\ আল সাদী ভূঁইয়া \
ঢাকা, ১৭ জুলাই, ২০২৫ (বাসস): ২০১৮ সালে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন মো. রাশেদ খাঁন। ২০২৪ সালেও কোটা সংস্কার আন্দোলনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
রাশেদ খাঁন বর্তমানে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। ২০১৯ সালে তিনি ডাকসু নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি বিভিন্ন সময় নির্যাতন, হামলা, মামলা ও কারান্তরীণ হয়েছেন।
ঝিনাইদহের সদর উপজেলায় জন্ম নেওয়া রাশেদ খাঁন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং এন্ড ইন্সুরেন্স বিভাগ থেকে বিবিএ সম্পন্ন করেন। কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে জেলে থাকায় তিনি তার এমবিএ ডিগ্রি সম্পন্ন করতে পারেননি।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থাকে (বাসস) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার ভূমিকা ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন।
বাসস: আপনাদের আন্দোলনের মাধ্যমে ২০১৮ সালে কোটা বাতিলের যে প্রজ্ঞাপন হয়, তা ২০২৪ সালের ৫ জুন হাইকোর্টের রায়ের মাধ্যমে বাতিল করা হয়েছিল। এই রায়ের পর আপনাদের প্রতিক্রিয়া কী ছিল?
রাশেদ খাঁন: যেদিন আদালত এই রায় দেয়, সেদিনই আমরা অফিসে বসে সিদ্ধান্ত নিই, আমরা এই বিষয়ে সংবাদ সম্মেলন করব এবং শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানাবো, আমরা যেহেতু এখন আর শিক্ষার্থী নই, তাই এখন যারা নিয়মিত শিক্ষার্থী, তারা যেন এ বিষয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়। ২০১৮ সালে কোটা আন্দোলন আমাদের নেতৃত্বে হয়েছিল। ২০১৮ সালের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ। পরবর্তীতে এর নাম রাখা হয় ছাত্র অধিকার পরিষদ। এ সংগঠন থেকে এখন রাজনৈতিক দলও গঠন করা হয়েছে। ছাত্র অধিকার পরিষদ বর্তমানে যেহেতু একটি রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন, সেহেতু এ ধরনের আন্দোলনে এ সংগঠন এবার নেতৃত্ব দিতে পারছে না। কারণ এ ধরনের মুভমেন্টের ক্ষেত্রে যে বিষয়টা ছিল, সেটা হলো রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠনের অধীনে সাধারণ শিক্ষার্থীরা আসতে ভয় পায়। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠন ছিল না। তাই ঢাবিসহ সারাদেশের শিক্ষার্থীরা এ সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলন করেছিল। কোটা সংস্কার আন্দোলন মূলত একটি সামাজিক আন্দোলন। তাই সে আন্দোলনে সবাই এসেছেন। আমরা ছাত্র অধিকার পরিষদকে বলেছি, আপনারা এ আন্দোলনে থাকেন। শিক্ষার্থীদের সাথে সমন্বয় করে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিন, ভূমিকা রাখুন। রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত থাকায় আমার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার বাস্তবতা অনেক কঠিন। যে কারণে আমরা প্রেস ব্রিফিং ডাকলাম। রায়ের দিন রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি মিছিল হয়। সেখানে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসান আল মামুন উপস্থিত ছিলেন। পরের দিন সকালে শাহবাগে যারা ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা বা অংশগ্রহণকারী ছিলেন, তারা বিক্ষুব্ধ ছাত্রজনতার ব্যানারে একটি প্রোগ্রাম করে। এর পরের দিন তিনটায় আমরা একটি প্রেস ব্রিফিং করি। সেদিন বিকেলে একটি অরাজনৈতিক ব্যানার থেকে সবাই স্বতঃস্ফূর্তভাবে একটি বিক্ষোভ মিছিল করে। একপর্যায়ে আমাদের মনে হলো, এ আন্দোলনটা আবার শুরু হচ্ছে এবং শিক্ষার্থীদের আগ্রহ আছে।
বাসস: আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ দেখার পর আপনার কী মনে হয়েছিল?
