মো. রাসেল সরকার
ঢাকা, ৩১ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আবু বাকের মজুমদার। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে তিনি নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
আবু বাকের মজুমদারের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার বরুড়া উপজেলায়। তার বাবা মোজাম্মেল হোসেন মজুমদার একজন ব্যবসায়ী। মায়ের নাম রাজিয়া সুলতানা। স্থানীয় বিদ্যালয় থেকে এসএসসি শেষে ঢাকার বিসিআইসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর তিনি ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের ভর্তি হন। বর্তমানে তিনি মাস্টার্সে অধ্যয়নরত আছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থী। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ছাত্রলীগ তাকে হল থেকে বের করে দেয়। গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে তিনি হলে থাকছেন।
আবু বাকের জানান, তিনি রাজনৈতিক পরিবারে বেড়ে ওঠেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে তার পরিবারের সম্পৃক্ততা রয়েছে। তার বাবা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাই ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই তিনি ছাত্র রাজনীতিতে মনোযোগী হন। তিনি গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
ছাত্রশক্তির দায়িত্ব পালনকালে তিনি আওয়ামী লীগ সরকার ও ছাত্রলীগের অন্যায় ও অনিয়মের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। এ পদে থাকা অবস্থাই তিনি জুলাই গণঅভ্যুত্থানে অন্যতম সমন্বয়কের ভূমিকা পালন করেন। বর্তমানে তিনি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে গঠিত নতুন ছাত্র সংগঠন- বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আবু বাকের মজুমদার জুলাই গণঅভ্যুত্থানে তার অংশগ্রহণ, নেতৃত্ব ও অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন মো. রাসেল সরকার।
বাসস : ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনে কখন, কীভাবে যুক্ত হলেন?
আবু বাকের মজুমদার : সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটা খুবই বৈষম্যমূলক ছিল। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করেছি এবং এক পর্যায়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়েছে। আমাদের যে সরকারি চাকরি হবে না, এটা আমরা জানতাম। শুধু শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমরা আন্দোলন করি। আমি কোটা আন্দোলনের শুরু থেকে গণঅভ্যুত্থানের শেষ পর্যন্ত সরাসরি কানেক্টেড ছিলাম। ২০২৪ সালের ৫ জুন যখন হাইকোর্ট কোটা পুনর্বহালের রায় দেয়, তখন এ নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। আমরা ছাত্রশক্তির নেতাকর্মীরা তখন কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে একটা প্রোগ্রাম আহ্বান করি। তখন দেখি, সাধারণ শিক্ষার্থীরা আমাদের প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিচ্ছে। আমরা টানা তিনদিন প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ মিছিল করি। সামনে ঈদের ছুটি থাকায় আমরা ৩০ জুন পর্যন্ত আল্টিমেটাম দিই, যাতে এই সময়ে কোটা ব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কারের সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে।
বাসস : ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ কোটা সংস্কার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিল। এই প্ল্যাটফর্ম কীভাবে গড়ে উঠেছিল?
আবু বাকের মজুমদার : আমরা জানতাম আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের দাবি মেনে নেবে না। তাই আমরা আল্টিমেটাম দিয়ে বসে ছিলাম না। আমরা ৭ জুন বসে একটা মাস্টারপ্ল্যান করি, কীভাবে সারাদেশের শিক্ষার্থীদের এ আন্দোলনে কানেক্ট করা যায়। আমরা আন্দোলনের একটা ছক আঁকলাম। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমার দায়িত্ব পড়ে ঢাকার বাইরের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যুক্ত করা। আমরা ৯ থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত সারাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করি। সেই সময়ই আমাদের গণঅভ্যুত্থানের প্রথম শহীদ আবু সাঈদের সঙ্গে পরিচয় হয়। এরকম সারাদেশে অনেক সংগঠকের সাথে আমার পরিচয় হয়। আমরা দলীয় ব্যানারের বাইরে একটা কমন প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামটা বেছে নিই, যাতে সবাই এটা নিজেদের প্ল্যাটফর্ম মনে করতে পারে। শুরুতে দলীয় ব্যানারে শিক্ষার্থীদের সাড়া খুব কম ছিল। কিন্তু ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ ব্যানারে ব্যাপক শিক্ষার্থীর সাড়া পড়ে।
বাসস : আন্দোলনে আপনাদের কী কী কৌশল ছিল? কীভাবে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এত সাড়া পেলেন?
