অর্বাক আদিত্য
ঢাকা, ১০ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণআন্দোলনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বড় ভূমিকা পালন করেছে। তারা আন্দোলনে নামার পর এটি স্কুল, কলেজসহ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এটি আন্দোলনের নতুন গতিপথ তৈরি করেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক হাসিবুল হোসেন শান্ত বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেন।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক হাসিবুল হোসেন শান্ত বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষার্থী। এর আগে ২০১৮ সালে তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন, দুই বছর চাকরি করে তিনি সেনাবাহিনী থেকে ইস্তফা নেন। পরে বেসরকারি নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। বাবা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকায় দেশের রাজনীতি সম্পর্কে তার পরিস্কার জানাবোঝা তৈরি হয়। তিনি নিজের রাজনৈতিক গতিপথ ঠিক করেন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের ফ্যাসিবাদি শাসনের বিপক্ষে নানা সময়ে সরব ছিলেন। তিনি মনে করতেন, একটা বৃহৎ পরিবর্তন জরুরি, যে পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে নতুনভাবে গঠন করা দরকার। জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সেই সুযোগ হাজির হয়। তিনি জীবন বাজি রেখে ঢাকার পূর্বপাশে (যমুনা-বারিধারা-বাড্ডা) শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। জুলাই অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে বাসসের বিশেষ আয়োজনে এক সাক্ষাৎকারে সেই আন্দোলনে তার প্রত্যক্ষ বিবরণ তুলে ধরেন।
বাসস : প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমরা তেমনভাবে গণআন্দোলনে দেখতে পাই না। ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার বা কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর কোনো মুভমেন্টে সচরাচর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টুডেন্টদের উপস্থিতি খুবই কম। কিন্তু জুলাই মুভমেন্টে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখলো। আপনারা কী হঠাৎ করেই আন্দোলনে যুক্ত হলেন?
শান্ত : ২০২৪ এর কোটাবিরোধী মুভমেন্ট প্রাথমিকভাবে শুরু হয়েছে জুনে। আর সেইটা বড় আকারে মুভমেন্ট হিসেবে হাজির হলো জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে। মূলত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ হামলা করলো, সেদিনই এই মুভমেন্ট ঢাবি বা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো। এটা সত্যি যে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজনৈতিক একটিভিজম নেই। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ রাজনীতি করবে এমন ইন্টেনশনও থাকে না। রাজনীতি নিয়ে চিন্তা করা মানুষজন প্রাইভেটে খুবই কম। বাস্তবতা এটাই। তবে এটার চর্চা হয় না বলে যে পলিটিক্যাল এওয়ারনেস নেই, এটা না। এই আন্দোলনে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়েই সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখলো। