আল সাদী ভূঁইয়া
ঢাকা, ১৩ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সরাসরি অংশগ্রহণকারী বামপন্থী ছাত্রনেতাদের একজন হলেন বিপ্লবী ছাত্রমৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা। কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকে শুরু করে সরকার পতনের রূপ নেওয়া গণঅভ্যুত্থানের নানা ঘটনা প্রবাহের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষার্থী।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসের বিশেষ আয়োজন ‘জলাই জাগরণ’ এর মুখোমুখি হয়ে আন্দোলনে অংশগ্রহণ, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন রাশা। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বাসসের প্রতিবেদক আল সাদী ভূঁইয়া।
বাসস : কখন আপনি কোটা সংস্কার আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন?
নূজিয়া হাসিন রাশা : আমি শুরু থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে ছিলাম। ওই সময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারতকে একপাক্ষিক করিডোর দেওয়ার আলোচনা চলছিল। এর প্রতিবাদে আমরা গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের ব্যানারে মিছিল করি, সে সময় হাইকোর্ট মোড়ে পুলিশের সঙ্গে আমাদের ধস্তাধস্তি হয়। সেখান থেকে ক্যাম্পাসে ফিরে দেখি কোটা সংস্কারের দাবিতে সেন্ট্রাল লাইব্রেরি থেকে একটি মিছিল বের হচ্ছে। আমি ও আমার সহযোদ্ধারা এতে যোগ দিই। ঈদের ছুটি শুরু হওয়ায় তখন অনলাইনে আন্দোলনের প্রচারণা চালানো হয় এবং ৩০ জুনের মধ্যে দাবি মানার জন্য সরকারকে আল্টিমেটাম দেওয়া হয়।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলন কীভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল? আপনার অভিজ্ঞতা থেকে বলুন।
নূজিয়া হাসিন রাশা : ৩০ জুন আল্টিমেটাম শেষে ১ জুলাই সবাই মাঠে নামে। ঈদের ছুটির পরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও একটি আন্দোলনে ছিলেন। যার ফলে ক্লাস-পরীক্ষা শুরু হতে পারেনি। শিক্ষার্থীরা রাজপথে নামলে আন্দোলনটা ক্রমেই জোরদার হতে থাকে। প্রতিদিনই মিছিলে লোক বাড়তে থাকে। নারীদের হল থেকে বড় মিছিল এসে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে জড়ো হতো। আমরা লাইব্রেরি থেকে মিছিল নিয়ে শাহবাগ পর্যন্ত যেতাম। ধীরে ধীরে মিছিলের পথ বাড়তে থাকে। কর্মসূচির ধরনেও পরিবর্তন আসে। শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি পালন হতে থাকে। অবস্থান থেকে ব্লকেডের দিকে যায় কর্মসূচি। ওই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। আমরা কী করবো, কীভাবে করবো, কখন করবো সেটি নিয়ে প্রতিদিন ব্রিফ হতো। আমি ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর থেকে সিট সংকট ও মতাদর্শিক বিরোধের কারণে কখনো হলে সিট পাইনি। হলে না থাকায় আমি হলের সমন্বয়কের কাজে ছিলাম না। কিন্তু অন্যান্য হলে থাকা আমার সহযোদ্ধারা সেখানে ছিল। সেখানে আন্দোলন নিয়ে আলোচনা হতো। একদিন আমরা কোটা সংস্কার আন্দোলনের মিছিল নিয়ে লাইব্রেরির সামনে থেকে শাহবাগের দিকে যাচ্ছিলাম। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টির মধ্যেও সেদিন অনেক বড় জমায়েত হলো। সেদিন মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় মধুর ক্যান্টিনের সামনে ছাত্রলীগকে মহড়া দিতে দেখা যায়। এ সময় ক্যাম্পাসে এমন একটা পরিস্থিতি বিরাজ করছিল, কোটা আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হলেই ছাত্রলীগ কোনো না কোনো কর্মসূচি দিত। আমরা যখন মিছিল নিয়ে মধুর ক্যান্টিনের সামনে দিয়ে যেতাম, তখন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ভুয়া ভুয়া স্লোগান দিতো। আমরাও পালটা স্লোগান দিতাম। এ সময় টানটান উত্তেজনাকর অবস্থার সৃষ্টি হতো। এরমধ্য দিয়ে আমরা শাহবাগে মিছিল নিয়ে যেতাম। হলপাড়ায় গিয়ে মাইকিং করে বাকিদের মিছিলে যুক্ত হওয়ার আহ্বান জানানো হতো।
বাসস : ২০২৪ সালের ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। শেখ হাসিনার ওই মন্তব্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেমন প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল?
