দেলোয়ার হোসাইন আকাইদ
কুমিল্লা, ১ আগস্ট ২০২৫(বাসস): ১ আগস্ট ২০২৪। জুলাই অভ্যুত্থানের শহীদ ও নিপীড়িতদের স্মরণে পালিত হয় ‘রিমেম্বারিং আওয়ার হিরোজ’ কর্মসূচি। কুমিল্লা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা বিচিত্র আয়োজনে এ কর্মসূচি পালন করে।
এরমধ্যে রয়েছে, দেয়াল লিখন, লিফলেট বিতরণ, অবস্থান, মানববন্ধন কর্মসূচি, প্রতিবাদী স্লোগান ইত্যাদি।
শিক্ষক নির্যাতন ও ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে এদিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি) এর শিক্ষকরা মানববন্ধন করতে গেলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের বাধার মুখে পড়েন।
১ আগস্ট বিকেলে কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ড মডেল সরকারি কলেজের সামনে শিক্ষার্থীরা একত্রিত হন। তাদের অনেকের মাথা ও মুখে কালো ও লাল কাপড় বাঁধা ছিল। তারা কলেজ ক্যাম্পাসে প্রবেশের চেষ্টা করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হয়ে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে দেন।
এই কর্মসূচির অংশ হিসেবে শহরের বিভিন্ন দেয়ালে আবারও বৈষম্যবিরোধী স্লোগান ও গ্রাফিতি আঁকা হয়।
কুমিল্লা জিলা স্কুল, পৌর পার্ক, শিল্পকলা একাডেমিসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় এ ধরনের দেয়াল লিখন এখনও বর্তমান। এসব দেয়াল লিখনে রয়েছে ‘বিচার চাই’, ‘আন্দোলন থামবে না’, ‘ছাত্র হত্যা বন্ধ কর’ ইত্যাদি বার্তা। শুধু শহরেই নয়, উপজেলার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও এ কর্মসূচি পালন করা হয়।
কুবির বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক সাকিব হোসাইন বলেন, ‘এই আন্দোলন শহর ছাড়িয়ে গ্রাম ও উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পৌঁছে যায়। কুমিল্লা জিলা স্কুল, বোর্ড মডেল কলেজ, ইস্পাহানি পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ময়নামতি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ফকিরবাজারসহ অনেক এলাকায় দেয়ালিকা, চিত্রাঙ্কন, মিছিলসহ বিভিন্নভাবে প্রতিবাদ কর্মসূচি পালিত হয়।’
একই দিন দুপুর ১২টার দিকে কুবির ছয়জন শিক্ষক ‘কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষকবৃন্দ’ ব্যানারে প্রশাসনিক ভবনের সামনে মানববন্ধন করেন। তারা দেশব্যাপী ছাত্র নির্যাতন, শিক্ষক লাঞ্ছনা এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সহিংস দমন নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান।
কুবির বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. কামরুন নাহার শিলা, নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শামীমা নাসরিন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী এম আনিছুল ইসলাম, একই বিভাগের শিক্ষক মাহবুবুল হক ভুঁইয়া, ফার্মেসি বিভাগের শিক্ষক জয় রাজবংশী এবং বাংলা বিভাগের প্রভাষক গোলাম মাহমুদ পাভেল এ মানববন্ধন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
ড. কামরুন নাহার বলেন, ‘১৮ জুলাই কোটা সংস্কার আন্দোলনে আমার সন্তান আহত হয়। একজন মা হিসেবে আমি যে যন্ত্রণা অনুভব করেছি, তা বলার ভাষা নেই। যে মায়েরা তাঁদের সন্তান হারিয়েছেন, তাঁদের ব্যথা আরও বেশি। শিক্ষক হিসেবে শুধু নয়, একজন মা হিসেবেও আমি এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছি।’
তিনি জানান, মানববন্ধনে অংশ নিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে শিক্ষকরা বাধার সম্মুখীন হন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতা-কর্মীরা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে অবস্থান নিয়ে শিক্ষকদের বাধা দেয় বলে তাঁরা অভিযোগ করেন।
এদিকে শহরের পলিটেকনিক মোড়, ক্যাডেট কলেজ মোড় এবং আনসার ক্যাম্পের সামনে বিভিন্ন যানবাহনে তল্লাশি চালিয়ে যাত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
ওই সময়ে দেশে ছাত্র আন্দোলন ঘিরে সহিংসতা, দমন-পীড়ন ও লাঞ্ছনার ঘটনার প্রেক্ষাপটে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের এই প্রতিক্রিয়া বিশেষ গুরুত্ব পায়।
কুমিল্লার শিক্ষক সমাজের একাংশের মতে, ‘এই আন্দোলন কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়; বরং এটি একটি নৈতিক ও মানবিক আন্দোলন। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী উভয়ের নিরাপত্তা এবং মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা করাই ছিল ওই সময়ের দাবি।’
‘জুলাই অভ্যুত্থান ২০২৪’ উপলক্ষে দেশজুড়ে চলমান এই কর্মসূচিগুলোর প্রেক্ষাপটে কুমিল্লা এক প্রতীকী কেন্দ্রে পরিণত হয়। যেখানে শিক্ষার্থী ও শিক্ষক উভয় পক্ষই প্রতিরোধের ভাষা খুঁজে নিচ্ছেন দেয়াল লিখন থেকে শুরু করে মুখে কালো কাপড় বাঁধা প্রতিবাদে।