষ্যতে অলিম্পিকে স্বর্নপদক জয় করে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে।