মাকে বলেছিলাম- যদি বেঁচে থাকি বিকেলে ফোন দেব, নয়তো জান্নাতে দেখা হবে : নূর নবী

বাসস
প্রকাশ: ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৪১ আপডেট: : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১৭:১৩
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমন্বয়ক নূর নবী। ছবি : ফেসবুক

সাইফুল ইসলাম

ঢাকা, ৩ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : ‘আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন পরিবারের সাথেও যোগাযোগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। মাথায় তখন একটাই ভাবনা- যেকোন মূল্যে স্বৈরাচারের বিদায় ঘটাতে হবে। তেমনি একদিন আন্দোলনের মাঠে নামার আগে মাকে আর ভাইকে ফোন করে বলেছিলাম- ‘যদি বেঁচে ফিরি, বিকেলে ফোন দেব, আর না ফিরলে, জান্নাতে দেখা হবে’। এভাবেই শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটত আন্দোলনের দিনগুলো।’

২০২৪ সালের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ দিনগুলোর কথা বর্ণনা করতে গিয়ে কথাগুলো বলছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান সমন্বয়ক নূর নবী। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৯-২০ সেশনের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে মাস্টার্সের দ্বিতীয় সেমিস্টারে অধ্যয়নরত নূর নবী।

আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে নানা নির্যাতনের শিকার হন তিনি। রিমান্ডের নামে সাজানো নাটকের মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিক নিপীড়নের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয়েছে। এমন কি ক্রসফায়ারে দিতে নেওয়াও হয়েছিল তাকে।

কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার সুলতানপুর গ্রামে জন্ম নূর নবীর। ছোট বেলা থেকেই পড়াশোনায় মনোযোগী নূর নবী স্বপ্ন দেখতেন একটি বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থার।

সুলতানপুর ফাজিল মাদরাসায় পড়াশুনার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষেই প্রশাসনের কাছে তাকে ‘জঙ্গি’ ও ‘শিবির’ ট্যাগের শিকার হতে হয়। যদিও কোনো প্রমাণ ছিল না, তবুও রাজনৈতিক পটভূমির কারণে তাকে বহিষ্কারের চেষ্টাও করা হয়।

সম্প্রতি জাতীয় বার্তা সংস্থা বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)-এর প্রতিবেদক সাইফুল ইসলামকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে তার সম্পৃক্ততা ও আন্দোলনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার নানা দিক তুলে ধরেন নূর নবী। নিচে তাঁর সঙ্গে আলাপের বিস্তারিত তুলে ধরা হলো :

২০২৪ সালের ১৯ জুলাই শুক্রবার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে তাকে তুলে নেয় ডিবি পুলিশ। এর বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি জানান, আমরা কয়েকজন সকাল ১১টার দিকে মিছিল করতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গেইটে যাই। পুলিশের অবস্থান সেখানে আগে থেকেই ছিল। একটা সময় ডিবি এবং দাঙ্গা পুলিশ মিলে আমাদের প্রায় ১৫ থেকে ২০ জন ছাত্রকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলে। তখন আমরা বুঝে যাই এখন পেছনে ফেরার কোনো উপায় নেই। এখান থেকে বাঁচব, না হয় মরব, এই দুইটাই এখন সামনে।’

নূর নবী বলেন, ‘তখন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহাঙ্গীর আলম স্যার বললেন, ‘আমি তোমাদের সেফ এক্সিট দেব, সবাই আমার সঙ্গে বের হয়ে যাও।’ আমি তখন সামনে না গিয়ে সবার শেষে থেকে যাচ্ছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম, সবাই যেন নিরাপদে যায়, আমি পেছনে থেকে দেখি কেউ আটকে গেল কিনা। ঠিক তখনই ডিবি’র কয়েকটি গাড়ি এসে দাঁড়ায়। সেখানে একজন কর্মকর্তা আমার বাম হাত শক্ত করে ধরে, কারণ ডান হাতটা আগে থেকেই ভাঙা; স্লিং দিয়ে গলায় ঝোলানো ছিল। ডান হাতে ধরা সম্ভব ছিল না।’

আমাকে গাড়িতে তোলে। উঠানোর আগ মুহূর্তে ওই কর্মকর্তা চিৎকার করে বলে-‘গুলি করো! গুলি করো! একটাও যেন বাঁচে না, শু*রের বাচ্চারা।’ তখন আমার পেছনের ভাইয়েরা এগিয়ে আসছিল, ওদের ওপরও গুলি করা শুরু হয়।

