বাবা বেঁচে থাকলে জুলাই আন্দোলনে আমার পাশে দাঁড়াতেন : সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা

বাসস
প্রকাশ: ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৪:১১ আপডেট: : ০৭ জুলাই ২০২৫, ১৪:৩৩
সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা। ছবি: সংগৃহীত

//জুবায়ের ইবনে কামাল//

ঢাকা, ৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতি সক্রিয় না থাকায় প্রচলিত সভা, সমাবেশ কিংবা প্রতিবাদের চিত্র তেমন একটা দেখা যায় না। কিন্তু জুলাই অভ্যুত্থান সে চিত্র পাল্টে দিয়েছে। কোটা সংস্কার আন্দোলনে সংহতি জানিয়ে রাজপথে প্রতিবাদ গড়ে তুলেছিল রাজধানীর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেসময়  আওয়ামী গুন্ডা বাহিনী ও পুলিশের আক্রমণের মুখে যেসব শিক্ষার্থীরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল, সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা তাদের মধ্যে অন্যতম।

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা রাজধানীর কানাডিয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী। ৫ বছর আগে বাবার অকাল মৃত্যুর পর মা ও ছোট ভাইয়ের সঙ্গেই স্নিগ্ধার বসবাস। উচ্চ মাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন অন্যায্য সিদ্ধান্ত ও বাক স্বাধীনতা হরণ নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন তিনি। ২০২৪ সালের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলন ও পরবর্তীতে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল তার।

ছাত্রদের আন্দোলন দমাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করে দেয়ার পর ১৮ জুলাই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাজপথে নেমে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়। 

সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অংশে প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ জুলাই অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন জুবায়ের ইবনে কামাল।

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধার সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন জুবায়ের ইবনে কামাল। ছবি: বাসস

বাসস: জুলাই অভ্যুত্থানের প্রায় এক বছর হয়ে গেল। একজন নারী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে এই আন্দোলনকে আপনি কীভাবে  দেখেন?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: আমি আসলে জুলাই অভ্যুত্থানকে অধিকারের লড়াই হিসেবেই দেখি। বিশেষ করে আমার মনে পড়ে, ওই সময় সামান্য কথা বলতেও ভয় পেতাম। বাক স্বাধীনতা মানুষের একটি মৌলিক অধিকার হলেও তা ছিল না। এগুলো আসলে আমাদের মতো তরুণদের ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল। সেই ক্ষোভ থেকেই রাজপথে আন্দোলন করতে নামা। আমি কে, আমার পরিচয় কী, তখন এগুলো খুব একটা ম্যাটার করেনি।

বাসস: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই পড়ালেখা শেষ করে দেশের বাইরে চলে যায় বা ব্যবসায় নেমে পড়ে। পারিবারিকভাবে তাদের আর্থিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভাল হওয়ায় সরকারি চাকরির প্রতি এসব শিক্ষার্থীর আগ্রহ কম থাকে। সেক্ষেত্রে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সাথে তো আপনার যুক্ত হওয়ার কথা না। কিন্তু কেন আপনি  এই আন্দোলনে যুক্ত হলেন সে ব্যাপারে কিছু বলুন।

সানিয়া আমিন স্নিদ্ধা: ওই যে বললাম, আওয়ামী সরকার যেভাবে স্বৈরাচারের মতো জনগনের উপর বসেছিল, সেটা তো সাধারণ জনগণ হিসেবে আমার উপরও প্রভাব বিস্তার করেছিল। এক্ষেত্রে আমি যে বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষার্থী হই না কেন। ফ্যাসিবাদী সরকারের আচরণে আমার মনে হয়েছিল, এই আন্দোলন পাবলিক বা প্রাইভেটের না; এই আন্দোলন বরং আমাদের সবার।