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নামার পর এটি স্কুল, কলেজসহ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এটি আন্দোলনের নতুন গতিপথ তৈরি করেছে। ১৪ জুলাই যখন শেখ হাসিনা কোটা আন্দোলনকারীদের রাজাকার বললেন; তার প্রতিক্রিয়া দেখানো হলো সারাদেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আমরা স্যোশাল মিডিয়াতে তা দেখলাম। ওইদিন আমরাও এটার প্রতিবাদ জানালাম সবাই ব্যক্তিগত পরিসরে। আমি ফেসবুকে লিখলাম, ‘১৮ কোটি মানুষের সাথে রাজাকার হওয়া গর্বের।’ একই সময়ে আমাদের বিভিন্ন গ্রুপেও ডিসকাশন হচ্ছে যে, আমরা আন্দোলনে যুক্ত হবো কিনা। পরদিন ১৫ তারিখ আমরা ক্যাম্পাসে এলাম। এসে ৮ নম্বর গেইটে দাঁড়ালাম। দাঁড়ানোর পরে কিছু আর্টপেপার কিনলাম, কিছু প্ল্যাকার্ড বানালাম। ৬০-৭০ জনের মত ছিলাম। তারপর আরও কিছু লোকজন যুক্ত হলে আমরা যমুনার (যমুনা ফিউচার পার্ক) দিকে মুভ করলাম। সেখানে দুই ঘণ্টা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করে, কর্মসূচি শেষ করি। এরপরে আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে যাই ঢাবি ক্যাম্পাসে। তার আগে আমার এক মিডিয়ার বন্ধুর কাছে সার্জিস ভাইয়ের ফোন নম্বর নিই। সেখানে গিয়ে দেখি সংঘর্ষ চলছে। ভিসি চত্বরে তখন হামলা, আমরা চলে যাই রাজু ভাস্কর্যের দিকে। সেখানে গিয়ে ফোন দিই সার্জিস ভাইকে। সেখান থেকে আহতদের সাহায্য করার জন্য চলে যাই ঢামেকে।
বাসস : আপনার পরিবার অ্যালাউ করলো? প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তো প্রিভিলিজ ফ্যামিলি থেকে আসা। পরিবার তো আপনাদের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকে।
শান্ত : আব্বা জানেন, মানা করে কোনো লাভ নাই। আমার বাবা বিএনপির রাজনীতি করেন। তবে আমাকে তেমনভাবে এই গতানুগতিক রাজনৈতিক দলগুলো টানেনি। আমি কোনো রাজনীতিতে যুক্ত হইনি। তবে নানা সময়ে সরকারের সমালোচনা করেছি। আমি আর্মিতে ছিলাম দুই বছর। প্রশিক্ষণ নিয়েছি। সেখান থেকে পরে চাকরি ছেড়ে চলে আসি। আসার পর নর্থ সাউথে ভর্ভি হই। তবে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা আমার আগে থেকেই ছিল। ডামি নির্বাচনের পরে আমি ইসি ভবনে তালা মারতে গেছিলাম; বড় একটা তালা নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কিছু শুভাকাঙ্ক্ষির কারণে তালা মারা হয়নি। তারা বলছিলেন, ঝামেলা খুব বেশি হবে। এটা করা এখন ঠিক হবে না।
তো আব্বা বললেন, যেন সাবধানে থাকি। যমুনার সামনে একটা জ্বালাময়ী বক্তব্য দেই, এ কারণে আমার গ্রামের বাড়িতে পুলিশ যায়। সেখানে খোঁজখবর নেয়। পরে বসুন্ধরার বাসাতেও পুলিশ আসে। সার্চ করছিল। সেসময় আমি আমার ফোন অফ রাখি। আর পাশের এক পরিচিত বাসায় যাই। ভিপিএন ব্যবহার করে ম্যাসেনজার আর হোয়াটসআপ গ্রুপগুলোতে একটিভ থাকি। আমাদের মেসেঞ্জার গ্রুপ ছিল দুই তিনটা। সম্মিলিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা কমন প্লাটফর্ম ছিল, সেখানে চল্লিশ পঞ্চাশ জনের মত ছিলাম ওই সময়। ওই গ্রুপটাকে আমরা প্রতিনিধি গ্রুপ হিসেবে ব্যবহার করি। সবার সাথে সমন্বয় করা হতো এটাতে। ১৬ তারিখ সারাদেশে ৬ জন মারা যাওয়ার পর আন্দোলন নিয়ে সবাই আরও বেশি একটিভ হওয়ার আগ্রহ দেখায়। ওইদিন যমুনার সামনে একটা প্রোগ্রামে বলি, ‘ছাত্র সমাজ উত্তপ্ত আগুন। আগুন নিয়ে খেলবেন না। এর পরিণতি ভালো হবো না।’ এরকম একটা কথা বলি। ১৬ তারিখের কর্মসূচি শেষে আলাদা করে আর কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করিনি। আমরা বলে দিই যে, সতেরো তারিখ আমরা সবাই টিএসসিতে যাব। ১৭ তারিখ ছিল গায়েবানা জানাজার প্রোগ্রাম। ১৭ তারিখ নর্থ সাউথে কয়েকজন মোমবাতি প্রজ্বলন করেন। আর আমরা যাই টিএসসিতে।
বাসস : রাস্তায় যেতে কোনো অসুবিধা হয়নি?