আবু বাকের মজুমদার : প্রথমত আমরা এখানে যারা নেতৃত্বে ছিলাম, তাদের একটা বড় অংশ সরকার এবং ছাত্রলীগ বিরোধী ছিল। আমরা চেয়েছিলাম যেকোনো মুভমেন্টের মাধ্যমে হাসিনার পতন। আমরা চেষ্টা করতাম যেকোনো কেনো আন্দোলন সরকার পতনের দিকে নিয়ে যাওয়া যাওয়ার। এখানে এক ধরনের কৌশল ছিল, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সরকার বিরোধী মুভমেন্টের দিকে ড্রাইভ করানো, যাতে সরকার বিরোধীরা আন্দোলনে যুক্ত হয়। ফ্যাসিবাদ বিরোধী দলগুলো আমাদের সমর্থন জানায়। আবার আরেকটা বিষয় ছিল, প্রথমে আমরা আন্দোলনটাকে খুবই জেনারালাইজ করার চেষ্টা করি। জেনারেলাইজ করার জন্য আমরা লিডারশিপের জায়গা থেকে যথেষ্ট ছাড় দিই এবং আমাদের ছাত্রশক্তির বাইরের লোকদেরও স্পেস তৈরি করে দিই, যাতে একটা জেনারেল ভাইব তৈরি হয়। নেতৃত্বে থাকা লোকজন কম্প্রোমাইজ করলে আন্দোলন সফল হয় না। সেই বিষয়টি আমাদের মাথায় ছিল।
আরেকটা বড় কৌশল ছিল, আমরা নারী শিক্ষার্থীদের সামনের সারিতে থাকার সুযোগ করে দিই। প্রথম প্রথম মাত্র ৪-৫ জন মেয়ে শিক্ষার্থী আন্দোলনে আসত। পরে যখন মেয়েদেরকে সামনে জায়গা করে দিই, ব্যানারটা তাদের হাতে দিই এবং যথেষ্ট স্পেস করে দিই, তখন নারী শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ বেড়ে যায়। সবাই মাথায় পতাকা বেঁধে আসে, এটা একটা হিরোইজমের মতো ছিল। আমরা নারী শিক্ষার্থীদের একটা কমফোর্ট জোন তৈরি করে দিই। ফলে দেখা গেছে, ডে বাই ডে আন্দোলনে নারী শিক্ষার্থীদের সংখ্যা ৫০ শতাংশ হয়ে গেছে। এটা সত্য যে একটা মুভমেন্টে যদি ৫০ শতাংশ নারী থাকে, সেখানে আপনি বাই ডিফল্ট তার সমান বা তার চেয়ে বেশি পুরুষ পাবেন। তো এই মুভমেন্টেও প্রায় একই জিনিস ঘটেছে, এই কৌশলটা আমরা অবলম্বন করেছি।
আরেকটা কৌশল ছিল, নেতৃত্ব নিয়ে যাতে আমাদের মধ্যে কোনো ধরনের কোন্দল তৈরি না হয়, সেজন্য কাউকে প্রধান বা পদ-পদবির তেমন ভিন্নতা রাখা হয়নি। যারা আন্দোলনে ভালো তৎপর ছিলেন, আমরা তাদের সমন্বয়ক হিসেবে সমান গুরুত্ব দিয়েছি। আমরা আরেকটা কাজ করেছি, আমরা জুলাইয়ের একদম শুরুর দিক থেকেই ফেসবুকে এসএসসি বা এইচএসসি ব্যাচ এ রকম যে গ্রুপগুলো আছে, ওই গ্রুপগুলোতে আমরা কিছু বীরত্বপূর্ণ ভিডিও শেয়ার করতাম। এটার অন্যতম কারণ ছিল- স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা। আপনি দেখবেন, আমাদের আন্দোলনে প্রচুর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছিল।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে কীভাবে ছাত্র সংগঠনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ ও সমন্বয় করেছিলেন? ছাত্রনেতাদের কীভাবে আন্দোলনে যুক্ত করেছিলেন?