তবে বিশেষ করে যখন নাহিদ-আসিফ-সারজিস ভাইদের (বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওই সময়ের সমন্বয়ক) যখন ডিবি অফিসে তুলে নিয়ে গেল, তখন খুব রাগ হয়েছিল। এভাবে একটা স্বাধীন দেশে যাকে ইচ্ছা তুলে নেয়া যায়? তখন মনে হয়েছিল, ভাইদেরকে মুক্ত করতে হলেও কণ্ঠে আওয়াজ তুলতে হবে।

বাসস: যেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল বন্ধ করা হয়, সেদিন ধরেই নেয়া হয়েছিল, আন্দোলন থেমে যাবে। কিন্তু দেখা গেল পরদিন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমে গেল। সেই স্মৃতি মনে পড়ে কিনা। সে ব্যাপারে কিছু বলুন।

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: ১৮ জুলাই সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির যেসব স্টুডেন্টরা রাস্তায় নেমেছিল, তাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। সেদিনের কথা কখনো ভুলবার নয়। একদিকে ভয়াবহ পরিস্থিতি অন্যদিকে বেদনাদায়ক স্মৃতি।

আমরা খুব একটা পরিকল্পনা করে হাজার হাজার স্টুডেন্ট রাস্তায় নেমেছিলাম তা না; বরং আমাদের মনে হচ্ছিল আন্দোলনে এত মৃত্যুর পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের হল থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে, এভাবে চেয়ে চেয়ে দেখাটা ঠিক না। এমন দম বন্ধ করা পরিস্থিতিতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরও এই আন্দোলনে  পাশে দাঁড়ানো উচিত। যদিও বেশিরভাগ মানুষ মনে করেছিল, প্রাইভেটের স্টুডেন্টরা দেশ নিয়ে ভাবে না।

আমি সকাল সকালই চলে আছি ইউনিভার্সিটির দিকে। আমি যেহেতু কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির স্টুডেন্ট, আর আমাদের পাশের ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাস, সেহেতু আমরা ঠিক করেছিলাম যার যার ক্যাম্পাসের সামনে অবস্থান করব। কিন্তু দ্রুতই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। আমরা দেখতে পাই, আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী হাতে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে আমাদের দিকে আসছে। এরা যে ছাত্রলীগের কর্মী, তা বুঝতে বাকি ছিল না।

সেখানে ছাত্রলীগের হামলার পরপরই পুলিশ গুলি করা শুরু করে। এমন আক্রমণের মুখে আমরা পুরোপুরি ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। আমাদের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, চোখের সামনে রাস্তায় পড়ে আছে অনেক ছেলেমেয়ে। আমি আমরা জীবনে এর আগে কখনও মানুষের রক্ত দেখিনি। সেদিন নিজের চোখে দেখলাম মানুষের রক্ত। আমার ভাই-বোনের রক্ত।

সত্যি বলতে যতটা ভীতি ছড়িয়ে পড়েছিল, ঠিক তার দ্বিগুণ ক্ষোভ ভেতরে ভেতরে জেগে উঠছিল। সবকিছুই সাহসে পরিণত হলো, যখন আমরা খবর পেলাম যে, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থরা আমাদের দিকে আসছে।

থেমে থেমে গোলাগুলি হচ্ছিল। আমরা অনেক সময় গলিতে, বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকে পড়ছিলাম, আবার শব্দ কমে গেলে বের হচ্ছিলাম। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ করেই একসময় প্রচণ্ড চিৎকারের শব্দ পেলাম। মুহুর্মুহু স্লোগান আর চিৎকার শুনে তাকিয়ে দেখলাম, ককটেল বিস্ফোরণের ধোঁয়ার মাঝে হাজার হাজার স্টুডেন্ট ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির দিক থেকে আমাদেরকে বাঁচাতে আসছে।

মুহূর্তেই সব পাল্টে গেল। আমরা প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুতি নিলাম। পুলিশের সামনে দাঁড়িয়ে গেল অনেকেই। পুলিশ সকাল থেকে থেকে এত বেশি রাউন্ড গুলি করেছে যে, পুলিশের গুলি প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল।