শান্ত : হয়েছে। আমরা যখন শাহবাগে পৌঁছলাম, দেখি সবার হাতে লাঠিসোটা, পাশে পুলিশ। তার মানে এরা ছাত্রলীগ-যুবলীগের। আমার কোনোমতে সেই জটলা কাটিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকি। প্রথমে শহীদ মিনারে যাই সেখান থেকে রাজু ভাস্কর্যের দিকে। তখন মল চত্বরে পাল্টাপাল্টি হামলা চলছিল। ছাত্ররা হামলা প্রতিরোধ করে। আমরাও সেখানে জয়েন করি। টিআরসেল মারা হয় সেখানে, চোখ জ্বালাপোড়া করছে অনেকের। আমরা আশপাশের ডাস্ট দিয়ে আগুন জ্বালালাম। একপর্যায়ে দেখি হান্নান ভাইকে (আবদুল হান্নান মাসউদ) নিয়ে আসা হলো, তিনি বেশ আহত। তার শরীরে বিভিন্ন জায়গায় রক্তের ছিঁটা। তাকে নিয়ে যে হাসপাতালে মুভ করবো এমন কোনো অবস্থা নাই। মেইন রোড পুরো রণক্ষেত্র। আমরা তখন কয়েকজন মিলে জিয়া হলের পাশে যে পকেট গেইট আছে, সেখান দিয়ে হান্নান ভাইকে হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করি। সেখানে বের হতে গিয়েও হামলার শিকার হই। হামলাকারীরা বড় বড় ইটের খোয়া মারছিল। উপায় না পেয়ে আমরা ওইখান থেকে সবাই আবার ফিরে আসি। ফিরে বিজয় একাত্তর হলের সামনে ঘাসের একটা জায়গা আছে ওইখানে শোয়াই। কিছুক্ষণ পর একটা রিকশা আসে বিরিয়ানি নিয়ে, ওই রিকশাতে করে হান্নান ভাইকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। ওইদিন আমরা প্রায় সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ঢাবিতে থাকি। তখন সার্জিস ভাইকে ফোন দেই। তাকে বলি ভাই, আপনারা চিন্তা করবেন না, আগামীকাল ঢাকার পূর্বপাশ আমরা অচল করে রাখবো। আপনারা আন্দোলন কন্টিনিউ করেন। পূর্বপাশটা কীভাবে অচল রাখতে হয়, সেইটা আমরা দেখতেছি। সেই কল রেকর্ড এখনো আছে আমার কাছে। আমাদের টার্গেট একদফার দিকে যেতে হবে। মানুষ খুন করে কেউ ক্ষমতায় থাকার আর কোনো অধিকার রাখে না। আমরা কোনো নেগোসিয়েশনে যাবো না।
বাসস : তারপর বাসায় ফিরলেন?
শান্ত : হুম। ওইদিন বাসায় ফিরে সবার সাথে আলোচনা করে কর্মসূচি ঠিক করে ৯ মিনিটের একটা ভিডিও করি। সেইটা আপলোড করি। ওইদিনই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপটাতে একটা বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছিল। সবাই বলছিল, আমরা প্রাইভেটের স্টুডেন্টরা রামপুরার দিকে একটা জায়গায় ব্লকেড করবো। আমি বললাম, একটা জায়গায় করার চেয়ে আমরা যদি কয়েকটা জায়গায় আলাদা আলাদাভাবে ব্লকেড করতে পারি তাহলে এর ইমপ্যাক্ট বেশি পড়বে। আমরা কতজন মিলে ব্লকেড করলাম, তার থেকেও বড় ঘটনা কতটা জায়গায় ব্লকেড হলো। যতবেশি জায়গায় ছড়াইতে পারব বিষয়টা ততবেশি সরকারের জন্য অ্যালার্মিং। সুতরাং আমরা যদি ফলপ্রসূ কিছু করতে চাই তাহলে আমাদের এটাকে আরো ছড়িয়ে দেয়া লাগবে।
বাসস : কি সিদ্ধান্ত হলো?