আবু বাকের মজুমদার : ছাত্র সংগঠনগুলোর সাথে জুন মাসে ওভাবে যোগাযোগ বা সমন্বয় করা হয়নি। সম্ভবত জুলাইয়ের ২ বা ৩ তারিখ থেকে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু হয়। জুলাইয়ের আগে ২৭ বা ২৮ জুন কারো সঙ্গে একটা মিটিং হয়ে থাকতে পারে। এর আগে মিটিং হয়নি এতটুকু আমি বলতে পারি । ছাত্র সংগনগুলোর সঙ্গে যোগাযোগের জন্য আমাদের একেকজন দায়িত্ব ভাগ করে নিই। আমি ছাত্রদলের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করি। আমি বেশ কয়েকবার এ বিষয়ে তাদের সঙ্গে বসেছি। ওই সময়টাতে সবার আস্থা অর্জন করা চ্যালেঞ্জ ছিল। একেক দলের একেক মতামত ছিল। আন্দোলনটা সফল করতে খুব বেশি পরিচিত ফেস সামনের সারিতে রাখা হয়নি।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ছাত্রশক্তির আখতার ভাই, মাহফুজ ভাইসহ আমরা পাঁচজন একসাথে বসে প্ল্যান করেছিলাম, শুধু এ আন্দোলন সাধারণ শিক্ষার্থীদের আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পাবে। যখন সহিংসতা বা রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেবে, তখন সবাইকে সম্পৃক্ত করব।
বাসস : কোটা সংস্কার আন্দোলন সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেবে, এটা কি শুরুতে ধারণা করতে পেরেছিলেন বা এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা ছিল?
আবু বাকের মজুমদার : কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারের পতন হবে, এটা শুরুতে আমাদের ধারণায় ছিল না। তবে আমরা কোনো একটা ইস্যু খুঁজতাম এবং সেটাকে কীভাবে এন্টি আওয়ামী লীগ রূপ দেওয়া যায়, সে প্রচেষ্টা আমাদের ছিল। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গঠনে নতুন জেনারেশনের মধ্যে আশা জাগাতে আমরা প্রায় তিন বছর স্টাডি করেছি। আমাদের ঐতিহাসিক আন্দোলন ও এগুলোর অর্জন, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এবং বিশ্বে আরও যত বড় বড় আন্দোলন হয়েছে, সেগুলো আমরা স্টাডি করেছি। এগুলো ফলো করে আমরা একটা স্ট্যাটেজি তৈরি করেছি। এ জায়গায় আমরা বেশ কিছু বেনিফিট পেয়েছি, আমাদের প্রোগ্রামের নামকরণগুলো অভিনব ছিল। বাংলাদেশে হরতাল-অবরোধ নামে কর্মসূচি ঘোষণা করলে সেটা তেমন ফলপ্রসূ হতো না। সেজন্য আমরা বাংলা ব্লকেড নামে অভিনব কর্মসূচি ঘোষণা করেছিলাম।
বাসস : আন্দোলনের সময় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন যে অভিনব নামে কর্মসূচি ঘোষণা করত, এ ধারণাগুলো কীভাবে পেতেন?
আবু বাকের মজুমদার : ২০২০ সালে যখন আমরা গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি গঠনের পরিকল্পনা করলাম, সেই সময় থেকেই আমরা অনেক স্টাডি করি। সেই স্টাডি আমাদের কাজে দিয়েছে। আমরা এ আন্দোলনে অনেক ধরনের স্ট্র্যাটেজি প্রয়োগ করেছি। অভিনব নেমিং কৌশল প্রয়োগ করেছি। আরেকটা বিষয় ছিল, আমাদের জেনারেশনের পালস বুঝে স্টেটমেন্ট তৈরি করা। আরেকটা আমাদের লার্নিং ছিল, সকল ধরনের কমিউনিটির নেতাদের সামনে রাখা। যেমন ধরুন, আমাদের এখানে যারা লিডার হিসেবে ছিল, একেকজন কিন্তু একেক ধরনের কমিউনিটিকে রিপ্রেজেন্ট করে। আমরা সবসময় মধ্যপন্থায় এবং সেখানে সব ধরনের কমিউনিটি রিপ্রেজেন্টেশনে বিশ্বাস করি। আমাদের এখানে কেউ আছে রাইট ব্লককে মেইনটেন করে, কেউ লেফট ব্লককে মেইনটেন করে, আবার কেউ নিউট্রাল সেন্ট্রিস্টদেরকে মেইনটেন করে। আন্দোলনে আমরা এই বিষয়টা মেইনটেন করার চেষ্টা করেছি। আমরা আন্দোলনে ছাত্রলীগ হিসেবে সারজিস আলম ভাইকে নিয়ে এসেছি। আমরা পরিকল্পনা করি, আমাদের আন্দোলনে ছাত্রলীগের একজনকে লাগবে এবং তাকে সুশীল ও সংস্কারপন্থী হতে হবে। নাহিদ ভাই আমাকে এরকম কাউকে খুঁজতে বলেন। সেই হিসেবে সারজিস ভাইকে আমরা পেয়ে যাই।
বাসস : ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলায় কোটা সংস্কার আন্দোলন সহিংস হয়ে ওঠে। পরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ওই সময় কীভাবে আন্দোলনে গতিশীল রাখেন?