বাসস: আমরা দেখেছিলাম সেদিন ছাত্রদের প্রতিরোধের মুখে  একটা ভবনের ছাদে আশ্রয় নেওয়া পুলিশ সদস্যদের হেলিকপ্টার দিয়ে উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনার ব্যাপারে কিছু বলুন।

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: একদম সেই মুহূর্তের কথাই বলছিলাম। পুলিশ এত গুলি করেছিল আমাদের উপর যে, আর তাদের গুলি ছিল না। অপরদিকে ব্র্যাকসহ অন্যান্য ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা আমাদেরকে উদ্ধার করতে আসছিল। তখন আমরা সাহস পেয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। আমাদের ধাওয়া খেয়ে পুলিশ আমাদেরই ক্যাম্পাসে অর্থাৎ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভেতরে ঢুকে পড়ে।

তখন অনেক স্টুডেন্টই ভার্সিটির ভেতরে যাচ্ছিল। কারণ সারাদিন জুড়ে পুলিশ আমাদের উপর যে তান্ডব চালিয়েছিল, তা কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব না। ক্ষোভে সবাই ফেটে পড়ছিল। পুলিশ লুকিয়ে গিয়েও ক্ষান্ত হয়নি। তারা বিল্ডিংয়ের ভেতরে ঢুকেও গুলি করেছে,  ওই সময় শুনেছিলাম অন্য ইউনিভার্সিটির একটা ছেলে পুলিশের গুলিতে মারা গেছে। এই খবর শোনার পর আসলে আমাদের ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটেছিল।

পুলিশ তখন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ছাদে উঠে পড়ে। অনেকেই ক্ষোভে নিচে আগুন জ্বালিয়ে দিতে চাচ্ছিল। যেন পুরো বিল্ডিংটাই জ্বলে যায়। অনেকে আগুন দেয়া থেকে সরে আসে, আবার অনেককে বিরত রাখা হয়। কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় আগুন জ্বলছিল, টিয়ারশেলের গ্যাস থেকে বাঁচতেও আগুন জ্বালানো হয়েছিল। এই আগুন কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভেতরে ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ তখন ছাদ থেকে হাত জোড় করে আত্মসমর্পণ করে।

বাসস: তারপর কী হলো?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: আমাদের ইউনিভার্সিটির পাশেই একটা মসজিদ আছে। পুলিশ মসজিদে গিয়ে ঘোষণা দেয় যে, পুলিশ আর গুলি করবে না। ছাত্ররা যেন সরে যায়। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা আগেই পুলিশ গুলি করে অন্তত দু’জনকে মেরে ফেলেছে, এমন খবর শুনছিলাম। তারপরও আমরা শান্ত ছিলাম।

এদিকে সেখানে থাকা অধিকাংশ পুলিশ কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটির ভেতর ঢুকতে গেলেও তাদের কেউ কেউ বাইরে ছিল। এর মধ্যে দু’জন ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মধ্যে রাস্তায় আহত হয়। আমরা ওই দুই আহত পুলিশকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু পুলিশ আমাদের কী প্রতিদান দিয়েছিল তা তো দেশবাসী দেখেছে।

যাইহোক, পরে পুলিশ ক্ষমা চেয়ে আমাদের সরে যেতে বলে। কিন্তু আমরা রাস্তাতেই বসেছিলাম। তখন একটা হেলিকপ্টার আমাদের ইউনিভার্সিটির ছাদে ল্যান্ড করে এবং সেই পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

বাসস: বাকি দিনগুলোতে আপনি আন্দোলনে কীভাবে অংশ নিয়েছিলেন?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: আমি আসলে তারপর আর বাসায় থাকতে পারিনি।

বাসস: বাসায় থাকতে পারেননি কেন? 