শান্ত : আমরা যার যার প্রতিষ্ঠানের সামনে ব্লকেড কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নিই। ১৮ তারিখ সকালে আমরা নর্থ সাউথের সামনে যাই। সেখানে পুলিশ আসে, তাদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা হয়। পুলিশ বলে, যদি আমরা আজ মুভ করি তাহলে তারা গুলি চালাবে। তাদের কিছু করার থাকবে না। আমি ছাত্রদের বলি, আমরা পুলিশকে ভয় পাই না। যদি গুলি চালায়, আমি প্রথম গুলি খাবো। মুভ করে আমরা যমুনার সামনে অবস্থান নিলাম, সেখানে ববি হাজ্জাজ স্যারও আমাদের সাথে যুক্ত হলেন। ববি স্যার আমাদের নর্থ সাউথের শিক্ষকও। সেখানে নাগরিক সমাজের আরও অনেকে আমাদের সাথে যুক্ত হলেন। সেখানে আমাদের কাছে খবর এলো ব্র্যাকের সামনে ছাত্রদের ওপর হামলা করা হচ্ছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, মিছিল নিয়ে ব্র্যাকের দিকে মুভ করবো। আমরা নতুনবাজারে পৌঁছানোর সাথে সাথে ইউআইও, ইউআইটিএস, প্রেসিডেন্ট ইউনিভার্সিটি ওরাও যুক্ত হলো আমাদের সাথে। ওরা এতক্ষণ মেইন রোডে উঠতে পারেনি, পুলিশের বাধার মুখে ছিল। আমাদের মিছিল দেখে তারা উচ্ছ্বাসের সাথে যুক্ত হয়। সেইসময় আমাদের মিছিলে প্রায় ১৫ হাজারের বেশি মানুষ। আমরা জাস্ট নতুনবাজার ক্রস করে বাঁশতলায় পৌঁছাই, তখনই আমাদের ওপর ফায়ার শুরু হয়। টিআরশেল ছোঁড়া হয়। আমি বেশ ঘাবড়ে যাই, কারণ আমাদের মিছিলে স্কুল কলেজের ছোট ছোট বাচ্চারাও ছিল। ওরা মেক্সিমাম বসুন্ধরার পোলাপান। ওরা শারীরিকভাবে ওইভাবে এমন পরিস্থিতি ট্যাকল করার মতো ক্যাপাবল না। আমাদের যে স্ট্রং মেন্টালিটি এদের এ রকম নাই। সুতরাং আমি চাচ্ছিলাম না কোনোভাবেই এদের এরূপ ভয়াবহতার মধ্য ঠেলে দিতে। তারপরও পাল্টা প্রতিরোধ শুরু হয়। একটা পর্যায়ে আমি উত্তর বাড্ডার কাছে রাস্তায় পড়ে যাই, বুঝতে পারছিলাম, আমার কপালে ইট পড়েছে। হঠাৎ মনে হলো সবকিছু একদম স্তব্ধ হয়ে গেছে। একটা দোকানের সাটারের কাছে যাই। সেখানে গিয়ে সার্জিস ভাইকে ফোন দিই, তাকে পরিস্থিতি জানায়ে বলি, আমরা কী ফিরে যাবো কিনা? তিনি বলেন, ‘পুলিশের উদ্দেশ্য ছত্রভঙ্গ করা। তোরা ভয় পাস না। তোরা হাত তুলে পুলিশকে বল, যেন তারা কোনো গুলি না চালায়।’ সেসময় রাস্তায় চারদিকে রক্ত ছড়ায়ে ছিটায়ে। শতশত আহত। যেহেতু এর লিডটা দিচ্ছিলাম, আমার দায়বদ্ধতাও আছে ওই জায়গায়। আমি তখনও একটা সাটারের সাথে হেলান দিয়ে জাস্ট স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করছি। রিকশায় একটা মাইকে আমরা স্লোগান দিচ্ছিলাম, দেখছি চারপাশে ইটের আধলা পড়ে আছে, রিকশাঅলা রিকশা ছেড়ে গেছেন। মাইকসহ রিকশাটা রাস্তার মাঝখানে। ভয়াবহ অবস্থা। আমাদের আরেকজন শিক্ষার্থী রিকশাটার প্যাডেল ধরে। ও চালায়। আমি মাইকটা নিয়ে পুলিশের