নূজিয়া হাসিন রাশা : ১৪ তারিখে এক প্রেস বিফ্রিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ হাসিনা বলেন আমরা কোটা কাকে দেব? মুক্তিযোদ্ধার নাতিপুতিদের দেব না তো রাজাকারের নাতিপুতিদের দেব? এতে শিক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়। কোটা সংস্কার আন্দোলন মূলত বিগত কয়েকদিনে গড়ে উঠা আন্দোলন না। এ আন্দোলন ছিল বিগত ১৫-১৬ বছর ধরে ফ্যাসিস্ট সরকারের প্রতি মানুষের যে ঘৃণা জমেছিল, তার প্রতিফলন। আমাদের জেনারেশন দেখে এসেছে প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে হাসিনা সরকার দমনপীড়ন করতো। তাই অনেকটা ব্যক্তিগত আক্রোশের জায়গা থেকে মিছিলে নানা শ্রেণি-পেশা ও বয়সের মানুষ অংশ নিতো। ১৪ তারিখ রাতে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিয়েছিল, ‘তুমি কে আমি কে? রাজাকার রাজাকার, কে বলেছে কে বলেছে, স্বৈরাচার স্বৈরাচার’। নিজেদের ‘রাজাকার’ বলে হাসিনার বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছিল শিক্ষার্থীরা। এটাকে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে নিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষের শক্তি এবং আন্দোলনকারীদের রাজাকারের দোসর বলে বিগত সকল আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার এক ন্যাক্কারজনক অপপ্রচেষ্টা চালাতো আওয়ামী সরকার। সেদিন রাতে আমাদের মনোভাব ছিল ‘নে তোরা যা বলার বল। সবাইকে রাজাকার বললে এখন এই রাজাকাররা তোর বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে।’ এটি ছিল প্রতিবাদের ভাষা। স্বৈরাচার আমাদের রাজাকার বলে দমন করতে পারবেনা, এই বার্তা স্লোগানে স্পষ্ট ছিল। সেদিন রাতে আমরা ফেসবুকে দেখলাম শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন হলে স্লোগান দিচ্ছে। আমি বাসায় চলে আসলেও রাতের বেলা আবার ক্যাম্পাসে যাই। তখন ক্যাম্পাসে অনেক সংগঠনের নেতারা ও সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। তখন আমরা আলোচনা করছিলাম, সরকার এই আন্দোলনটাকে বানচাল করার জন্য এই স্লোগানের আধাখেঁচড়া রূপ সামনে এনে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করবে। তারা মিডিয়ার মাধ্যমে ন্যারেটিভটা দেখাবে যে, তারা এতদিন যেটা বলেছিল, জামায়াত-শিবিরের একটা ইন্ধন আছে, ঠিক সে রকমই ঘটছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, সেটা হতে দেওয়া যাবে না। সেদিন রাতে দেখি শাসসুন্নাহার হলের মেয়েরা তালা ভেঙ্গে বের হয়ে এসেছে। তারা থালা-বাসন পেটাতে পেটাতে রাজুতে আসে। তখন আমরা ‘রাজাকার, রাজাকার’ স্লোগানটার পাশাপাশি অন্যান্য আরো কিছু স্লোগান এড করে ছিলাম। যেমন— ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজকার’ ইত্যাদি। কিন্তু হল থেকে আনা মিছিলের নেতৃত্বে ছিল সমন্বয়করা। তারা স্লোগানগুলো মনে রাখতে পারছিল না। আমাদের হাতে মাইক না থাকায় খালি গলায় যতটুকু বোঝানো যায়, চিল্লায়ে স্পষ্ট করতে চাচ্ছিলাম। আমার সংগঠনের সেক্রেটারি জাবির আহমেদ জুবেল, বারবার রাজুর পাদদেশে দাঁড়িয়ে হাত উঁচিয়ে খালি গলায় চিৎকার করে বলেছিল, ‘আপু আমরা সবাই পুরো স্লোগানটা দেই, তা না হলে আমাদের আন্দোলন সাবোটাজ করার চেষ্টা করবে সরকার’। ক্রমান্বয়ে মেয়েদের অন্যান্য হল থেকে মিছিল আসে। ছেলেদের হল থেকে মিছিল এসে ভিসি চত্বরে জড়ো হতে