হিমবাহের দেশে নিরাপদ পানির তীব্র সংকট

বাসস
প্রকাশ: ০৮ অক্টোবর ২০২৫, ১৪:২৫

ঢাকা, ৮ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : তৃষ্ণা মেটাতে একপ্রকার ঝুঁকি নিতে হয় তাজিকিস্তানের শ্রমিক নেমাতুল্লো বাসিরভকে। তিনি বাড়ির উঠোন দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পানিই নিরাপদ ভেবে পান করেন। তারপর সুস্থ থাকার আশায় সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থণা করেন। 

পাহাড়ি হিমবাহ থেকে প্রাপ্ত বিপুল পানির মজুত থাকা সত্ত্বেও মধ্য এশিয়ার এই দেশটিতে বিশুদ্ধ ও নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা এখনও সাধারণের নাগালের বাইরে।

খাল থেকে ময়লার প্লাস্টিক ব্যাগ, খাবারের মোড়ক আর এনার্জি ড্রিংকের খালি ক্যান তুলতে তুলতে বাসিরভ বলেন ‘এই পানিতে নানা রকম ময়লা থাকে’। 

তিনি আরও জানান, কখনও কখনও ওই পানির মধ্যে ব্যবহার করা ডায়াপার বা পাশের বাড়ির হাঁসের বিষ্ঠাও খুঁজে পাওয়া যায়।

দক্ষিণ-পশ্চিম তাজিকিস্তানের বালখ জেলার এই খালটি স্থানীয়ভাবে এখনও ‘কোলখোজোবোদ’ নামেই পরিচিত। এটি সোভিয়েত আমলে দেওয়া নাম। পুরো গ্রামের মানুষ এই খালের পানি ব্যবহার করে।

৫৮ বছর বয়সী বাসিরভ জানান, ফসল সেচের পর এখানকার পানিতে কাদা আর কীটনাশক মিশে আসে।

সেসময়ই তার ভাবি একই পানিতে আঙুর ধুচ্ছিলেন। এগুলোই পরে রাতের খাবার টেবিলে পরিবেশন করা হবে।

তবে ঝুঁকি সম্পর্কে কিছুটা সচেতন বাসিরভ। তিনি চেষ্টা করেন নিজের উঠোন দিয়ে বয়ে যাওয়া খালের পানিটাকে নিরাপদ করে পান করতে।

তিনি বালতিতে পানি রেখে দেন কিছু সময়। ময়লা তলানিতে জমা বা উপরে ভেসে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। তারপর তা ফুটিয়ে নেন।

সতর্কতা অবলম্বনের পরও তার পরিবারের সদস্যরা বারবার অসুস্থ হয়ে পড়ে।

বাসিরভ নিজেও তার শরীর নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। ‘আমার মনে হয় পেট আর এই পানি সহ্য করতে পারছে না,’ আক্ষেপ করে বলেন তিনি।

বালখ জেলার দূষিত এই খালের পানিতে স্থানীয় নারীরাও থালা-বাসন ও কাপড় ধোয়ার কাজ করেন। স্কুলের শিক্ষার্থীরা একদিকে তুলি থেকে রঙ পরিষ্কার করেন, আবার অন্য শিশুরা সেই পানিতেই গোসল করে।

তবে কয়েক কিলোমিটার দূরে বসবাস করা মালিকা এরমাতোভার এই নোংরা পানিও পায় না।

৩০ বছর বয়সী এরমাতোভা সম্পূর্ণ শুষ্ক ভূমিতে বসবাস করেন। তিনি ট্যাংকার ট্রাকে করে পানি কিনে আনেন । তারপর বাড়ির আঙিনার নিচে চার টন ধারণক্ষম একটি ট্যাংকে সংরক্ষণ করেন।

‘আমরা এই পানি সব কাজে ব্যবহার করি- পান করা, কাপড় ধোয়া, আঙিনা পরিষ্কার করা, গাছে পানি দেওয়া—সব,’ জানান তিন সন্তানের এই জননী।

এই দৃশ্য রাজধানী দুশানবের উপকণ্ঠে বসবাসকারীদেরও।

এরমাতোভা জানান, কিনে আনা পানি দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তিন থেকে চার সপ্তাহ পরপর পরিবর্তন করতে হয়।

আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী খাতলন অঞ্চলটি দেশটির সবচেয়ে উষ্ণ অঞ্চল। যেখানে গ্রীষ্মজুড়ে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি থাকে।

 সোভিয়েত আমলের অবকাঠামো 

২০২৩ সালের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, তাজিকিস্তানের ১ কোটি জনসংখ্যার মাত্র ৪১ শতাংশ মানুষের নিরাপদ পানির ব্যবস্থা রয়েছে।

স্যানিটেশন ব্যবস্থায় আওতায় আছে আরও কম, মাত্র ১৫ শতাংশ, যা মধ্য এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম।

ইউরেশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের তথ্যমতে, পুরো মধ্য এশিয়ায় ৮ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ১ কোটি মানুষ নিরাপদ পানি পাচ্ছে না।

অধিকাংশ দেশ শুষ্ক মরুভূমিতে পানি সংকটে ভুগছে। কবে তাজিকিস্তানের সমস্যা কিছুটা ভিন্ন।

তাজিকিস্তান ও কিরগিজস্তানের প্রায় ২৫ হাজার হিমবাহ এ অঞ্চলের দুই-তৃতীয়াংশ পানির মজুতের উৎস। অর্থাৎ, পানির ঘাটতি থাকার কথা নয়।

কিন্তু পুরনো অবকাঠামো ও অর্থাভাবের কারণে পর্যাপ্ত ও টেকসই পানি সরবরাহ ব্যাহত হচ্ছে।

সোভিয়েত যুগে নির্মিত অবকাঠামো ১৯৯০-এর দশকের গৃহযুদ্ধে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন দেশটির প্রায় এক-চতুর্থাংশ পানি সরবরাহ ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়েছে।

হাইড্রলিক প্রকৌশলী আবদুর রহিম আবদুলোয়েভ বলেন, পানি সরবরাহের যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া এখানে নিয়মিত ঘটনা।

ভাঙাচোরা একটি স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি জানান, এই পানিশোধন কেন্দ্রটি ২ হাজার ৮০০টি পরিবারে পানি সরবরাহের কথা। কিন্তু যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকায় এখন সরবরাহ বন্ধ।

দারিদ্র্য, তাপদাহ ও দূষিত পানিতে এখানে জীবন দুর্বিষহ।  

সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে সবচেয়ে দরিদ্র দেশ হিসেবে তাজিকিস্তান এখন কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতার মুখোমুখি।

ইউরেশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে দেশটির অর্থায়নের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়াবে ১২০ কোটি ডলারে।

বিজ্ঞান বিষয়ক জার্নাল নেচার-এ গত বছর প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয়, ১৯৯০ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে দেশটিতে প্রতিবছর গড়ে ১ হাজার ৬২০ জন মানুষ ‘পানিবাহিত রোগে’ মারা গেছে।

সৌদি আরব ও পাকিস্তানের গবেষকেরা সম্প্রতি সতর্ক করে বলেছেন, ‘পানিদূষণ জনিত মৃত্যুর সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’

১৯৯২ সাল থেকে ক্ষমতায় থাকা প্রেসিডেন্ট এমোমালি রাহমন তার পররাষ্ট্রনীতিতে ‘পানি কূটনীতি’কে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। জাতিসংঘে তিনি পানি ব্যবস্থাপনা ও নদীনির্ভর উন্নয়ন বিষয়ে একাধিক প্রস্তাবও উত্থাপন করেছেন।

‘তাজিকিস্তানের বরফ ঢাকা পাহাড় থেকে নেমে আসা প্রাণবন্ত নদীগুলোর জন্যই তৃষ্ণার্ত মরুভূমি পরিণত হয় সবুজ মরুদ্যানে,’ বালখ এলাকায় টানানো পোস্টারে প্রেসিডেন্টের এই উক্তিটি লেখা রয়েছে।

জানা গেছে, চলতি বসন্তে সরকার নিরাপদ পানির প্রাপ্যতা বাড়াতে ১৫ বছর মেয়াদি একটি কর্মপরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।

জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে এই সমস্যা আরও তীব্র হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

তাই, সরকারের কৌশলপত্রেও ‘পানীয় জল ও স্যানিটেশন সেবা’ নিশ্চিত করাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
‘হস্তক্ষেপমূলক’ অবস্থানের জেরে ইইউ’র রাষ্ট্রদূতদের তলব ইরানের
অভিযুক্ত ইউক্রেনীয় ড্রোনগুলোকে ‘নিষ্ক্রিয়’ করা হয়েছে : রাশিয়া
আমাদেরকে স্বনির্ভর হতে হবে : প্রধান উপদেষ্টা
ক্যারিয়ার সেরা র‌্যাংকিংয়ে সাইফ, ৮৭ ধাপ উন্নতি নাসুমের
সুদানে হাসপাতালে আধাসামরিক বাহিনীর হামলায় নিহত ৮
ধানসিঁড়ি জোনে দুই বিভাগে মাদারীপুর ও বরিশাল চ্যাম্পিয়ন
৮ লাখ ২৯ হাজার শিশুকে টাইফয়েডের টিকা দেবে চসিক
মাদ্রিদে ভবন ধসে শ্রমিক নিখোঁজ, তিনজন আহত
কুর্দিদের সাথে ‘যুদ্ধবিরতি ঘোষণা’ সিরিয়ার
মেহেরপুরে জাতীয় কন্যাশিশু দিবস উদযাপন 
১০