উদ্দেশে বলি, আপনারা গুলি করবেন না। আমরা আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই। একটা পর্যায়ে আমরা সামনে মুভ করতে সক্ষম হই। আমরা সাবাই মিলে মুভ করলে পুলিশ কোণঠাসা হয়ে কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটিতে আশ্রয় নেয়। তারপর আহতদের নিয়ে আমরা মুভ করি আইইউবির ইমার্জেন্সিতে। ওইখানে অলরেডি আইইউবির অনেক শিক্ষার্থী। এক দুজন হলে তাও সামাল দেওয়া যায়। কিন্তু শত শত আহত। বিপর্যস্ত অবস্থা। একদিকে আতঙ্ক, অন্যদিকে আহতরা আসতেই আছে। কী বলবো, এটা আসলে ভাষায় ব্যাখ্যা করা কঠিন। প্রাথমিক ট্রিটমেন্ট নিয়ে আইইউবি থেকে বের হয়ে রিকশা খুঁজতেছিলাম। এমন সময় লাঠিসোটা হাতে তিন চারজন আসে। তারা ছাত্রলীগের। তারা আমাকে মার্ক করেছিল। আমি তাদের দেখে আবার আইইউবির মধ্যে ঢুকে যাই। পরে আইইবির উত্তর পাশের গেইট দিয়ে বাসায় চলে আসি। এসে নেট ওপেন করে দেখি পুরো বিভীষিকা। গ্রুপগুলোতে মেসেজ করে অনেকে কান্নাকাটি করছিল, জানাচ্ছিল তাদের সাথে কী হয়েছে। আমার নিজের খুব গিল্টি ফিল হয়। কারণ আমি বলছিলাম, আজকে যদি গুলি হয়, প্রথমে আমি খাব। অথচ আমি গুলি খাইনি, আহত হয়েছি। সিদ্ধান্ত নিলাম পিছু হটার কোনো সুযোগ আর নাই। আমাদের যে করেই হোক এক দফার দিকে যেতে হবে।
বাসস : এরপর কী করলেন?
শান্ত : ১৯ তারিখ কারফিউ দিলো। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম কারফিউ ভাঙবো। এরমধ্যে আমরা কিছু ফান্ড কালেক্ট করলাম। তারপর গুরুতর আহতদের পরিবারের সাথে যোগাযোগ করে ২০ হাজার ২৫ হাজার করে পাঠিয়ে দিলাম। ১৯ তারিখ যমুনার (ফিউচার পার্ক) সামনে অবস্থান নিলাম। ৯টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত সেখানে থাকি। সেদিন আমাদের ওপর হেলিকপ্টর থেকে ফায়ার করা হয়। সেদিন আমি সংবিধানের পরিবর্তন নিয়ে আর আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিয়ে কথা বলি। স্বাধীন কমিশনের দাবি জানাই। সন্ধ্যার দিকে ক্যাম্পাসে ফিরে শুনি, বাবুল কমিশনার আমাদের ছাত্রদের ওপর হামলা চালিয়েছে। কিন্তু সেখানে যাওয়ার অবস্থা ছিল না। তখন আমি সেখানে যারা ছিল তাদের বলি, আহতদের এভায়কেয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসার জন্য। সেখানে আমাদের যাওয়ার খবর পেয়ে পুলিশ খুঁজতে বারবার যায়, পুলিশ যখনই যায় তখনই আমরা অন্য ফ্লোরে চলে যাই। সেখান থেকে রাত একটার দিকে বের হয়ে বাসায় যাওয়ার চিন্তা করি। কিন্তু বাসা নিরাপদ হবে না ভেবে আমার বাসার পাশের রোডের একটা বাসায় যাই। ওই বাসাতে আমরা ১৯ তারিখ থেকে ২৪ তারিখ পর্যন্ত অবস্থান করি। ওই সময়টাতে নেট নেই। আমরা গ্রাফিতি আর টুকটাক কর্মসূচি করি। ফোনে যোগাযোগ করি অন্যদের সাথে।
বাসস : পরে কী হলো..