থাকে। পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হলো, আমরা মেয়েদের জমায়েত নিয়ে রাজু ভাস্কর্য থেকে ভিসি চত্বরের দিকে যাব। সেখানে যেয়ে দেখি, ভিসির বাসভবনের সামনে ততক্ষণে হলপাড়া থেকে একটি মিছিল আসে। তখনো সম্পূর্ণ স্লোগানটা অনেকে ধরতে পারছিল না। তারপর শামসুন্নাহার হলের সহ-সমন্বয়ক ইসরাত জাহান ইমু খালি গলায় স্লোগান দেওয়া শুরু করে, যেহেতু হ্যান্ড মাইকের সংকট ছিল। আমিও অনেক মানুষের মধ্যে দিয়ে মাঝখানে যাই। সেখানে গিয়ে আমি স্লোগান ধরা শুরু করি। পরবর্তীতে খবর পেলাম- ক্যাম্পাসের প্রবেশ পথগুলোতে ছাত্রলীগের বহিরাগত সন্ত্রাসীরা বাইক, দেশীয় অস্ত্র, হেলমেট নিয়ে অবস্থান নিয়েছে। আমাদের প্রাথমিক সিদ্ধান্ত ছিল, আমরা ক্যাম্পাসেই অবস্থান করব। সবাই ইট পাটকেল সংগ্রহ করা শুরু করলাম। রাত একটা-দেড়টার দিকে খবর পেলাম , ছাত্রলীগ আর ক্যাম্পাসের ভেতরে ঢুকছে না। প্রবেশ পথগুলো পরিষ্কার। তখন অনেক মেয়ে হলে ফিরে যেতে চাচ্ছিল। যেহেতু মেয়েদের হলগেট সারারাত খোলা থাকে না। পরবর্তীতে ঠিক হলো, সব মেয়ে একসাথেই হলে চলে যাবে। প্রায় ২টার দিকে ক্যাম্পাস মোটামুটি খালি হয়ে যায়। বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃবৃন্দ ও সমন্বয়করা স্ট্রল মসজিদের গেইটের সামনে দিয়ে মধুর ক্যান্টিনের দিকে এগুতে থাকে। ওইখানে ছাত্রলীগের নেতারা অবস্থান নিতে দেখা যায়। মুখোমুখি হলেও তখন কোনো পক্ষই সংঘাতে জড়ায়নি।
বাসস : ১৫ জুলাই ছাত্রলীগ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যে হামলায় চালিয়েছিল, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা শুনতে চাই।
নূজিয়া হাসিন রাশা : ১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে টিএসসিতে সমাবেশ হচ্ছিল। এদিন ইডেন কলেজের মেয়েরা বের হয়ে রাজুতে আসতে চাইলে তাদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। সেই সময় অনেক শিক্ষার্থীরা আহত হয়। আহত অবস্থায়ই অনেকে মিছিল নিয়ে রাজুতে চলে আসে। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারলাম, মিছিলে আসতে চাওয়া শিক্ষার্থীদের হলপাড়ায় আটকে রাখা হয়েছে। তখন সমন্বয়কদের মধ্য থেকে সিদ্ধান্ত হলো- আমরা মেয়েদের মিছিলটা সামনে রেখে হলপাড়ার দিকে আগাবো। আমাদের রাজনীতির চর্চায় এটা ব্যাপক হারে দেখা যায়, মেয়েদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা। আমরা মিছিল নিয়ে হল পাড়ার দিকে অগ্রসর হলাম। রেজিস্টার বিল্ডিং পর্যন্ত মিছিল আসার পর সমন্বয়কদের মধ্যে দোদুল্যমানতা দেখা যায়। মেয়েদের মিছিল আগাবে নাকি চলে যাবে, পরিস্থিতি কী হতে চাচ্ছে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা কিছুই বুঝে ওঠতে পারছিল না। তারা ভেঙ্গে ভেঙ্গে মিছিল নিয়ে আগায়। হলপাড়ার সামনে আসতেই সমন্বয়কদের আর দেখা যায়নি। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা তখন হঠাৎ করে এসে মেয়েদের ওপর ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। তখন সামনের সারির সবাই সরে যায়। আমার পেছনে তখনো দুই শতাধিক মেয়ে। এদের প্রটেক্ট করার জন্য আমরা কয়েকজন ব্যানার মাথার ওপর তুলে ইট পাটকেল আটকানোর চেষ্টা করি। হামলার মুখে আমরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাই। একটু পর আমরা ভিসি চত্বরের দিকে গিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা কররি। ভিসি চত্বরে সবাই এক হওয়ার পর দেখি, নীলক্ষেত দিয়ে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বন্দুক বের করে গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে। মল চত্বর থেকে ছাত্রলীগের আরেকটা মিছিল এসে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। শিক্ষার্থীরা ফুলার রোডে পার্ক করে রাখা ভার্সিটির বাসে আশ্রয় নেয়। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা বাসের মধ্যে ঢুকেও নারী ও ছেলে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে। যেদিক থেকে পেরেছে, সেদিক থেকে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষার্থীদের নির্মমভাবে মারধর করতে থাকে। চোখের সামনে নারী শিক্ষার্থীদের রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখেছি। নারী শিক্ষার্থীদের রিকশায় উঠানোর সময়ও ছেলেদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ।
আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার সময় রিকশাওয়ালাদেরও মার খেতে হয়েছিল। অনেক শিক্ষার্থী তখন সমন্বয়কদের ওপর তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করছিল। বিশেষ করে যখন তারা জানতে পারে, সমন্বয়করা আন্দোলনকারীদের ক্যাম্পাসে রেখে অন্য কোথাও আশ্রয় নিয়েছে বা মেডিকেলে সবার আগে গিয়ে মিডিয়া ফেস করছে। শিক্ষার্থীরা চাচ্ছিল, ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের প্রতিহত করতে গিয়ে কোনো সমন্বয়ক না থাকায় আমাদের সবাইকে একত্রিত করা কঠিন হয়ে পড়েছিল। এমন সময় শুনি এসএম হলের ভেতরে কিছু মেয়ে আটকা পড়েছে। আমিসহ চার পাঁচজন মেয়ে ঠিক করলাম, ভেতরে যারা আটকে আছে, তাদের উদ্ধার করতে যাব। তাদেরকে একে একে বের করে আমরা রাজুর দিকে নিয়ে যাই।
বাসস : ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার পর কী প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল? আন্দোলন তখন কোন দিকে মোড় নেয়?
নূজিয়া হাসিন রাশা : ক্যাম্পাসের এক সাংবাদিক বড় ভাইয়ের সহায়তায় আমরা হলের দিকে যাই। রোকেয়া হলের সামনে গিয়ে দেখি, ছাত্রলীগ গান বাজিয়ে আনন্দ উৎসব করছে। রাজু ভাস্কর্যেও সবচেয়ে নিকটবর্তী রোকেয়া হলের মেয়েরা তখন গেটের ভেতর থেকে জুতা ও ঝাড়ু দেখিয়ে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছিল, ‘ছাত্রলীগের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে’। আমি সেখানে গিয়ে হলের বাইরে থেকে স্লোগান দেওয়া শুরু করি। হলের পকেট গেট থেকে তখন মেয়েরা বের হয়ে এসে আমাদের সাথে স্লোগান ধরে। এসময় ছাত্রলীগ আমাদেরকে বিভিন্নভাবে উস্কানি দিচ্ছিল। তারা আমাদের মাথায় থাকা বাংলাদেশের পতাকা খুলে ফেলতে চেয়েছিল এই বলে, রাজাকারের মাথায় কেন বাংলাদেশের পতাকা? তখন আমরা প্রতিবাদ করি। ছাত্রলীগের ওই নেতা দৌঁড়ে চলে যায়। এক পর্যায়ে আমি আর আমার সহযোদ্ধারা এক নিরাপদ জায়গা খুঁজতে থাকি। কারণ ততক্ষণে পুরো ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা মহড়া দিচ্ছিল। রাস্তার মধ্যে একাধিকবার ছাত্রলীগ আমাদের ওপর চড়াও হয়, বুলিং করে। আমাদের ফোন তল্লাশি করতে চেয়েছিল।
বাসস : ১৬ জুলাই রাজু ভাস্কর্যে ছাত্রলীগের মারমুখী অবস্থান ও শহীদ মিনারে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সমাবেশ- এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করছিলেন?
