নরওয়ের নদীতে ধীরে ধীরে বিলীন হচ্ছে প্রাকৃতিক স্যামন

বাসস
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৫, ২১:১১

ঢাকা, ৯ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): বৃষ্টিতে ফুলে ওঠা নদীর জলে দাঁড়িয়ে ক্রিস্টার ক্রিস্টোফারসেন ছিপ ফেলেন, সুক্ষ্মভাবে পানিতে টোপ নামান, কিন্তু কিছুই পান না। নরওয়ের প্রাকৃতিক স্যামন আজ বিলুপ্তির দ্বারপ্রান্তে। মাছের খামার ও জলবায়ু পরিবর্তনের যৌথ প্রভাবকে এর পর‌্য দায়ী করা হচ্ছে।

স্ট্যুরডাল নদীতে দাঁড়িয়ে এই ফ্লাই ফিশিং প্রেমিক বলেন, ‘আশির দশকের গোড়ার দিকে আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন নদীতে এত মাছ ছিল, আপনি কল্পনাও করতে পারবে না। নদীজুড়ে ছিল সি ট্রাউট আর স্যামনের ভিড়। এক সন্ধ্যায় ১০ থেকে ১৫টি মাছ ধরা যেত।’

নরওয়ের হেগ্রা থেকেজ এএফপি জানায়, ৫২ বছর বয়সী ক্রিস্টোফারসেন গত ১০ দিন ধরে নদী থেকে একটি মাছও ধরতে পারেননি, যদিও মাছ ধরায় তার রয়েছে বহু বছরের অভিজ্ঞতা।

প্রাকৃতিক স্যামনের অস্তিত্ব এতটাই সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে যে, ২০২১ সালে নরওয়ে এ প্রজাতিকে তাদের বিপন্ন প্রজাতির ‘লাল তালিকায়’ অন্তর্ভুক্ত করে।

প্রাকৃতিক নিয়মে নদীতে জন্ম নেওয়া এই মাছগুলো বড় হয়ে সমুদ্রে পাড়ি জমায় এবং পরিণত বয়সে প্রজননের জন্য ফেরে নিজ নদীতে। কিন্তু এখন এসব মাছ সমুদ্র থেকে আর ফিরছে না। তারা সাগরে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে বিজ্ঞানীরা মনে করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে এর সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে।

নরওয়ের পরিবেশ সংস্থার অধীনে গঠিত স্বাধীন সংস্থা ‘নরওয়েজিয়ান সায়েন্টিফিক অ্যাডভাইজরি কমিটি ফর আটলান্টিক স্যামন’ জানিয়েছে, ২০২৪ সালে মাত্র ৩ লাখ ২৩ হাজার বন্য স্যামন নদীতে ফিরে এসেছে, যেখানে আশির দশকে এ সংখ্যা ছিল বছরে প্রায় ১০ লাখ।

এই পতন উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে খেলাধুলার অংশ হিসেবে মাছ ধরায় নিয়োজিতদের মধ্যে, যারা শিকারে আনন্দ খোঁজেন এবং যাদের অনেকেই জীবিকা নির্বাহ করেন এই উৎস থেকে। ১৯ শতকে ব্রিটিশ অভিজাতদের হাত ধরে ফ্লাই ফিশিং নরওয়ে পৌঁছায় এবং তা স্থানীয় সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে।

"স্যামন শিকার নরওয়ের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—নদী উপত্যকার স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও অর্থনীতি উভয়ের জন্য," বলেন নরস্কে লাক্সেলভার ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যাকসেল হেমব্রে। তিনি বলেন, "আমরা স্যামন শিকারের সূত্র ধরে প্রচুর পর্যটক আকৃষ্ট করি।"

নদীতে ফিরে আসা স্যামনের সংখ্যা হ্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে, কর্তৃপক্ষ গত বছর ৩৩টি জলপথে মাছ ধরা নিষিদ্ধ করে এবং চলতি বছর আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে; নদী বন্ধ, সংক্ষিপ্ত মৌসুম, এবং সীমিত কোটা চালু হয়েছে।

এসব সিদ্ধান্ত পর্যটন ও মাছ ধরায় নিয়োজিত ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার স্পোর্ট অ্যাঙ্গলারের ওপর প্রভাব ফেলেছে, যাদের প্রিয় নদীগুলোতেও এখন আর স্যামন পর্যাপ্ত সংখ্যায় ধরা পড়ে না।

জলবায়ু পরিবর্তন নদীর পানির উষ্ণতা বাড়ায় এবং পরিবেশগত ভারসাম্য নষ্ট করে ফলে স্যামনের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। এছাড়া আরেকটি বড় কারণ হলো মাছচাষ।

সত্তরের দশকে শুরু হওয়া এই শিল্প এখন বছরে ১২ বিলিয়ন ডলারের এক দানবীয় অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে, তেল ও গ্যাসের পরেই নরওয়ের দ্বিতীয় বৃহৎ রপ্তানি খাত এটি। দেশটির ফিয়র্ডগুলো এখন মাছের খোলা খাঁচায় ভরা, প্রতিটি খাঁচায় ২ লাখ পর্যন্ত মাছ থাকে।