শান্ত : আমরা সিদ্ধান্ত নেই- মিডিয়া ব্রিফ করবো। এভাবে লুকিয়ে থাকা আর ভালো লাগছে না। সেসময় ব্লক রেইড দিচ্ছিলো পুলিশ। আর আমাদের প্রোগ্রাম বলতে তখন শুধু গায়েবানা জানাজা করা। এসব কর্মসূচির খুব বেশি ইম্প্যাক্ট ছিল না। আমরা প্রেস ব্রিফিং করলাম। কিন্তু সেসবের কোনো কাভারেজ হলো না। হালকা কয়েক সেকেন্ডের ফুটেজ দেখাতো, তাও কী বলছি, সেগুলো আসতো না। ওই সময়ে ৯ দফা দেওয়া হলো। পরে আরেকটা প্রেস কনফারেন্স করি নিউজ ২৪ এর অফিসের পাশে। ওইদিন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন উপস্থিত ছিল। কনফারেন্সে আমরা ৯ দফা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করি। আর মানুষকে রাস্তায় নেমে আসার আহ্বান জানাই।
২৫ তারিখ নর্থ সাউথের আট নম্বর গেটের দিকে গ্রাফিতি করতে গেলে পুলিশ ধাওয়া করে। পরদিন ২৬ তারিখ সাদা পোশাকে প্রশাসনের লোকজন আসে আমাদের ধরতে। আমরা ক্যাম্পাসে অবস্থান নিই। সেদিন আমাদের ধরিয়ে দিতে নর্থ সাউথ কর্তৃপক্ষকে প্রেসার দেওয়া হয়। সে সময় আমি সাউট করে বলি, আমাদের যদি ধরিয়ে দেওয়ার কোনো পায়তারা করা হয়, তাহলে এখানে লাশ পড়বে।
২৭ তারিখে সার্জিস ভাইয়ের সাথে কথা বলি। এরপরেই অনলাইনে দেখি সার্জিস ভাইকে তুলে নেওয়া হয়েছে। এরপরেই আমি ফোন বন্ধ করে দেই। সেদিনই আমার ল’য়ের বান্ধবি নাফিসাকে তুলে নিয়ে যায় ডিবি, বিকজ অব মি। কারণ আন্দোলনের সময় প্রায় ২৭-১৮ বার তার সাথে কথা হয়। নাফিসার কাছে আমার বাসার লোকেশন জানতে চায় ডিবি। আমি তখন বসুন্ধরা ছাড়ার প্ল্যান করি। ২৭ তারিখ রাত্রে বাসা ছেড়ে এক কাকার বাসায় যাই। আমাদের লাইফ তখন চরম রিস্কে। রাত তখন ১১টা। কাকার বাসায় জায়গা দিতে অসম্মতি জানায়। পরে আমার আরেক কাজিনের বাসায় যাই। ভোর ৪টা পর্যন্ত ওর বাসায় ফোন অফ করে কোনো রকমে রাতটা কাটায়ে ভোর ৬টার দিকে উবার নিয়ে চলে গেলাম পুরান ঢাকার রায়ের বাজার, বেড়িবাঁধের কাছে।
বাসস : তখনও কী অন্যদের সাথে কানেক্টেড ছিলেন?
শান্ত : হ্যাঁ। আমাদের নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করে তখন আমরাও কর্মসূচি ঘোষণা করতেছি। ২৮ তারিখ আমাদের শিক্ষকরা আমাদের সাথে সংহতি জানায়। বেশ কয়েকজনকে তুলেও নিয়ে যাওয়া হয়। ১ তারিখে আমরা নর্থ সাউথের ১ নম্বর গেটে বিক্ষোভ কর্মসূচি দেই। সেদিন পুলিশ খুব একটা বাধা দেয় না, আমরা এক ঘণ্টার মতো কর্মসূচি পালন করে শেষ করি।
দুই তারিখে আমরা যমুনা গেইটের সামনে একত্রিত হলাম। তখন একটা বক্তব্য দেই সাড়ে তিন মিনিটের। সকল শ্রেণি-পেশার মানুষকে রাস্তায় নামার আহ্বান জানাই। হাসিনার সরকারকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করি জনতার মঞ্চের পক্ষ থেকে। প্রত্যেক বাহিনী প্রধানকে আমাদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করার আহ্বান জানাই। তিন তারিখে আমরা শহীদ মিনারে যাই। ওখানে নাহিদ (নাহিদ ইসলাম) ভাই এক দফার ঘোষণা দেন। ওইদিন এ পর্যন্তই। পরদিন মানে ৪ তারিখ আমরা অসহযোগ কর্মসূচির সমর্থনে নর্থ সাউথের এক নম্বর গেইটে অবস্থান নিই। ওইদিন অসংখ্য মানুষ আমাদের সাথে যুক্ত হন। কেউ খাবার কিনে এনে দেন, কেউ পানি, কেউ খাওয়ার জন্য পিঠা বানাইছেন, সেগুলো না খেয়ে আমাদের জন্য নিয়ে আসেন।
বাসস : পাঁচ তারিখ কী করলেন?