গাড়িতে ওঠার পর থেকেই আমাকে মারতে শুরু করে। আমি বুঝে গিয়েছিলাম এখান থেকে যদি কেউ না দেখে আমাকে নিয়ে যায়, তাহলে তারা আমাকে গুম করে ফেলতে পারে। তাই আমি চিৎকার করে ভাইদের ডেকে বলি, ‘ভাইয়েরা, আমাকে নিয়ে যাচ্ছে।’ এই কথার পর পুলিশ আরো রেগে যায়। বলে- ‘তুই কি নেতা হয়ে গেছিস? হাত নেড়ে সবাইকে দেখাচ্ছিস?’

এরপর শুরু হয় অমানবিক টর্চার। মিন্টো রোডের ডিবি অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। তিন পটি কাপড় দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলে, পুরো শরীর থেকে কাপড় খুলে নেয়। আমি তখন একা। একদম নির্জন, অন্ধকারে। প্রথমে চেয়ারে বসায়, পরে দাঁড় করিয়ে শরীরে ইলেকট্রিক শক দেয়। প্রস্রাবের মাধ্যমে একটা শক দেয়। শরীর তখন কাঁপতে থাকে, পড়ে যাই মেঝেতে। ইনজেকশন দেয় বাম হাতে। এরপর শুরু হয় বেধড়ক পিটুনি।

বাম হাতে লাঠির মতো কোনো কিছু দিয়ে প্রচণ্ড জোরে চাপ দেয়। বলে: ‘এক হাত তো ছাত্রলীগ ভেঙেছে, আরেকটা আমরা ভাঙব।’ তারা জানতো, আমার ডান হাত ভাঙা।

তারপর আমার মায়ের সঙ্গে করা ফোনকল চালিয়ে দেয়। যেখানে বলেছিলাম: ‘বেঁচে থাকলে বিকেলে ফোন দিব, না হলে জান্নাতে দেখা হবে।’ তখন ওরা বলে- ‘তুই শিবির না হলে এমন কথা বলতে পারিস না।’

আবার শুরু হয় মারধর। তারা বলে: ‘তোর স্যাররাই তো বলেছে তুই শিবির করিস। তুই জঙ্গি।’ তখনই আমি বুঝি, আমার তথ্য আমাদের ইউনিভার্সিটি থেকেই গেছে। ডিবির ডিসি বলে: ‘ওকে বাদ দাও। ইসলামিক স্টাডিজের আরও কয়েকটারে ধরে আনো।’ তখনই বুঝি, এটা শুধু রাজনৈতিক না, এটা ধর্মীয় বিদ্বেষও।

সন্ধ্যা ৭টার দিকে আবার আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়। চোখ বাঁধা ছিল, আমি জানি না কোথায়। সেখানে আমাকে হাঁটুর ওপর বসায়। তারপর চোখের কাপড় একটু খোলে। বলে: ‘রায়েরবাগে পুলিশ ঝুলিয়ে রেখেছে, লক্ষ্মীবাজারে চারজন মারা গেছে, এগুলোর দায় তোদের।’ আবার শুরু হয় পিটুনি। চিত করে শোয়ায়, বুকের নিচে হাত রেখে। পায়ের তলা থেকে পিঠ পর্যন্ত সব জায়গায় পিটায়। তারপর ডিবির গারদে নিয়ে যায়।

পরদিন রাত ২০ তারিখে আমাকে শাহবাগের দিকে নিয়ে যাওয়া হয়। বলে : ‘তোরে ক্রসফায়ারে  দেব। গোসল করে নে।’ ডিবি হারুন আমার পাশে এসে বলে: ‘ও এখনো বেঁচে আছে কেন? এখনই ক্রসফায়ার দাও।’

নূর নবী বলেন, ‘২০ তারিখের দিনটা কিভাবে কেটেছে তা মনে নেই, শুধু মনে আছে রাত ১১টা বা ১২টার দিকে এক সময় আমাদের চোখ বেঁধে একটি গাড়িতে তোলা হয়। সেসময় আমাদের ধারণা ছিল, এবার হয়তো সব শেষ। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ, নিজাম নামের একজন, আরেকজনের নাম মনে নেই; আমরা চারজন ছিলাম। মাসুম ভাই বলছিলেন, ‘ভাই, এর আগে যারা গেছে, তারা আর ফিরে আসেনি। আমাদেরও হয়তো এবার ক্রসফায়ারেই দেবে।’