নূজিয়া হাসিন রাশা : ১৬ তারিখ আমরা আবার শহীদ মিনারে একত্রিত হলাম। সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেসিয়ামের সামনে থেকে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোট মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারে উপস্থিত হয়। শহীদ মিনারে হাজার খানেক শিক্ষার্থী জমায়েত হওয়ার পর সকলে চাচ্ছিল, রাজু রিক্লেইম করতে। কারণ সেদিনও রাজুতে ছাত্রলীগ সমাবেশ করছিল এবং মূলত ক্যাম্পাসকে তারা অবরুদ্ধ করে রেখেছিল।
বাসস : ১৬ জুলাই আন্দোলনে অংশ নিয়ে রংপুরে আবু সাঈদ ও চট্টগ্রামে শহীদ ওয়াসিম আকরামসহ বেশ কয়েকজন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। পরের দিন ১৭ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের গায়েবানা জানাযার আয়োজন করা হয়। এই কর্মসূচিকে ঘিরে সেদিন কী কী ঘটেছিল?
নূজিয়া হাসিন রাশা : ১৭ জুলাই গায়েবানা জানাযাতেও হামলা হয়। তখন আমি সামনে ছিলাম। আমার একদম পায়ের কাছে টিয়ার শেল এসে পড়ে। পুলিশ ক্যাম্পাসে ঢুকে আমাদের ওপর দফায় দফায় হামলা করে। তারপর শিক্ষার্থীরা হল ছাড়তে বাধ্য হয়। এসময় জুবেল ভাই নাহিদ ভাইকে বলে আগামীকাল সারাদেশে ছাত্র ধর্মঘট ঘোষণা করতে। তারপরের দিন কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করা হয়। আন্দোলন আরও স্বতঃস্ফূর্ত হয়। সারাদেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।
বাসস : শিক্ষার্থীদের আন্দোলন দমনে এক পর্যায়ে আবাসিক হলসহ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বন্ধ করে দেওয়া হয়। সেই সময় আন্দোলন কীভাবে গতিশীল ছিল?
নূজিয়া হাসিন রাশা : তখন আন্দোলনের গতি আরও বেড়ে যায়। সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন। এই সময়টাতে আমার তৎপরতা আরও বেড়ে গেছিল। প্রথম কমপ্লিট শাটডাউনের দিন আমি সায়েন্সল্যাব মোড়ে অবস্থান করি। এসময় একদম বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত অনেককে আন্দোলনে অংশ নিতে দেখি। এরপরের দিনও সায়েন্সল্যাব ছিলাম। সেদিন হেলিকপ্টার থেকে গুলি ছোড়া হয়। আমরা কয়েকজন একটা বাসায় আশ্রয় নিই। আমাদের সামনেই প্রিয় (সাংবাদিক তাহির জামান প্রিয়) ভাইকে হত্যা করা হয়। এরপর দিন থেকে আমি ঝিগাতলার একটা শেল্টারে ছিলাম। বাসার নিচে ছাত্রলীগ ঘোরাফেরা করা শুরু করলে আমাকে জায়গা পরিবর্তন করে আরেক জায়গায় চলে যেতে হয়।
বাসস : কারফিউ চলাকালে ও শিক্ষার্থীদের ধরপাকড়ের সময় আপনি ও আপনার সংগঠন কীভাবে আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন?
নূজিয়া হাসিন রাশা : কারফিউ চলাকালে ২৭ জুলাই প্রেসক্লাবের সামনে গণতান্ত্রিক ছাত্রজোটের একটি সমাবেশ হয়। উক্ত সমাবেশ থেকে নেতৃবৃন্দ সরাসরি শেখ হাসনার পদত্যাগ দাবি করে। কারণ এতো মানুষ হত্যার পর, রক্তাক্ত করার পর, জেলে নেওয়ার পর এই সরকার আর ক্ষমতায় থাকতে পারে না। ২৭ জুলাইয়ের আগে প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের ব্যানারে সর্বপ্রথম কারফিউ ভেঙ্গে গানের মিছিল হয় প্রেসক্লাবে। তার পরদিন নারীদের প্রতিবাদী সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় পল্টনে। ৩০ জুলাই প্রতিবাদী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর ব্যানারে একটা মিছিল বাহাদুর শাহ পার্ক অভিমুখে যাত্রা শুরু করলে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে পুলিশ আমাদের বাধা দেয় এবং এক পর্যায়ে হামলা করে। পরে আমরা সেখানেই বসে সমাবেশ করি। তারপর ২ আগস্ট দ্রোহযাত্রা হয়। ১৭ জুলাইয়ের পর এ শহরের মানুষ যারা কারফিউতে আটকে গিয়েছিল, স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল, তারা আবার দ্রোহযাত্রায় অংশ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। যা আমরা ১৬ জুলাই করতে পারিনি, সেদিন ক্যাম্পাসে ঢুকে ছাত্রলীগের সকল দেয়াল লিখন ও সমস্ত চিহ্ন মুছে দিই। ক্যাম্পাসের বিভিন্ন জায়গায় হাসিনার পদত্যাগ দাবি করি। সেদিন সব মানুষ বলতে শুরু করে, ‘দফা এক, দাবি এক শেখ হাসিনার পদত্যাগ’। এভাবে দ্রোহযাত্রার মধ্য দিয়ে আন্দোলনের লক্ষ্য এক দফার দিকে চলে যায়।
বাসস : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার পর আন্দোলনের গতি-প্রকৃতি নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। এ সময় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অন্যান্যদের যে ভূমিকা ছিল, তা কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
নূজিয়া হাসিন রাশা : পাবলিক বিশ্বদ্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে আন্দোলনে বিকেন্দ্রীকরণ দেখা যায়। সে সময় সবচেয়ে বেশি সাড়া দেয় প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ১৭ জুলাইয়ের পর যদি প্রাইভেটের শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে না থাকত, তাহলে কোটা সংস্কার আন্দোলন ফ্যাসিস্ট পতনের আন্দোলনে নেওয়া সম্ভব হতো না, এই আন্দোলন ৫ আগস্ট পর্যন্ত আনা যেত কিনা, সন্দেহ ছিল। আন্দোলনে রাজধানীকে চাঙ্গা রাখার সবচেয়ে বেশি অবদান ছিল প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের। বৃষ্টি হোক, হামলা হোক, হেলিকপ্টার থেকে গুলি করা হোক- তারা কিন্তু রাজপথ ছাড়েনি। একইসাথে, মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরাও ফ্যাসিস্ট সরকার উৎখাত করতে লাঠি, গুলি ও টিয়ারগ্যাসের সামনে লড়ে গেছে। যাত্রাবাড়ীকে বলা হয় ‘আন্দোলনের স্ট্যালিনগ্রাদ’। সেখানে লড়াই করেছে আমাদের মাদ্রাসা ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সেখানে ফ্যাসিস্ট উৎখাতের লড়াই করেছে দিনমজুর, হকার, রিকশাচালক ও গার্মেন্টস শ্রমিকরা। আমাদের মাস্টারমাইন্ড তারা।
বাসস : নানা ঘটনা প্রবাহে ৯ দফা দাবি এক পর্যায়ে সরকার পতনের এক দফা দাবিতে রূপ নেয়। ওই সময় আপনি কীভাবে আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলেন?
নূজিয়া হাসিন রাশা : ৩ আগস্ট আমি যে শেল্টারে ছিলাম, তার থেকে বের হয়ে আসি। ৪ তারিখে আন্দোলনে আসার সময়ও দেখি, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সবাইকে চেক করছিল। রিকশাওয়ালা মামার বুদ্ধিতে কোনোভাবে বের হয়ে এসে আন্দোলনে যোগ দিই। ৫ আগস্ট আমি শিক্ষকদের সাথে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি। আসার পর দেখি, গুলির শব্দ। চারদিকে থমথমে অবস্থা। ক্যাম্পাসে কেউ নেই তেমন। আমরা ডাকসু বিল্ডিংয়ের সামনে আশ্রয় নিই। চারপাশ থেকে গুলি, গ্রেনেডের এতো শব্দ, যা পুরো পরিবেশ ভীতিকর করে তুলে। তারপর ফোনে সেনাবাহিনী থেকে পাঠানো ম্যাসেজ দেখে বুঝা যায়, কিছু একটা হয়েছে। তখনো শাহবাগে গুলি চলে। কিছুক্ষণ পর শুনি শাহবাগে মানুষের ব্যাপক উপস্থিতি। আমরা ক্যাম্পাস থেকে আনন্দ মিছিল নিয়ে শাহবাগে যাই। আমাদের মনে গণঅভ্যুত্থানের একটি আনন্দ আসে। আমরা সারাদিন সবাই মিলে আনন্দ উৎসব করতে থাকি। গণঅভ্যুত্থানের যে আকাঙ্খা, তা বাস্তবায়নের জন্য আমাদের লড়াই সেদিন থেকে নতুনভাবে শুরু হয়।
বাসস : আপনাকে ধন্যবাদ।
নূজিয়া হাসিন রাশা : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।