
ঢাকা, ২৫ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস) : প্রবল ঝোড়ো হাওয়ায় দুলছে দক্ষিণ আফ্রিকার বায়ু চালিত একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পর্যবেক্ষণ চৌকি। পাহাড়ের ওপরে থাকা সেই চৌকিতে বসে দূরবীন দিয়ে পুরো এলাকায় নজর রাখছেন দুই পর্যবেক্ষক।
আশেপাশে অনেকটা এলাকাজুড়ে ওভারবার্গ পর্বতমালার দৃশ্য। কিন্তু পর্যবেক্ষকদের নজর কেবল কাছের বিশাল বায়ু টারবাইনের চারপাশে। আচমকা সেখানে ছোট কালো ছায়া দেখতে পান তারা।
তখনেই ওয়াকিটকি-তে একজন বলে ওঠেন, ‘টারবাইন ১১ বন্ধ করুন, কেপ ভালচার আছে।’ অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে-‘টারবাইন ১১ বন্ধ করা হচ্ছে’।
পরবর্তীতে মাত্র ১ মিনিটের মধ্যে ১৫০ মিটার (৫০০ ফুট) উচ্চতার টারবাইনটির ব্লেড সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়।
বার্ডলাইফ সাউথ আফ্রিকার তথ্য মতে, প্রতিবছর বায়ু টারবাইনে গড়ে ৪টিরও বেশি পাখি মারা যায়। বেশিরভাগই ব্লেডের আঘাতে প্রাণ হারায়। ব্লেডের গতি ঘণ্টায় ২৮০ কিলোমিটার পর্যন্তও হতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্তমানে ১৪শ’টির বেশি উইন্ড টারবাইন চলমান রয়েছে। সে হিসেবে প্রতি বছর আনুমানিক ৬ হাজার পাখি মারা যায়। এর মধ্যে ১০ শতাংশ বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির।
পাখি মৃত্যু কমানোর জন্য এক্সেলসিওর উইন্ড ফার্ম ‘শাটডাউন অন ডিমান্ড প্রোটোকল’ চালু করেছে। যা প্রধানত ছয়টি বিপন্ন প্রজাতিকে রক্ষা করছে। এর মধ্যে অন্যতম হল কেপ ভালচার ও ব্ল্যাক হ্যারিয়ার।
পর্যবেক্ষকরা যখন কোন বিপন্ন পাখি দেখেন, তখন তারা রেডিওর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে জানান। সঙ্গে সঙ্গে টারবাইন বন্ধ করা হয়।
কেপ টাউন থেকে ২০০ কিলোমিটার পূর্বে অবস্থিত এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কার্যক্রম তদারকি করেন সংরক্ষণ কর্মী ক্ল্যারিসা মার্স। তিনি জানান, ‘সতর্ক করা থেকে শুরু করে টারবাইন বন্ধ হওয়া পর্যন্ত আনুমানিক ৪৩ সেকেন্ড সময় লাগে। গত পাঁচ বছরে এই কেন্দ্রে আটটিরও কম পাখি মারা গেছে। এই বছর এখন পর্যন্ত কোন মৃত্যুর ঘটনা নেই, এতেই আমি খুশি।’
এই প্রটোকলটি ‘স্টপ অন ডিমান্ড’ নামে ২০১০-এর দশকের শেষ দিকে কেনিয়াতে প্রথম গড়ে তোলা হয়। বর্তমানে তা বিশ্বজুড়ে ব্যবহার করা হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় এই পদ্ধতির ব্যবহার প্রথম শুরু হয় ২০২০ সালে, এক্সেলসিয়র বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। অর্থাৎ, ওই বছর থেকে পাখি দেখামাত্রই টার্বাইন বন্ধ করা হচ্ছে।
সাইট ম্যানেজার জ্যাক রেডেলিংহুইস জানিয়েছেন, ১৩টি টার্বাইন নিয়ে চলা এই ছোট প্রকল্পে এ নিয়ম মেনে চলায় বিদ্যুৎ উৎপাদনে তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
তিনি আরও জানান, এই প্রোগ্রামের কারণে আমাদের আয়ের ০.৫ শতাংশেরও কম ক্ষতি হয়েছে। আর বাতাসের গতিবেগ যেদিন বেশি থাকে সেদিন বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়। তখন সেই ক্ষতিও পুষিয়ে নেয়া যায়।
বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে পাখি বিলুপ্তি?