এরপরই ঘটে নাটকীয় ঘটনা। শাহবাগের ফুলের দোকানের পাশে একটা ফাঁকা জায়গায় গাড়ি থামিয়ে আমাদের নামিয়ে দেয়। সেখানে আমাদের সামনে ২৫ থেকে ৩০ রাউন্ড গুলি ছোড়ে। তারপর চোখ খুলে দেয়। আমাকে হাতে একটা বস্তা ধরিয়ে দেয়, পরে শুনেছি, ওই বস্তায় ককটেল ছিল। আরেকজনের হাতে দেয় শর্টগান। বাকি দুইজনকে দাঁড় করিয়ে রাখে। সাজানো একটা মামলার নাটক মঞ্চস্থ হয় সেখানে- ছবি তোলা হয়, ভিডিও করা হয়। এরপর আমাকে আদালতে তোলা হয় এবং তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়।

রিমান্ডের অভিজ্ঞতা নিয়ে নূর নবী বলেন, আগের নির্যাতনের রেশ ছিল শরীরে। কিন্তু সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল শক। শক দেওয়ার সময় ব্যথা টের পাইনি, টের পাই পরে। শক দেওয়ার পরে শরীরটা অবশ মনে হতো। ওখানে কোনো চিকিৎসা ছিল না।

আদালত চত্বরে গিয়ে দেখি, আমার পাশে কেউ নেই। না আইনজীবী, না পরিবার। পরে শুনি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলনকারীদের জন্য যারা স্বেচ্ছায় আইনজীবী হয়েছিলেন, তারাই দাঁড়িয়েছেন। আমার পক্ষে দাঁড়ান এডভোকেট মুজাহিদুল ইসলাম, যাকে আগে চিনতাম না।

আন্দোলনের সূচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুতে ছিল ৫৬% কোটা বাতিল করে মেধাভিত্তিক নিয়োগ নিশ্চিত করার নিছকই একটি ন্যায়সঙ্গত দাবি। এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের ছিল না, ছিল আপামর সাধারণ ছাত্রজনতার আন্দোলন। সেই জায়গা থেকেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও এই দাবির পক্ষে সোচ্চার হয়।

প্রথমদিকে নুর নবী সরাসরি নেতৃত্বে আসেননি। রাজনৈতিক ট্যাগ থাকার কারণে তিনি চাননি আন্দোলন প্রশ্নবিদ্ধ হোক। তবে ৩০ জুন ঢাকায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে যখন সারাদেশব্যাপী আন্দোলনের পরিকল্পনা হয়, তখন থেকেই তিনি সংগঠক হিসেবে যুক্ত থাকতে শুরু করেন।

জুলাইয়ের ১ তারিখে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও নিয়মিত মিছিল, সমাবেশ অনুষ্ঠিত হতে থাকে। কিন্তু ১১ জুলাই কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে পুলিশের গুলিতে শিক্ষার্থীরা আহত হওয়ার পর পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। জগন্নাথে নেতৃত্বে সংকট তৈরি হয়, অনেকে আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই পেছনের সারির কর্মী নুর নবী সাহসিকতার সঙ্গে সামনে আসেন। নিজের রাজনৈতিক ট্যাগের ভয়কে উপেক্ষা করে তিনি নেতৃত্ব দেন আন্দোলনে। তার নেতৃত্বে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় নামে। এবার আর পিছু হটার সুযোগ ছিল না।

তিনি জানান, ‘আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া নিয়মিত যোগাযোগ রাখত। আমরা জানতাম, কখন কোথায় দাঁড়াতে হবে। কীভাবে এগোতে হবে। আমরা শুধু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলাম না, আমরা ছিলাম সময়ের দাবি আদায়ে সোচ্চার একদল নির্ভীক যোদ্ধা।’

নূর নবী বলেন, ‘১৪ জুলাই দেশের প্রতিটি শিক্ষার্থীর হৃদয়ে তখন একটি স্পন্দন: বৈষম্যের অবসান। বৈষম্যের অবসানের পরিকল্পনা হিসেবে সেদিন রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার থেকে স্মারকলিপি দেওয়ার মিছিল শুরু হবে। সেই অনুযায়ী আমরা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশাল একটি মিছিল নিয়ে রওনা দেই। আমাদের মিছিলটা এত বড় ছিল, অনেকেই বলেছিল- এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিছিলের চেয়েও বড়। আমরা যখন একত্রিত হই, তখন শহরের বুক কাঁপিয়ে দিয়েছিল শিক্ষার্থীদের কণ্ঠস্বর।’

তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির বাসভবনে যাওয়ার পথে গুলিস্তানে কৃত্রিম জ্যাম তৈরি করা হয়, পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে পড়ে মিছিল। সেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণা রিয়া যেভাবে সামনে গিয়ে পুলিশের চোখে চোখ রেখে দাঁড়িয়েছিল, সেটা কোনো ছবি না, সেটা একটা জ্বলন্ত ইতিহাস। আলজাজিরার প্রথম পাতায় যখন ওর ছবি ছাপা হলো, তখন আমরা বুঝেছিলাম, আমরা কেবল রাজপথে না, ইতিহাসের পথেও হাঁটছি।’

স্মারকলিপি দিয়ে আমরা ক্যাম্পাসে চলে আসি। আসার পর দেখি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষার্থীদেরকে ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে সম্বোধন করেন। তার এই কথাটা কেউ মেনে নিতে পারেনি। তখন শিক্ষার্থীদের মধ্যেও হাসিনার বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ জন্ম নেয়।

নূর নবীর গলা তখনও কাঁপে, সে বলেন ‘একজন রাষ্ট্রপ্রধান, দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রাজাকার বলেছে আমরা চুপ থাকতে পারিনি। রাত ১২টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাস্তায় নেমে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র ছাত্রী হলের মেয়েরা হলের গেটের তালা ভেঙে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে আসে এবং তাঁতীবাজার মোড় অবরোধ করে। এ সময় শিক্ষার্থীরা ‘তুমি কে? আমি কে?/ রাজাকার, রাজাকার/কে বলেছে? কে বলেছে?/স্বৈরাচার! স্বৈরাচার!!’  স্লোগান দিয়ে তাদের ক্ষোভের প্রকাশ ঘটায়।

নূর নবী বলেন,  ১৫ জুলাই ঘোষণা ছিল দুপুরে আবার মিছিল হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে যখন মিছিল জড়ো হয়, তখন উপস্থিতির দিক থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে। ‘ওদের হল বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল, শিক্ষার্থীরা আসতে পারেনি। কিন্তু আমরা ছিলাম। আমরা জানতাম, এটা শুধু একটা মিছিল না, এটা ইতিহাসের সামনে দাঁড়ানোর সময়।’

কিন্তু সেই মিছিল আর শান্ত থাকেনি। সূর্যসেন হল, বিজয় ৭১ হল, জিয়া হল এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় ছাত্রলীগের সমন্বিত হামলার শিকার হই। ‘ওরা আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে।’

নূর নবীর কণ্ঠে ক্ষোভ নয়, গর্ব। ‘সেদিন আমরা শুধু ন্যায়বিচারের জন্য দাঁড়াইনি, দাঁড়িয়েছিলাম দেশের প্রতি সম্মান, নিজের পরিচয় আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার রক্ষার জন্য। আর আমরা চিৎকার করে বলেছিলাম: আমরা কেউ রাজাকার নই।’

১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগের সশস্ত্র হামলার ঘটনায় ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বিবরণ দেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা নূর নবী। তার ভাষ্যমতে, ওই দিন শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে আক্রমণ চালানো হয়, যার ফলে বহু শিক্ষার্থী গুরুতর আহত হন।

নূর নবী জানান, আন্দোলনের আগের দিনই হামলার প্রস্তুতি হিসেবে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে টাকা বিতরণ করা হয়। তিনি বলেন, ‘পলকের দেওয়া অর্থ বিতরণের ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়। আমাদের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। অথচ ওদের হাতে ছিল সব।’

তিনি আরও জানান, মাইকে আন্দোলনকারীদের ভিসি চত্বরে অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়, যাকে ‘সেফ জোন’ হিসেবে দাবি করা হচ্ছিল। আন্দোলনে অংশ নেওয়া অধিকাংশই ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ছাত্রী ছিলেন।

