/ আবদুস সালাম আজাদ জুয়েল /
চাঁদপুর, ৪ আগস্ট ২০২৫ (বাসস) : ৪ আগস্ট ২০২৪। স্বৈরাচারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ চেয়ে একদফা দাবিতে সারাদেশে ছাত্র-জনতার অসহযোগ আন্দোলন তখন তুঙ্গে। এসময় আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগও নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় মরিয়া হয়ে ওঠে। আন্দোলনকারীদের দমাতে পুলিশ সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামে। এ পরিস্থিতিতে দফায় দফায় সংঘর্ষে চাঁদপুর শহর রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ।
এসব সংঘর্ষের ঘটনায় ছাত্রলীগ, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, সাংবাদিক ও পুলিশসহ অন্তত দেড়শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়। এদিন আন্দোলনকারীরা সড়কে অবস্থান নিয়ে আওয়ামী লীগ অফিস, সেসময়কার সমাজকল্যাণ মন্ত্রীর বাসার নিচতলা, সড়ক ভবন আগুন এবং ৭১ টিভির জেলা প্রতিনিধির ব্যক্তিগত অফিস ভাঙচুর করে এবং আগুন দেয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ওইদিন সকাল ১০টায় শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকায় অবস্থান নেয় শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টায় ছাত্রলীগের অবস্থান ছিল পার্শ্ববর্তী ইলিশ চত্বরে। এসময় ছাত্রলীগের কর্মীরা শিক্ষার্থীদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এরপর শিক্ষার্থীরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের ধাওয়া করে।
আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ৪ আগস্ট বেলা ১১টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত শিক্ষার্থী ও ছাত্ররা হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ধাওয়া করে। অপরপক্ষও পালটা ধাওয়া শুরু করে। এসময় উভয়পক্ষ থেকেই ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। এতে সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হন।
তারা জানান, বেলা ১টার দিকে ছাত্রলীগ-যুবলীগ পুনরায় সংগঠিত হয়ে শিক্ষার্থীদের ধাওয়া করলে শিক্ষার্থীরা বাসস্ট্যান্ড থেকে আশপাশের এলাকায় আশ্রয় নেয়। পরে শিক্ষার্থীরা ড্রোন উড়িয়ে ছাত্রলীগের অবস্থান নিশ্চিত হয়। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দুপুরের খাবার খাচ্ছিলেন। খাওয়ার সময় শিক্ষার্থীরা তাদের আকস্মিক ধাওয়া করে সরিয়ে দিয়ে আবারও বাসস্ট্যান্ডে অবস্থান নেয়। ওই সময় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপে পুলিশ, সাংবাদিক, ছাত্রলীগ ও অনেক শিক্ষার্থীর অভিভাবক আহত হন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা দুপুরের পর পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় একাত্তর টিভির জেলা প্রতিনিধি আল আমিন ভুঁইয়ার ব্যক্তিগত অফিসে প্রবেশ করে ক্যামেরা, কম্পিউটার, আসবাবপত্র ও বাইরে থাকা মটর বাইক ভাঙচুর করে। এর আগে হামলা থেকে রক্ষা পেতে কয়েকজন সাংবাদিক ঐ অফিসে আশ্রয় নেন।
চাঁদপুর সদর হাসপাতালের গত বছরের এইদিনের রেজিস্ট্রারের তথ্য অনুযায়ী, ৪ আগস্টের সংঘর্ষে আহতরা হলেন; শিক্ষার্থী আশেকে রাসুল যাওয়াদ, আরাফাত সানি, আল হেলাল, সাদ্দাম, আসমা, নাহিদ, দুলাল, ইসরাত, মীম, শাহনারা, সাহীন, মাহিন, হাসান, আমান, দীন ইসলাম, নাজমুল, সুমন, সুমাইয়া আক্তার, আনিকা, জেলিন, মোতাহের, আবুল হোসেন, রাবেয়া, জাওয়াত, শিশির, মাহমুদুল হাসান, সিহাবুল হাসান করিম, জিসান, কুলসুমা, আরাফাত, হারুন, আলাউদ্দিন, রুমি বেগম, মালেক, সবুজ, ওচমান গণি, ফাইজা, অনিক, তানভির, নিলয়, তানভির, শামীম, মিরাজ, শামীম, জাহিদ, মো. রাসেল, মো. রমজান, ইউসুফ, ইয়ামিন, মো. ইউছুফ, আলী আকবর, মিহরাজ, সিয়াম, রমজানি বেগম, রাসেল, হাবিব, অমিত, নোলক, নাছির, তানহা, ফাতেমা, নাজমা, ওসামা, আমেনা, তসাফিয়া, সাদিক, ফয়সাল, মহসিন, টিপু, ইব্রাহিম রনি, রুবেল, স্বপন, বাবু, রাজন মজুমদার, সুমন, জুম্মান, রাসেল, প্রিতম, আরফান, ফয়েজ উল্লাহ ব্যাপারী, ফারুক, আনাছ, পারভেজ, আরাফাত, সোহেল, সেলিম, জোবায়ের, হৃদয়, রাজু, মোরশেদ, আদনান, সিয়াম, তারিফ এবং অভিভাবক স্বপন।