আবু বাকের মজুমদার : প্রথমত শেখ হাসিনা ১৪ জুলাই যখন শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ বলে কটুক্তি করে, তখন শিক্ষার্থীরা প্রথমবারের মতো প্রকাশে তার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। নারী শিক্ষার্থীরা রাতে হল গেইট ভেঙে রাস্তায় এসে স্লোগান দেয়। এটা একটা টার্নিং পয়েন্ট ছিল। এ ঘটনার জেরে ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা আরেকটা বড় টার্নিং পয়েন্ট ছিল। ১৬ জুলাই রংপুরে আবু সাঈদের হত্যা পুরো আন্দোলনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। ১৫ জুলাই হামলার পর যখন ক্যাম্পাস ও হল বন্ধ করে দেওয়া হয়, তখন আমরা পাল্টা প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ছাত্রলীগের হামলার পরও রাত ৯ টার দিকে কার্জন হলে দিক দিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে আমরা পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করি। যাতে আমাদের ওপর শিক্ষার্থীদের আস্থা থাকে যে আমরা পালিয়ে যাইনি এবং ছাত্রলীগের সাথে ফাইট দেওয়ার মতো আমাদের মানসিকতা আছে। এরই মাঝে শহীদুল্লাহ হলসহ সায়েন্সের তিন হলের শিক্ষার্থীরা আমাদের বেশি শক্তি ও সাহস জুগিয়েছে। পরে আমরা শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখি এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসায় অন্দোলন আরও গতিশীল হয়।
বাসস : ১৮ জুলাই সারাদেশে ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পর কীভাবে আন্দোলনের সমন্বয় করতেন? তখন আপনি কোথায় ছিলেন?
আবু বাকের মজুমদার : ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়ার পরের দিন নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই ও আমাকে অজ্ঞাত স্থানে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। নির্যাতন করার পর নাহিদ ভাইকে ২১ তারিখ ছেড়ে দেয় এবং আসিফ ভাই ও আমাকে ২৪ তারিখে ছাড়া হয়। আমরা গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলাম। চিকিৎসারত অবস্থায় ২৬ জুলাই আমাদেরকে ডিবি তুলে নিয়ে যায়। ২৭ তারিখ আমাদের কাছ থেকে মোবাইল কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর ১ আগস্ট ডিবি থেকে আমরা ছাড়া পাই। যে সময়টাতে ইন্টারনেট শাটডাউন ছিল, তখন আমরা ডিবিতে বন্দি ছিলাম। বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার তেমন ধারণা নেই।
বাসস : ডিবি কার্যালয়ে তুলে নেওয়ার পর সেখানে কী ঘটেছিল?
আবু বাকের মজুমদার : আন্দোলন প্রত্যাহার করতে শুরুতে আমাদের ভয়ভীতি দেখানো হয়। আমাদের সঙ্গে বাজেভাবে আচরণ করা হয়। আমাকে ঝুলিয়ে মারধর করে।
মারধরের কারণ ছিল, আমি ডিবি প্রধান হারুনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে যাই। ওই সময়টাতে আমি, নাহিদ ভাই, আসিফ ভাই একই ফ্লোরে ছিলাম। অপরদিকে সারজিস ভাই, হাসনাত ভাই, আর নুসরাত আপু ছিলেন নিচ তলায়। আমরা ছিলাম পাঁচ তলায়। আমাকে ২৭ ও ২৮ জুলাই মারধর করা হয়। তারা মেন্টাল ও ফিজিক্যাল সব ধরনের নির্যাতন করে। শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ দিয়ে আমাদেরকে বিবৃতি দিতে বলা হয়। আমাদেরকে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। পরে আমরা আমরণ অনশন শুরু করি।
বাসস : ডিবি কার্যালয় থেকে আন্দোলনে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়ে ছয় সমন্বয়কের যে ভিডিও বার্তা প্রচার করা হয়, সেটার নেপথ্যের ঘটনা জানতে চাই।
আবু বাকের মজুমদার : একটা স্টেটমেন্ট দেওয়ার জন্য আমাদেরকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়, কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি। আমরা বাইরের পরিস্থিতি জানতে পারছিলাম না। ভেতরে কী ধরনের রোল প্লে করা উচিত, সেটাও বুঝতে পারছিলাম না। আমরা বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য পথ খুঁজছিলাম। তাই বাধ্য হয়ে তাদের লেখা বিবৃতি পড়তে হয়। আমাদের সাথে ডিলটা ছিল, আমরা বাইরে গিয়ে এই কথাগুলোই বলব। এজন্য ওরা প্রমাণ স্বরূপ ওই ভিডিওটা রেখে দেয়। তখন এটা তারা গণমাধ্যমে প্রচার করে। কিন্তু পরে আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিই।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সেই দুর্বিষহ দিনগুলোতে আপনার পারিবারিক সাপোর্ট কেমন ছিল? পরিবার কোনো হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল কিনা?