তখন মেয়েরা সূর্য সেন হলের সামনে আটকে পড়ে, কারণ সামনে তাদের সুরক্ষার জন্য কোনো পুরুষ আন্দোলনকারী ছিল না। এ সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সামনে গিয়ে ছাত্রীদের প্রটেকশন দেয় এবং ধীরে ধীরে ভিসি চত্বরে অবস্থান নেয়।

এমন সময় ছাত্রলীগের সদস্যরা হঠাৎ দেশিয় অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ চালায়। রড, কাঠের বাটাম, গাছের শিকড় নিয়ে তারা দৌড়ে আসে। আন্দোলনকারীরা প্রাণ বাঁচাতে পিছু হটে গিয়ে দুটি লাল বাসের ছাঁদের নিচে অবস্থান নেয়। সেখানে অবস্থানকারী অধিকাংশ শিক্ষার্থী ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের। উপর থেকে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ শুরু হয়।

অনেকের মাথা ফেটে যায়, রক্ত ঝরে পড়ে টাইলসে। নূর নবী বলেন, ‘পরিস্থিতি এমন ছিল যে, মনে হচ্ছিল সূর্যসেন হল থেকে আজরাইল নেমে আসছে আমাদের ওপরে।’

প্রায় আধা ঘণ্টা ধরে চলে টার্গেটেড মারধর ও ইট নিক্ষেপ। একসময় ছাত্রলীগ সদস্যরা ঘোষণা দেয়: ‘তোমরা চলে যাও, কিছু করব না।’ এরপর আহত আন্দোলনকারীরা ধীরে ধীরে বের হয়ে যেতে থাকে। নূর নবী বলেন, ‘ঠিক ফুটবল খেলার আগে জাতীয় সংগীত গেয়ে খেলোয়াড়রা যেভাবে একে একে মাঠে নামে, আমরাও ঠিক তেমনভাবে বের হচ্ছিলাম। আর তারা একে একে আমাদের পেটাচ্ছিল।’

এ সময় গুরুতর আহত হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রফ্রন্টের আহ্বায়ক ইভান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সহ-সংগঠক সিয়ামসহ অনেকে। সিয়ামের মাথা ফেটে যায়, সেই ছবি পরে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়।

নূর নবী নিজেও ডান হাতে গুরুতর আঘাত পান এবং ঢাবির মূল ফটকের কাছাকাছি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। জ্ঞান ফিরে দেখেন তিনি রিকশায় রায়সাহেব বাজার মোড়ে। পাশে ছিলেন জবি’র ‘অগ্নিকন্যা’ খ্যাত স্বর্ণা রিয়া, যিনি তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান।

তবে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগে ছাত্রলীগ হামলা চালাতে পারে এমন খবরে তাকে আবার ফিরিয়ে এনে নেওয়া হয় ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সন্ধ্যায় সেখানে হামলা হতে পারে এমন আশঙ্কায় তাকে সেখান থেকে সেফ জোনে সরিয়ে নেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ‘আমার ডান হাত ভেঙে গেলেও তখনো প্লাস্টার করা হয়নি। সেই রাতে আমাকে একটি ফ্যামিলি বাসায় আশ্রয় দেওয়া হয় এবং একজন ডাক্তার সেখানে এসে আমার হাতের প্লাস্টার করেন।’

নূর নবী বলেন, ‘এখনো ঢাবি ক্যাম্পাসে গেলে কান্না পায়। সহ্য করতে পারি না। এমন ভয়াবহতা আগে কখনো দেখিনি।’ সেদিন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারটি বাসে করে আসা ছাত্রলীগ কর্মীরা এ হামলায় অংশ নেয় এবং নারী শিক্ষার্থীদের ওপরও শারীরিক হামলা চালায়।

নূর নবী বলেন, ‘১৫ জুলাইয়ের ঘটনার পর আমরা বুঝে যাই, এটা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন হামলা নয়; এর পেছনে সুস্পষ্ট রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে। আমরা সিদ্ধান্ত নিই, ১৬ জুলাই রাজপথে বিক্ষোভে নামব।’ পরদিন ১৬ জুলাই দুপুর ২টার দিকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিলের উদ্যোগ নেয়।

এই সময় ভিক্টোরিয়া পার্কে যুবলীগের একটি আন্দোলন বিরোধী সমাবেশ চলছিল। অভিযোগ রয়েছে, যুবলীগ কর্মীরা পার্কের ভেতরে দুইজন শিক্ষার্থীকে অবরুদ্ধ করে রাখে।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের উদ্ধারে এগিয়ে যায় এবং সেখান থেকে বিক্ষোভ আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করে।