এক্সেলসিয়রের বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্পে ‘শাটডাউন প্রটোকল’ ব্যবহার করে কিছু পাখি (যেমন কেপ ভালচার) রক্ষা করা গেলেও ব্ল্যাক হ্যারিয়ার পাখির ক্ষেত্রে এটি ততটা কার্যকর নয়।
জানা যায়, প্রজাতিটি খুবই সংকটাপন্ন। পৃথিবীতে আর মাত্র প্রায় ১৩শ’টি ব্ল্যাক হ্যারিয়ার পাখি জীবিত আছে।
আকারে খুবই ছোট হওয়ায় পর্যবেক্ষকরা তাদের সহজে শনাক্ত করতে পারেন না বলে জানান ওডেট কার্টিস-স্কট।
ওভারবার্গ অঞ্চল ব্ল্যাক হ্যারিয়ারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রজনন ক্ষেত্র। কিন্তু এখানে তাদের ৯৫ শতাংশ প্রাকৃতিক আবাস কৃষিজমি তৈরির ফলে ধ্বংস হয়েছে। ফলে পানি ও খাদ্যের সন্ধানে পাখিটিকে আরও দূরে যেতে হচ্ছে। এতে টারবাইনে ধাক্কা লেগে তাদের মৃত্যুঝুঁকি বাড়ছে।
ওভারবার্গ রেনোস্টারভেল্ড ট্রাস্টের প্রধান স্কট বলেন, বায়ুচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য এটি আসলে আদর্শ এলাকা নয়। ২০২৫ সালের শুরুতে ট্রাস্টটি এক্সেলসিয়র থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার দূরে কিছু জমি কেনে। সেখানে ব্ল্যাক হ্যারিয়ারের একটি কলোনি রয়েছে। ধারণা করা হয়, প্রতিবছর কমপক্ষে ৪০টি পাখি প্রজননের জন্য সেখানে আসে।
কেপ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রব সিমন্স জানান, গত দশকে ৩০টির বেশি বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে প্রায় ১৩টি ব্ল্যাক হ্যারিয়ার মারা গেছে।
তিনি বলেন, ‘যদি আমরা প্রতি বছর আরও ৩ থেকে ৫টি প্রাপ্তবয়স্ক ব্ল্যাক হ্যারিয়ার উইন্ড ফার্মের কারণে মারা যায়, তবে ৭৫ থেকে ১০০ বছরের মধ্যে এ প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে যাবে।’
অধ্যাপক সিমন্স জানান, দক্ষিণ আফ্রিকা বা সম্ভবত গোটা আফ্রিকার মধ্যেই এটি প্রথম পাখি, যাদের বিলুপ্তির ঝুঁকি বাড়াতে বায়ু বিদ্যুৎ প্রকল্প সরাসরি প্রভাব রাখছে।
তবে সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন তিনি। জানান, ভালো একটি উপায় হতে পারে টারবাইনের ব্লেডে রঙ করা।
সিমন্স আরও বলেন, পাখি কালো ও সাদা রং ভালোভাবে বুঝতে পারে না। তাই মেঘলা আকাশে ওড়ার সময় সাদা ব্লেড দেখতে পায় না। এ কারণে এড়িয়েও যেতে পারে না।
পরীক্ষামূলকভাবে কেপ টাউনের ৯০ কিলোমিটার উত্তরে এক উইন্ড ফার্মের টারবাইন ব্লেডে লাল চিহ্ন দেওয়ায় দুই বছরে পাখি মৃত্যুর হার ৮৭ শতাংশ কমে যায়।
তিনি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো আর সমীচীন হচ্ছে না। কারণ ব্ল্যাক হ্যারিয়ারের মত কিছু প্রজাতি জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে টিকে থাকতে পারবে না। আবার নবায়নযোগ্য শক্তির জন্যও পাখিদের জীবন বিপন্ন করা যাবে না।