শান্ত : চার তারিখ রাতে তো কোনো ঘুম হলো না। সকালে (৫ আগস্ট) আমরা নর্থ সাউথের এক নম্বর গেইটে জড়ো হতে শুরু করি। সেখানে ৭০ জনের মতো ছিলাম। সেসময় নাফসিন আজরিন এগিয়ে যেতে শুরু করলে পুলিশ হামলা চালায়। একই সময় খবর পাই ছাত্রলীগ-যুবলীগ আর আওয়ামী লীগের লোকজন কয়েকটা লেয়ারে জড়ো হচ্ছে আমাদের ওপর হামলা করবে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম সত্যি। তারা বেশ সজ্জিত হয়ে আছে। তারা হামলা চালাবেই। এরমধ্যেই আমাদের এলাকায় গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, নাহিদ ভাইকে (নাহিদ ইসলাম) হেডশ্যুট করে মেরে ফেলা হয়েছে। গুজব তোলা হয় নাহিদকে মেরে ফেলা হয়েছে। তার মানে আমরা নেতৃত্বশূন্য। সার্জিস ভাইদের তখন ফোনে পাচ্ছিলাম না। আমরা কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। এরমধ্যেই খবর পাই উত্তরা থেকে একটা বিশাল মিছিল আসছে। আমরা প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি, গ্রিন ইউনিভার্সিটি এবং আশপাশের সব ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা একসাথে ছিলাম। সেদিনও ব্যাপক হামলা চালানো হয়। এর মধ্যে খবর আসে সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন। এই ঘোষণা জানার পরেই পুলিশ চলে যায় শুধু সেনাবাহিনী থাকে। তারা আমাদের সাথে একাত্ম ঘোষণা করে। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে গণভবনে যাই।
বাসস : নতুন বাংলাদেশকে আপনারা কীভাবে সাজাতে চান?
শান্ত : ৫ তারিখের পরবর্তী সময়ে সরকার গঠন হলো। তখন আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। শুধু আমাদের ডাকা হয়েছে সরকার যেদিন শপথ নেবে, সেদিন। আমরা নিয়মতান্ত্রিক একটা দেশ চাই। বাংলাদেশের সমস্যাগুলো আমরা জানি। কিন্তু সমাধানের পথে আমরা কেউ এগোই না। পুরোনো সেই পলিটিক্যাল কাল্টকেই টিকিয়ে রাখি। এই যে দুর্নীতি হয়, টাকা পাচার হয় আরও যা যা অপরাধ হয়, এগুলো কী একক কোনো ব্যক্তির কাজ? লুট হয়, কীভাবে হয়। আমাদের সহযোগিতা ছাড়াই হয়? তারপরে এই যে পাওয়ার অ্যাক্সেসের জায়গা; মূলত এটাতে লিমিটেশন টানতে হবে। রাজনীতিবিদরা দায়িত্বকে প্রায়োরিটি দিক, ক্ষমতাকে নয়। ক্ষমতা আমাদের ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করে। আমরা চাই, কোনো ক্ষমতাই কোনো ব্যবস্থাকে প্রভাবিত করতে পারবে না। আর আইন? যারা ওই ক্ষমতায় বসে তাদের একটা ফোন কলেই আইন। এগুলো পরিবর্তন করতে না পারলে আমরা আসলে নতুন বাংলাদেশ গড়তে পারবো না।