নূর নবী বলেন, বিক্ষোভ মিছিল ক্যাম্পাস থেকে শুরু হয়ে তাঁতিবাজারের দিকে এগিয়ে গেলে, সিএমএম কোর্ট চত্বরের ভেতর থেকে কাউন্সিলর ছোটন এবং তার সহযোগীরা সরাসরি আমাদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়। এতে আমাদের চারজন ভাই- অনিক, ফেরদৌস, নাসিম ও নাইম গুলিবিদ্ধ হন।’

এই ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা তাঁতিবাজার মোড়ে প্রায় ছয় ঘণ্টা অবস্থান নেয়। সন্ধ্যার দিকে আমরা ক্যাম্পাসে ফিরে আসি। তবে রাতে একটি ঘটনা আন্দোলনের গতি ও গভীরতা বাড়িয়ে দেয়। ‘আমরা সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ভিডিও দেখি। জানতে পারি, আবু সাঈদ আর নেই। সেই সাথে আমাদের আরো ছয়জন ভাই শহীদ হয়েছেন। এই খবরে পুরো ক্যাম্পাস শোক ও ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে।’

পরদিন ১৭ জুলাই, শিক্ষার্থীরা আরও বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনে নামে। তারা ছয় দফা দাবি উত্থাপন করে। 

দাবিগুলোর মধ্যে ছিল: ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধকরণ, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা, মেয়েদের হল থেকে উচ্ছেদ বন্ধ, এবং প্রক্টর ও পরিবহন প্রশাসনের পদত্যাগ।

‘আমরা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলাম, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগকে সহায়তা দিয়েছে বাস দিয়েছে, অস্ত্র তুলে দিয়েছে। 

এর দায় প্রশাসনকেও নিতে হবে,’ নূর নবী বলেন।

১৭ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় গায়েবানা জানাজা। এতে আবু সাঈদসহ শহীদদের স্মরণে হাজারো শিক্ষার্থী অংশ নেয়। 

আন্দোলন তখন শুধুমাত্র একটি ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে নয়, বরং একটি নির্দিষ্ট দমননীতি ও রাষ্ট্রীয় সহিংসতার প্রতিবাদে রূপ নেয়।

নূর নবী বলেন, ‘আমরা সন্ধ্যার পর সিদ্ধান্ত নিই ১৮ জুলাই ধোলাইপার মোড়ে বৃহৎ সমাবেশ করব। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল দক্ষিণ ঢাকা ও আশপাশের এলাকাগুলোতে সরকারপন্থী শক্তিকে প্রতিরোধ করা এবং জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।’

তবে ওই রাতেই পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়ে পড়ে। পুলিশ অভিযানের প্রস্তুতি নেয় বলে খবর আসে। নূর নবী জানান, তৎকালীন ছাত্রশিবিরের এক নেতা তাকে সতর্ক করেন।

তিনি বলেন, তুমি রাতেই বাসা ছেড়ে নদীর ওপারে চলে যাও। তোমার বাসায় রেড হবে। আমি বের হবার সাথে সাথেই পুলিশ আমার মেসে রেড দেয়।

নূর নবী বলেন, ১৮ জুলাই দুপুর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা অপেক্ষা করলেও নেতৃত্ব সংকট এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে সেদিনের মিছিল আর সংগঠিত করা সম্ভব হয়নি।

তবে তিনি বলেন, ‘আমরা মাঠে নামতে না পারলেও প্রতিরোধের চেতনা সেদিন পুরো শহরজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছিল। এরপর ছাত্রলীগ আর কোনোদিন ক্যাম্পাসে সাহস করে ফিরে আসেনি।’

২৩ তারিখে রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠানো হয়। নির্যাতনের মাঝেই হাসনাত, নাহিদসহ অন্যদেরও তুলে আনার খবর তাকে জানানো হয়।

নূর নবী বলেন, ২৩ জুলাই আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগার কেরানীগঞ্জে পাঠানো হয়। কারাগারে আমার স্থান হয়েছিল মেঘনার তিন নম্বর ভবনের দুই নম্বর ওয়ার্ডে। কারাগারে চিকিৎসা তো দূরের কথা, একজন মানুষের ন্যূনতম অধিকারটুকুও যেন বিলাসিতা। কারাগারে প্রবেশ করার সময় আমার দুই হাত ভাঙা ছিল। শরীরজুড়ে অসহনীয় ব্যথা।