রাশেদ খাঁন: ৬-৭ বছর আগে আমরা ছাত্র রাজনীতি শেষ করেছি এবং রাজনৈতিক দল গঠন করেছি। আমরা জাতি মুক্তি ও গণতন্ত্রের আন্দোলনে রয়েছি, সেই জায়গা থেকে আমাদের একটা দায়বদ্ধতা ছিল, কীভাবে এটিকে কাজে লাগিয়ে হাসিনার পতনের আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাওয়া যায়? এটি ছিল আমার নিজস্ব চিন্তা। আমাদের সভাপতি (নুরুল হক নুর) নিজেও এটি চিন্তা করছিলেন বলে জানান। আমরা নিজেরা আলাপ আলোচনাও করলাম। সব জিনিস সবার সাথে আলোচনা করে আসলে হয় না। আমরা বিএনপিসহ অন্যান্য দলের সাথে যুগপৎ আন্দোলন করেছি। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল বিএনপি। আমি তখন বিএনপির তিনজন নেতার সাথে কথা বললাম। তার মধ্যে ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, তথ্য ও প্রযুক্তি সম্পাদক একেএম ওয়াহিদুজ্জামান, আরেকজন অ্যাডভোকেট মেহেদী সাহেব। এ তিনজনকে বললাম, আপনারা তারেক রহমানকে জানান এ আন্দোলনকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়। সালাহউদ্দিন সাহেব জানান, তারেক রহমানের এটা নিয়ে ভালো আগ্রহ আগ্রহ আছে।
বাসস: কখন থেকে আপনারা এই পরিকল্পনা করেছিলেন?
রাশেদ খাঁন: জুলাইয়ের একবারে শুরুতেই। আন্দোলন শুরু হওয়ার চার পাঁচদিনের মধ্যে আমরা এই পরিকল্পনা করি। ছাত্রদলকে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য বলা হয়। আমি আখতারকে (এনসিপির বর্তমান সদস্য সচিব) কয়েকবার জিজ্ঞেস করি, অন্যান্য ছাত্র সংগঠন সম্পৃক্ত আছে কিনা? তারপর আমি জিজ্ঞেস করলাম আন্দোলনে ছাত্রশিবির সম্পৃক্ত আছে কিনা? আখতার বলল, ‘তাদের সাথে কথা হয়েছে। তারা আন্দোলনে থাকবে।’ তবে বিষয়টা যেটা হয়েছিল, শুরুতে এ আন্দোলন কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে কিনা? আখতার বলেছিল, ‘আপাতত কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে’। আমি তখন বিএনপিকে বলেছিলাম আন্দোলন যেটাই হোক, আন্দোলনে ছাত্রদলকে সম্পৃক্ত করেন। এ আন্দোলনকে কাজে লাগানোর জন্য একটা ‘গোপন’ আলোচনা হয়। আমি আন্দোলনকারীদের বললাম, আন্দোলন বড় হলে হাসিনা বাধা দেবে। বাধা দিলে সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরা ওভাবে থাকবে না। তখন রাজনৈতিকভাবে সেটা মোকাবিলা করতে হবে। সুতরাং বাধা দেওয়ার আগ পর্যন্ত আন্দোলনে আসা-যাওয়া করতে হবে। যখন বাধা দেবে, তখন পাল্টা-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
বাসস: রাজনৈতিকভাবে আন্দোলনে কীভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন? কেমন সাড়া পাচ্ছিলেন?