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: সত্যি বলতে তখন ব্লক রেইড চলছিল। রাতের বেলা খুঁজে খুঁজে আন্দোলন করা শিক্ষার্থীদের ঘর থেকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। আমার ভাবলেই অবাক লাগে, কী ভয়াবহ দিনগুলো কাটিয়েছিলাম। সত্যি কথা বলতে ১৮ তারিখের সেই আন্দোলনে আমি খুবই সক্রিয় ছিলাম, আমার অনেক ছবি-ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল। যদিও আমি ভেবেছিলাম ইন্টারনেট বন্ধ থাকার কারণে কারও কাছে ছবি-ভিডিওগুলো যাবে না। কিন্তু রাতেই আমার বাড়ির নিচে সিভিল ড্রেসে উপস্থিত হলো একদল লোক। সে রাতে আমি মা’কে বললাম, কোনভাবেই দরজা খুলবে না। আমি বারান্দা দিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকলাম, ডাকাত আসছে, ডাকাত আসছে। আমি কৌশল করে অন্তত রাতটা ঘরে থাকতে চেয়েছিলাম। আমার ভয় ছিল, রাতেই আমাকে তুলে নিয়ে যাবে। আমার ডাকাত ডাকাত চিৎকারের একটু পর সিভিল ড্রেসের লোকেরা চলে গেল। আমি পরেরদিন সকালেই বাসা থেকে চলে আসি। চলে যাই আত্মগোপনে। আমার মা পর্যন্ত জানতেন না, আমি কোথায় আছি। ফোনে যোগাযোগ হলেও আমি বলতাম না যে, আমি কোথায়। কারণ আওয়ামী লীগ সরকার ফোনে আড়ি পাততো জানতাম।

বাসস: বাসা থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে থাকা অবস্থায় কী করছিলেন?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: কী আর করব, আন্দোলনে যোগ দিলাম।

বাসস: আত্মগোপনে থেকেও আন্দোলন? কোথায় সে সময় ছিলেন?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: আমি আসলে বাসা থেকে বেরিয়ে শাহবাগের দিকে চলে এসেছিলাম। আমার কথা ছিল, এভাবে এত মানুষ হত্যা করার পর এই সরকার কোনভাবেই ক্ষমতায় বসে আমাদের সাথে তামাশা করতে পারে না। যেহেতু বাসায় থাকলে আমার মা ও ছোটভাই বিপদে পড়তে পারতো। তখন মনে হলো, ওরা নিরাপদ থাকুক। আমি আমার জীবন দেয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। কারণ আমাদের আসলে আর কিছু হারানোর ছিল না।

আমি শাহবাগে অনেক মেয়েদের সাথে মিলে রাস্তায় আন্দোলন শুরু করি। ওদের সাথেই বিভিন্ন জায়গায় মুভ করা শুরু করি আবার ওদের সাথেই থাকতাম। যখন কারফিউ শুরু হলো, তখন এক দুই ঘণ্টার জন্য বিরতি দিলে আমরা মিছিল বের করার চেষ্টা করতাম। কী ভয়াবহ দিনগুলো যে গেছে, এখনও ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়।

বাসস: গায়ে কাঁটা দেয় এমন কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলুন।

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: এরকম ঘটনা অনেক। জুলাইয়ের সেই দিনগুলো যেন আমার জীবনের একটা ভয়াবহ অধ্যায়। একবার আমাদেরকে পুলিশের সামনে ছাত্রলীগ ধাওয়া করলে আমরা ঢাকা মেডিকেল কলেজের ভেতরে ঢুকে আশ্রয় নেই। সেখানেও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা এসে অনেক মারধর শুরু করে। সেখান থেকে বেরিয়ে আরেকটা জায়গায় আশ্রয় নেই। এদিকে সন্ধ্যা হলেই ঢাকা শহর তখন ভুতুড়ে শহরের মতো হয়ে যেত। কোন গাড়ি বা মানুষের শব্দ নেই, শুধু মুহুর্মুহু গুলির শব্দ আর শুনশান নীরবতা। সেরকম এক সময়ে আমরা রাস্তায় আটকা পড়েছিলাম। তখন আমি সন্তানসম্ভবা হওয়ার মতো করে জামার ভেতর কাপড় ঢুকিয়ে বন্ধুদের মাঝে শুয়ে পড়ি। আমাকে আমার বন্ধুরা রাস্তা দিয়ে নেয়ার সময় ছাত্রলীগ বলে, ‘তোরা কারা’। প্রতিটা মুহূর্ত মনে হচ্ছিল, এই মনে হয় ধরা পড়ে যাব আর মেরে ফেলবে। তখন মায়ের কথা মনে পড়তো, আম্মু জানতেই পারবে না যে আমি মারা গেছি।