আবু বাকের মজুমদার : পরিবার নানা ধরনের হুমকির সম্মুখীন হয়েছিল। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ে কোনো ধরনের ক্ষতি করতে পারেনি। আমাদের ফ্যামিলিটা পলিটিক্যাল।
আমার বাবা বিএনপির রাজনীতি করতেন। তবে নানার বাড়ির লোকজন আওয়ামী লীগ করত। আন্দোলনের সময় পরিবাব আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে। বিশেষ করে ডিবিতে যখন নেওয়া হয়, আমার বড় ভাই সেখানে গিয়েছিলেন। আমার পরিবারের সঙ্গে অ্যালাইন করেই আমি রাজনীতি করতাম।
বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আপনার সঙ্গে বা আপনার সামনে সংঘটিত সবেচেয়ে নির্মম স্মৃতি কোনটি, যে স্মৃতি আপনাকে আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে?
আবু বাকের মজুমদার : জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অনেকগুলো স্মৃতি রয়েছে। সবচেয়ে প্যাথিটিক মনে হয়েছে, ৫ আগস্ট সকালে চানখারপুল মোড়ে আমার সামনে দুইজন শহীদ হন। আমি আর আসিফ ভাই তখন সেখানে ছিলাম। এর আগের দিন ৪ তারিখে দুই বোন তার ভাইয়ের লাশ নিয়ে যাচ্ছে, এগুলো দেখে ঠিক থাকতে পারছিলাম না। ৫ আগস্ট সকালে আমি ও আসিফ ভাই অনেক কষ্টে মানিকনগর থেকে চানখারপুল আসি। সেদিন মার্চ টু ঢাকা কর্মসূচি ছিল। আমরা শহীদ মিনারে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করি।
চানখারপুলে পুলিশ ওপেন ফায়ার করে। চানখারপুলে স্বপ্ন শপিংমলের উপরের তলায় আমাদের একটা মেস ছিল। ওই এলাকায় আমরা আগে থেকে থাকতাম। ওই এলাকা আমাদের পরিচিত ছিল। আমরা মানুষকে সংগঠিত করে শহীদ মিনারে মিছিল নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি। তখন পুলিশ গুলি শুরু করে দেয়। সেখানে আমাদের সামনে দুইজন শহীদ হন। আমরা আসার আগে আরও দুইজন শহীদ হন। বার্ন ইউনিটের ওপর থেকে আমাকে ও আসিফ ভাইকে টার্গেটে করেও গুলি করা হয়। আসিফ মাহমুদ ভাই বারবার বলছিলেন,‘বাকের, আমরা তো শহীদ হওয়ার মানসিকতা নিয়ে নেমেছি। এত মানুষ শহীদ হচ্ছে। আমি শহীদ হলে কী হবে?’ তিনি বারবার বুলেটের সামনে ছুটে যেতে চাচ্ছিলেন। আমি তার হাত ধরে রাখি। এ ঘটনার আমি সাক্ষী। এ স্মৃতি আমরা সব সময় মনে থাকবে।
বাসস : গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নতুন বাংলাদেশ কেমন দেখতে চান? ক্ষেত্রে আপানাদের করণীয় কী?
আবু বাকের মজুমদার : আমরা একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজ চাই। যারা এই অঞ্চলের মানুষের মন-মানসিকতা ও অবস্থার আলোকে একটি ওয়েলফেয়ার স্টেট প্রতিষ্ঠা করবে।
আমরা সামাজিক সুবিচার ও একটি ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখি। সেজন্য আমাদের লড়াই অব্যাহত রাখতে হবে।