রাশেদ খাঁন: ওই সময় সালাহউদ্দিন ভাই ও নুরুল হক নুরের সাথে এ আন্দোলন নিয়ে আমার আলোচনা চলতে থাকে। এর মধ্যে আসিফের সাথে আমার কথা হয়। আসিফকে বললাম, ছাত্র অধিকার পরিষদের কাউকে রাখতে। তখন আসিফ বলল, ‘যারা একদম নন-পলিটিক্যাল, তাদেরকে আমরা এখানে রাখব’। এর কয়েকদিন পর তার সাথে আবার কথা হয়। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনার দিন আসিফ আমাকে বলল, ‘ভাই, আপনারা নাগরিক সমাজকে নিয়ে একটি প্রোগ্রাম করেন’। পরের দিন (১৬ জুলাই) আমরা আমাদের কার্যালয়ের সামনে একটা প্রোগ্রাম করলাম নাগরিক প্রতিক্রিয়া নামে। তারপর যখন হামলা-মামলা শুরু হয়, তখন আমরা সিদ্ধান্ত নিই এখন আমাদের মাঠে থাকতে হবে। সেদিন বিকেলে শুনতে পাই, একজন শিক্ষার্থী মারা গেছে। তাৎক্ষণিক গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, এনডিএম-এর যৌথ আয়োজনে আমরা একটা প্রোগ্রাম করলাম। তারপর থেকে বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীদের হত্যার সংবাদ পাই। তখন আমি আসিফের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আসিফ আমাকে তার বদলে আহনাফ সাঈদ খানের নম্বর দিয়েছিল। আমি তখন তাকে বলি, কোনো সাপোর্ট লাগলে জানাইয়ো। তখন আহনাফ তাদের পাশে থাকার আহ্বান জানায়। আমরা আমাদের জায়গা থেকে পাশে থাকার চেষ্টা করি। তারপর ২৩ জুলাইয়ের দিকে আহনাফ আমাকে বলে, ‘ভাই, শিক্ষার্থীদের নিয়ে আর পারছি না’। তখন মাঠ মোটামুটি ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আহনাফ আমাকে তখন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে মাঠে নামার কথা বলে। তখন আমি তাকে বলি, এটা কি শুধু তোমার বক্তব্য নাকি সবার বক্তব্য? তখন সে বলে, ‘এটা সবার বক্তব্য’। আমি বলি, আমরা নামাতে পারবো। কিন্তু তোমাদের এক দফার ঘোষণা দিতে হবে। সে বলল, ‘ভাই, এক দফার ঘোষণা দেব। কিন্তু আপাতত আমাদের মাঠে নামতে হবে। সবাইকে মাঠে নামান।’ তখন আমি বিএনপির সালাহউদ্দিন ভাইকে বললাম, তারা যদি এক দফার ঘোষণা দেয়, তাহলে আমরা শক্তভাবে মাঠে নামব। কারণ এতগুলো মৃত্যুর পর আসলে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া যায় না। তখন আহনাফ জানালো, তাদের এক দফার ঘোষণা দিতে সময় লাগবে। আমি সালাহউদ্দিন ভাইকে জানালাম। তিনি তখন নেতাকর্মীদের ভালোভাবে মাঠে নামতে বলেন। আমি আরও বললাম, শুধু আপনারা নামলেই হবে না। জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য ইসলামিক দলগুলোকে মাঠে নামাতে হবে। মূলত সবার সাথে সালাহউদ্দিন ভাই কথা বলেছেন। তিনি দেশের বাইরে থেকেই এই কথাগুলো বলেছিলেন।
বাসস: শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আপনার যোগাযোগের অভিজ্ঞতা জানতে চাই। ওই পরিস্থিতিতে কাজটা কেমন লেগেছিল?