পুলিশের মধ্যে আহতরা হলেন; চাঁদপুর সদর মডেল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) সেলিম, কনস্টেবল আমেনা বেগম, রুপা, লাভলী, ওবায়েদ উল্লাহ ও মুক্তা।
সাংবাদিকদের মধ্যে আহত হন-এনটিভির জেলা প্রতিনিধি শরীফুল ইসলাম, একাত্তর টিভির জেলা প্রতিনিধি আল-আমিন, ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভির জেলা প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান বাবলু, দীপ্ত টিভির জেলা প্রতিনিধি ইব্রাহীম রনি, ঢাকা টাইমস এর জেলা প্রতিনিধি মাজহারুল ইসলাম অনিক, দৈনিক ইলশেপাড় পত্রিকার বার্তা সম্পাদক এস.এম. সোহেল এবং সময় টিভির ক্যামেরা পার্সন নীরব।
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, এদিন বিকেলে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সাথে বহিরাগতরা প্রবেশ করে ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটায়। তারা ডিসি অফিস সংলগ্ন সড়ক, মিশন রোড, নতুন বাজার, কালিবাড়ী, ছায়াবানী, সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ডা. দীপু মনির বাসার নিচতলার জেলা আওয়ামী লীগ অফিসে আগুন দেয়। এর পরপরই তারা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শাহির হোসেন পাটওয়ারীর বাড়ি, যুবলীগের আবু পাটওয়ারীর অফিস, জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি জহির হোসেন মিজির ব্যক্তিগত অফিস ভাঙচুর করে। তারা মিশন রোড এলাকায় বেশ কয়েকটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটায়।
চাঁদপুর জেলা বন্দর কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ওইদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চাঁদপুর লঞ্চঘাট থেকে মাত্র ৪টি যাত্রীবাহী লঞ্চ ঢাকা সদরঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানায়, এদিন চাঁদপুরের সাথে সারাদেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল।
স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, চাঁদপুর-কুমিল্লাসহ আন্ত:জেলা সকল পরিবহণ বন্ধ ছিল। শুধু শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা, ব্যাটারি চালিত অটো বাইক ও রিকশা চলাচল করেছে। তবে তার সংখ্যাও ছিল খুব কম। সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল আতঙ্ক। জেলা প্রশাসক ও জেলা জজ আদালতের দুটি গেট বন্ধ ছিল। প্রশাসনের লোকজন কোন গাড়ি নিয়ে অফিসে আসেননি। শহরের খাবারের দোকান ছাড়া অধিকাংশ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল।
এদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে এবং আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের আশপাশে অবস্থান নেয় পুলিশ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সংঘর্ষ এলাকায় পুলিশের সাথে দায়িত্ব পালন করেন সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আল-এমরান খাঁন। দুর্বৃত্তরা তার দপ্তরেও ভাঙচুর চালায়।
বাসস্ট্যান্ড এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রত্যক্ষদর্শী আবদুল বারেক ও স্বপন জানান, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদার হওয়ায় অনেক অভিভাবকও আন্দোলনে এসে যুক্ত হন। পাশাপাশি ছাত্রলীগের সাথে যুক্ত হয় যুবলীগ। উভয় পক্ষের সংঘর্ষে বাসস্ট্যান্ড এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে নিজেরাও আহত হন। জেলার আইনশৃঙ্খলা অনেকটাই ভেঙে পড়ে। বিভিন্ন স্থানে অবরুদ্ধ হয় শিক্ষার্থীরা।
এদিন সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী ও সাধারণ নাগরিকদের গণহত্যার বিচার, গায়েবি মামলা, গণগ্রেপ্তার ও নির্যাতন বন্ধে চাঁদপুরে প্রতিবাদ এবং মানববন্ধন করে জেলার আইনজীবীরা। বেলা সাড়ে ১০টায় চাঁদপুর জেলা জজ আদালত চত্বরে সচেতন আইনজীবী সমাজের ব্যানারে ঘণ্টাব্যাপী এই কর্মসূচি পালন করা হয়।