এরকম প্রতিটা দুপুর, প্রতিটা রাত কী যে ভয়াবহ কেটেছে এখন ভাবলেই চমকে উঠি।

বাসস: ৫ আগস্টের স্মৃতি বলুন। যখন শুনলেন আপনারা সফল হয়েছেন, তখন কি বাসায় ফিরে মায়ের সাথে দেখা করলেন?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: সত্যিই বিজয় মিছিল শেষে বিকেল হবার আগেই আমি বাসায় রওনা দেই। আমার মায়ের সাথে বেশ কিছুদিন ধরে দেখা হয় না, তিনি জানেনও না আমি কোথায় আছি। আমার মনে আছে, আমি সন্ধ্যায় দরজা নক করলাম। ঘরে ঢুকে আমার মা’কে জড়িয়ে ধরলাম। তিনি এত কাঁদলেন, মনে হলো আমি নতুন জীবন নিয়ে বাড়ি ফিরেছি।

বাসস: আপনার বাবা আপনাদের ছেড়ে চলে গেছেন বললেন। উনি কোন সালে মারা গেছেন?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: হ্যাঁ, আব্বু ৫ বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।

বাসস: এত বড় একটা অভ্যুত্থানের সঙ্গে আপনি জড়িয়ে গেলেন। আপনার বাবা যদি সাথে থাকতেন, কী ঘটতো?

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা: অভ্যুত্থানের পর ন্যায়ের পক্ষে রাজনীতি করার জন্য আমি এনসিপিতে যোগ দিয়েছি। আমার বাবা সবসময় আমাকে বলতেন, কেউ যদি ন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়ায়, কেউ যদি প্রতিবাদ না করে, তাও তুমি প্রতিবাদ করবা। আমার বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন একদিন স্বৈরাচারের পতন ঘটবে। তিনি দেখে যেতে পারলেন না, তিনি যেই স্বৈরাচারের পতন দেখতে চেয়েছিলেন, তার মেয়ে সেই স্বৈরাচারের পতনের জন্য অভ্যুত্থানে অংশ নিয়েছে।

আমি জানি, আমার বাবা যদি বেঁচে থাকতেন, তিনি আমার পাশে থাকতেন। হয়তোবা জুলাই অভ্যুত্থানে আমি স্লোগান দিতাম, আমার বাবা পাশে থেকে সেই স্লোগানে কণ্ঠ মেলাতেন।

বাসস : আপনাকে ধন্যবাদ।

সানিয়া আমিন স্নিগ্ধা : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বাংলাদেশ আম্পায়ার সৈকতের প্রশংসায় ভোগলে
আগামী জানুয়ারি থেকে সকল ব্যাংকে আরবিএস ব্যবস্থা চালু হবে : কেন্দ্রীয় ব্যাংক
পুতিনের বরখাস্তের কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আত্মহত্যা রাশিয়ার সাবেক মন্ত্রীর: তদন্ত কমিটি
দোহায় পরোক্ষ আলোচনায় বসতে যাচ্ছে ইসরাইল-হামাস
রাজধানীতে ‘শহীদ আনাস সড়ক’ ও ‘শহীদ জুনায়েদ চত্বর’ উদ্বোধন করলেন স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা
‘ইসরাইল আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছিল’: ইরানের প্রেসিডেন্ট পেজেশকিয়ান
কুমিল্লা সীমান্তে ৪৭ লাখ টাকার ভারতীয় শাড়ি জব্দ
মাস সেরার দৌড়ে বাংলাদেশ সিরিজের জয়ের নায়ক নিশাঙ্কা
করোনায় আরো ১১ জন আক্রান্ত
নবম স্থানে উঠল বাংলাদেশ
১০