কিছু গবেষণায় বলা হয়, বর্তমানে খামারে চাষ করা স্যামনের সংখ্যা নদীর স্যামনের চেয়ে এক হাজার গুণ বেশি, যা প্রাকৃতিক প্রজননে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।

নদীর স্যামনের ওপর খামারজাত স্যামনের প্রভাব মারাত্মক। এই খামারে চাষ করা মাছের গায়ে জন্মায় সি লাইস নামের পরজীবী, যা নদী থেকে সমুদ্রগামী বন্য মাছের গায়ে লেগে যায়। কমিটির প্রধান টরবিয়োর্ন ফোরসেথ বলেন, ‘এই পরজীবীগুলো তাদের চামড়া খেয়ে ফেলে, রক্ত শুষে নেয়, ফলে তারা মারা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রাকৃতিক ও খামারজাত স্যামনের সংকরায়ন খারাপ, কারণ খামারের স্যামন খামারের পরিবেশে মানিয়ে নিয়েছে, যা প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে তাদের দেহে যেসব বৈশিষ্ট্য তৈরি হয়েছে, যেমন দ্রুত বেড়ে ওঠা, তা প্রাকৃতিক পরিবেশে মারাত্মক ক্ষতিকর।’

এসব সমস্যা থেকে বাঁচতে মাছচাষের খোলা খাঁচা বন্ধ করে বদ্ধ খাঁচা চালুর দাবি জোরালো হচ্ছে।

হেমব্রে বলেন, ‘আমরা চাই খামার থেকে যেন কোনো বর্জ্য না বের হয়, মাছ পালিয়ে না যায়, এবং সি লাইস যেন প্রাকৃতিক স্যামনের ওপর প্রভাব না ফেলে। নদীর প্রাকৃতিক স্যামন বাঁচাতে হলে এসব শর্ত মানতেই হবে।’

মাছচাষ শিল্পও প্রাকৃতিক স্যামনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন হলেও তারা দাবি করে, সময় প্রয়োজন। ‘এটা খুবই জটিল একটি কাজ। খোলা পদ্ধতির তুলনায় সমুদ্রে একটি বন্ধ ব্যবস্থা নির্মাণ সহজ নয়। অনেক বিষয় বিবেচনায় নিতে হয়,’ বলেন নরওয়েজিয়ান সি ফুড অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র ওইভিন্ড আন্দ্রে হারাম।

তিনি বলেন, ‘এই ব্যবস্থা কি সমুদ্রের স্রোত বা ফিয়র্ড দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না? কিছু ভেঙে যাবে না? এসব নিশ্চিত হতে সময় লাগে।’

শিল্পের পক্ষ থেকে আরও গবেষণার দাবি জানানো হয়েছে, যাতে বন্য স্যামনের পতনের প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা যায়।

নরওয়ের পার্লামেন্ট গত জুনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আগামী দুই থেকে চার বছরের মধ্যে মাছচাষ নিয়ন্ত্রণে নতুন বিধিনিষেধ চালু করা হবে। এর মাধ্যমে খামারের পরিবেশগত প্রভাব কমানো এবং ধাপে ধাপে বন্ধ খাঁচায় রূপান্তর বাধ্যতামূলক করা হবে।

তবে এই গতি নিয়ে হতাশ গাউলা নদীর পাড়ে ফিশিং লজ পরিচালনাকারী আন্ন-ব্রিট বোগেন। তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক স্যামনের বিপর্যয়ে সরকার যেন শম্বুক গতিতে হাঁটছে, অথচ প্রয়োজন ছিল এক বিপ্লব। সরকার যদি দায়িত্ব না নেয়, তাহলে হয়তো আমিই হবো নরওয়ের নদীতে প্রাকৃতিক স্যামন ধরার শেষ প্রজন্ম।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
এসএসসি পরীক্ষায় যশোর বোর্ডে পাশের হার ৭৩.৬৯ শতাংশ
যাত্রাবাড়ীতে অগ্নিদগ্ধ এক পরিবারের ৩ সদস্য
ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ডে এসএসসি পাশের হার ৫৮.২২ শতাংশ
নেত্রকোনার বিজয়পুর সীমান্ত দিয়ে ২১ জনকে পুশ-ইন করলো বিএসএফ
কিয়েভ হামলার পর রাশিয়ার ওপর দ্রুত নিষেধাজ্ঞা চান জেলেনস্কি
সারাদেশে পুলিশের বিশেষ অভিযানে গ্রেফতার ১,২৮৪
আগামীকাল শ্রীলংকার বিপক্ষে মাঠে নামছে বাংলাদেশ
দোষ স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন
রাষ্ট্র সংস্কারের মৌলিক বিষয়ে একমত হওয়ার আহ্বান আলী রীয়াজের
১০ জন জিম্মিকে মুক্তি দিতে রাজি হামাস
১০