রাশেদ খাঁন: আমরা শিক্ষার্থী ও রাজনৈতিক দলগুলোর মাঝে ব্রিজ হিসেবে কাজ করেছি, সমন্বয় করেছি। একপর্যায়ে টপ সমন্বয়কদের নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে যাওয়ার পর একটা সময় আন্দোলন প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। এই সময়টাতে সবার সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ফোন চেঞ্জ করি। তখন আমাকে বিভিন্ন জায়গায় মুভ করতে হয়েছে। এর তিনদিন পর আবার অ্যাক্টিভ হই। তারপর আমি আবার সবার সাথে যোগাযোগ করি। একটা পর্যায়ে আমি সালাউদ্দিন আহমেদকে বলি, ভাই, এখন পেশাজীবীদেরও নামাতে হবে। তখন কিন্তু হাইকোর্ট থেকে আইনজীবীরা আন্দোলনে যুক্ত হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষকরা যুক্ত হন। এভাবে নতুনভাবে আন্দোলনটা আবার শুরু হয়। ওই সময়ে কিন্তু আসিফ-নাহিদসহ অন্যান্য যে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ছিল, তারা ডিবি হেফাজত থেকে মুক্ত হয়। তখন এত মানুষ মারা গেছে যে তখন এ আন্দোলন শুধু নয় দফার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চায়নি কেউই। সবাই দাবি জানায়, সবকিছু এক দফায় রূপান্তর করতে হবে এবং জনগণের যে চাওয়া পাওয়া, সেই চাওয়া পাওয়ায় তারা কিন্তু সাড়া দিয়েছে। তারা যখন এক দফার ঘোষণা দিয়েছে, দলগুলো তখন কারফিউ ভাঙার জন্য যার যার জায়গা থেকে কাজ করেছে। ওই সময় পর্যন্ত বিএনপির সাথে আমাদের আলোচনা হয়। অন্য দলগুলোর সাথেও আমাদের আলোচনা হয়। সবাই কিন্তু কারফিউ ভাঙার জন্য তারা সর্বাত্মক লড়াই করার প্রস্তুতি গ্রহণ করে এবং সাধারণ মানুষ কীভাবে এ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়েছে, তা আমরা সবাই দেখেছি।
বাসস: সরকার পতনে ছাত্রদের আন্দোলনকে কেন বেছে নিয়েছিলেন? ছাত্রদের আন্দোলন এত জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ কী?
রাশেদ খাঁন: যুগে যুগে যত আন্দোলন হয়েছে, ছাত্রদের ছাড়া কোনো আন্দোলন বাংলাদেশে সফল হয়নি। ১৯৯০ এ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন, ৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ছাত্ররা সফল হয়েছে। ক্যাম্পাসে আন্দোলনে আমরা ছাত্রদের ওপর আস্থা রেখেছি। রাজনৈতিক নেতৃত্ব যেমন ছাত্রদের ওপর আস্থা ও বিশ্বাস রেখেছে, আমরাও বিশ্বাস রেখেছি এবং তারাও তাদের জায়গা থেকে সেই কাজটা করেছে। ছাত্ররাও রাজনৈতিক নেতাদের ওপর এই বিশ্বাস রেখেছে তাদের ডাক দেওয়া হলে জনতা তাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।
বাসস: শেখ হাসিনা এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ করলে আপনাদের অবস্থা কী হতো, সেটা নিয়ে কখনো ভেবেছিলেন?