বাম কিংবা ডান কাত হয়ে শোয়া তো দূরের কথা, চিত হয়েও ঘুমাতে পারতাম না। পিঠে, উরুতে, নিতম্বে অসহনীয় যন্ত্রণা। নিদ্রা যেন নিষিদ্ধ কোনো বিষয় ছিল সেখানে।

তিনি বলেন, চিকিৎসার জন্য বারবার অনুরোধ করলেও তারা কর্ণপাত করত না। পাঁচ-ছয় দিন পর একজনের সুপারিশে কারা হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু ওরা কোনো অ্যানেস্থেশিয়া না দিয়েই একটা ছোট অপারেশন করে হাতের ভাঙা হাড়ের গুঁড়োগুলো পরিষ্কার করে। একটা সিম্পল এলবো ব্যাগ ঝুলিয়ে দিয়েছিল। এরপর আর কোনো চিকিৎসা হয়নি।

নূর নবী বলেন, কারাগারে সেলের বাইরে যাওয়ার অনুমতি ছিল না। সেই সময় আরো অনেক শিক্ষার্থী গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আসছিল। তাদের কেউ কেউ যখন আমার সঙ্গে দেখা করত, তখন ইনচার্জ এসে আমাকে হুমকি দিত, তোমার কাছে যদি কেউ দেখা করতে আসে, তাহলে তোমাকে কনডেম সেলে পাঠানো হবে, যেখানে একা থাকতে হবে, কোনো যোগাযোগ থাকবে না।

তিনি বলেন, সবচেয়ে স্মরণীয় দিন ছিল ৫ আগস্ট। সকাল ৯টার দিকে জেলার ঘোষণা দিয়েছিলেন, বাইরের পরিস্থিতি যাই হোক, আমরা ভেতরে শান্তিপূর্ণ থাকব। সবকিছু আপনাদের জানানো হবে। তারা বুঝে গিয়েছিলেন বাইরে বড় কিছু ঘটে গেছে।

নূর নবী বলেন, ৫ আগস্ট বিকেল চারটার দিকে প্রথম খবর আসে ‘শেখ হাসিনা পালিয়ে গেছেন।’ এই ঘোষণার পর মুহূর্তেই বন্দিদের মধ্যে আন্দোলন শুরু হয়। তাদের চিৎকারে পুরো বিল্ডিং যেন কাঁপছিল!

৫ আগস্ট স্বৈরাচার পতনের দিনটিকে জীবনের সবচেয়ে আননন্দের দিন উল্লেখ করে নূর নবী বলেন, ‘সেদিন কী যে আনন্দ হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়।’ কিন্তু কারাগারে থাকায় সহযোদ্ধাদের নিয়ে সেদিনের আনন্দ উদ্যাপনের সুযোগ পাননি বলে এক ধরনের কষ্টও আছে তার।

পরদিন ৬ আগস্ট বিকেল সাড়ে পাঁচটায় তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু শারীরিক অসুস্থতার কারণে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর সরাসরি তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এখনো চিকিৎসা নিতে হচ্ছে বলে জানান তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সাইয়েদ আবদুল হাই মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ডের মূলধন বৃদ্ধি
পথ ভুলে পঞ্চগড়ে আসা শিশুটি শ্রীমঙ্গলে বাবা-মায়ের কাছে ফিরে যেতে চায়
বিক্ষোভে উত্তাল ছিল ফেনীর রাজপথ
কুমিল্লায় বাস-অটোরিকশার সংঘর্ষে প্রবাস ফেরত যুবক নিহত, আহত ৪
ব্রিতে স্বেচ্ছায় রক্তদান কর্মসূচি পালন
আমার শহরে জুলাই অভ্যুত্থান / বিক্ষোভ ও প্রতিবাদে উত্তাল সাতক্ষীরার রাজপথ 
ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তালিকাভুক্তির বিষয়ে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা
ময়মনসিংহে ৩ আগস্ট ছিল ছাত্রজনতার ঐতিহাসিক প্রতিরোধের দিন
টেকনিক্যাল, ভোকেশনাল প্রশিক্ষণ উন্নয়নে এডিবির সাথে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি স্বাক্ষর
জুলাই ঘোষণাপত্র জনগণের অধিকার : বাংলাদেশ ন্যাপ
১০