রাশেদ খাঁন: শেখ হাসিনা টিকে গেলে আমাদের জীবন হুমকির মুখে পড়ত। এই সব চিন্তা মাথায় রেখেই আমরা আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছিলাম। আর ছাত্রদের পেছনে ফেরার সুযোগ ছিল না। তখন পরিস্থিতি এমন ছিল, শেখ হাসিনা জিতবে বা জনতা জিতবে। হয় আমরা মরবো অথবা তারা মরবে।
বাসস: রাজনৈতিক দলগুলোর ডাকে জনগণ এত বছর রাস্তায় নামেনি, কিন্তু ছাত্রদের ডাকে রাস্তায় নেমেছে। এ বিষয়ে কিছু বলুন।
রাশেদ খাঁন: এই আন্দোলন শুধু রাজনৈতিক শক্তি ছিল বলে সফল হয়েছে, তা নয়। এখানে সবার পরিকল্পনা ছিল, সবার শ্রম ছিল, ঘাম ছিল। যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কারো ওপর হামলা বা কাউকে নিহত হতে দেখেছে, তারা নিজেদের বিবেকের তাড়নায় রাস্তায় নেমেছে। পুলিশের সন্তানরাও বাবার বিরুদ্ধে গিয়েছিল। পেশাজীবী সংগঠন ও সরকারি কর্মকর্তারাও রাস্তায় নেমেছেন। সিভিলে পুলিশের অনেক কর্মকর্তারাও নেমেছেন। সব জায়গা থেকে একটা গণবিস্ফোরণ শুরু হয়। আমরা এগুলো দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছি এবং বিশ্বাস করেছি, এবার কিছু একটা হবে। যখন কাউকে প্রতিহত করতে নেতার প্রয়োজন হয়, পুলিশ বা আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করার জন্য তখন ছাত্রদল, ছাত্র অধিকার পরিষদ নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা নিজেরাও করেছি। যারা রাজনীতি করে, তারা এই কৌশলে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমাদের সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাসিনার পতন হয়েছে। সবার আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, মানুষ রাস্তায় নামবে। আন্দোলনের সময় আমরা সবাই এক ছিলাম। ৫ তারিখের পর সেটা আর নেই। ৫ তারিখের আগের ঐক্য দেখে ভেবেছিলাম একটা নতুন বাংলাদেশ হবে।
বাসস: জুলাই গণ-অভ্যুত্থান আমাদের কীভাবে নাড়া দিয়েছিল? এতো শক্তিশালী বাহিনী ও সুসংগঠিত সরকারের বিরুদ্ধে কীভাবে খালি হাতে ছাত্র জনতা প্রতিহত করতে পারল?
রাশেদ খাঁন: ১৭ বছর ধরে দলগুলো মাঠে ছিল, তারা তো সব সময় কিছু না কিছু করেছে। আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। দলগুলো সব সময় মাঠে ছিল। আন্দোলন কিন্তু একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যায়, এখানে একটা প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। হাসিনার দমন-পীড়নের কারণে ধীরে ধীরে ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়েছে। ১৭ বছরের দমন পীড়নে ৯০ পার্সেন্ট ক্ষোভ জমা ছিল এবং যখন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি হলো, তখন শতভাগ ক্ষোভ তৈরি হয়। আর তখনই সবাই রাস্তায় নেমে আসে। রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা এখানে অনেক। যারা বলে রাজনৈতিক দলগুলো ১৭ বছর ধরে ব্যর্থ হয়েছে, তারা যদি ১৭ বছরে রাজনৈতিক দলের সাথে মাঠে নামতো, তাহলে হাসিনার পতন তখনই হয়ে যেতো। রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করলে, সেটাকে থামানো যায়। তাই কৌশলে সাধারণ ছাত্র-জনতা সামনে ছিল এবং রাজনৈতিক সংগঠনগুলো পেছন থেকে সহযোগিতা করে আন্দোলন সফল করেছে। রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর তেমন ভূমিকা ছিল না, এটা বলা ভুল। ২০১৮ সালে আমি কোটা আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলাম এবং ১৮ দিন পুলিশের হেফাজতে ছিলাম। পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছিলাম। ২০২৪ সাল এটা যখন আবার ফিরে আসল, তখন আমি আবার মাঠে নেমেছি। আমি বলতে চাচ্ছি, প্রত্যেকে প্রত্যেকের জায়গায় থেকে মাঠে নেমেছে। আমরা বিএনপিকে বলেছি, আপনারা এই আন্দোলনকে কাজে লাগাতে পারেন। আমরা পুরো সাপোর্ট দেবো। আমি বিএনপিকে ধন্যবাদ দিতে চাই, তারা আমাদের নিরাশ করেনি। তারা আমাদের কথা রেখেছিল। জনগণের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আমরা সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করেছি। যারা বলে ১৭ বছর রাজনৈতিক দলগুলো কিছু করেনি, তারা ১৭ দিনও রাস্তায় ছিল না। এই আন্দোলনে সবার ভূমিকা রয়েছে, কাউকে আমরা ছোট করতে চাই না।
বাসস: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
রাশেদ খাঁন: বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।