ভোলায় পুলিশের গুলিতে নিহত হন ছাতার কারিগর মো. জসিম উদ্দিন 

বাসস
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৫:২৪
৪ আগষ্ট ২০২৪, চারদিকে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদে উত্তাল ভোলার রাজপথ। ছবি: বাসস

\ আল-আমিন শাহরিয়ার \

বাসস, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস) : দিনটি ছিল ৪ আগষ্ট ২০২৪ ইং। চারদিকে বিক্ষোভ আর প্রতিবাদে উত্তাল ভোলার রাজপথ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্রজনতার খন্ড খন্ড মিছিলে প্রকম্পিত প্রত্যান্তঞ্চল। একদিকে পুলিশের আক্রমণ, আরেকদিকে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের স্বশস্ত্র হামলা, গুলি আর বোমার বিস্ফোরণ, বিক্ষুব্ধ ছাত্র জনতার রাজপথ দখল। ফ্যাসিষ্টদের সাথে ছাত্রজনতার তুমুল সংঘর্ষ চলছিল। থেমে থেমে পুলিশের গুলি, ছাত্রলীগের বোমা হামলা আর মুক্তি পাগল মানুষের হাতে প্রতিরোধের লাঠি আর জীবন রক্ষার ঢাল। সব মিলিয়ে দিনটি ছিলো রণাঙ্গনের ভোলা। 

সকালের সূর্য উঠার আগেই প্রতিবাদী সূর্য সন্তানরা জীবন বাজি রেখে ভোলার রাজপথ নিজেদের দখলে নেয়। তখনও অত্যাচারী হায়েনার দলের ঘুম ভাঙ্গেনি। 

প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনানুযায়ী, ওইদিন সকাল সাড়ে দশটার মধ্যেই পুলিশ আর অস্ত্রধারী আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী শহরের বাংলা স্কুল মোড় ও সদর রোডে অবস্থান নেয়। মুক্তিকামী ছাত্র জনতা ও বিএনপি, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির আর বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ অবস্থান নেয় কালীনাথ রায়ের বাজার নামক এলাকায়। দু'পক্ষের মধ্যে দিনভর চলে দফায় দফায় সংঘর্ষ। মুহুর্মুহু গোলাগুলিতে পুরো ভোলা শহর যেনো যুদ্ধের নগরীতে রুপ নেয়। বিক্ষুদ্ধ ছাত্রজনতা নিজেদের শক্তি সামর্থ্যের সবটুকুই জানানা দিয়েছিলো ওইদিন। তুমুল সংঘর্ষের দামামায় জনতাকে দমাতে আসা পিচাসরা পিছু হটতে বাধ্য হয়। জেলা আওয়ামী লীগ অফিসটি পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। 

ওইদিন সকাল থেকে টানা সংঘর্ষে পুলিশ ও আওয়ামী দূর্বৃত্তদের আক্রমনে বহু মানুষ আহত হয়েছিল। দিন গড়িয়ে বেলা যখন দুইটা, তখন শহরের নতুন বাজার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা অফিসের সামনে একটি প্রাইভেট কারে আগুন জ্বলছিল। পুড়ছিল ডিসি অফিসের ক'টি কক্ষ আর শ্রমিকলীগ অফিস।

গণমাধ্যমকর্মীরা খবর ও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহে ছুটোছুটি করছেন। তাদের মধ্যে একজন সাহসী পেশাদার সাংবাদিক আশরাফুল আলম সজিবও ছিলেন সংবাদ সংগ্রহে ব্যাস্ত। তার দৃষ্টিতে ওইদিনের সহিংসতার প্রতিটি মূহুর্ত ছিলো গা শিউরে উঠার মতো। ভয়ঙ্কর ওইদিনের অভিজ্ঞতার কথা বর্ননা করতে গিয়ে সাংবাদিক সজিব কষ্ট, আবেগ আর কান্নার নোনা পানির স্রোত যেনো ঠেকাতে পারছিলেন না। তিনি বলেন, ওইদিন পুলিশ ও আওয়ামী পাষন্ডরা যেভাবে নিরস্ত্র মানুষের ওপর গুলিবর্ষণ আর বোমা হামলা করছিলো তখন আমার বাঁচার কথা ছিলনা। ছবি তোলা আর ভিডিও করার অপরাধে ওরা আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছুঁড়ে। আমার শরীরে পাশ দিয়ে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে ওই বুলেটবিদ্ধ হন নিরীহ ছাতা মেরামতের কারিগর মো. জসিমউদ্দিন (৪৮)। তার মতে, ওইদিন ছাত্রজনতার আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে জসিমউদ্দিনও তার দোকানের কাজকর্ম বন্ধ রেখে ঠায় বসেছিলেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস জসিমকে নব্য হানাদারের বুলেটের কাছেই পরাজিত হতে হয়েছিলো। 

তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ জসিমউদ্দীন ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টায় সাহায্যের জন্য লোকজনকে ডাকছিলাম, পরিস্থিতির ভয়াবহ বাস্তবতায় কেউ এগিয়ে আসছিল না। বিষাক্ত বুলেটটি জসিমউদ্দিনের ঠিক মাথার মাঝ বরাবর ঢুকে পড়ে। মুহূর্তেই তিনি লুটিয়ে পড়েন মাটিতে। তার ক্ষতবিক্ষত মাথা হতে রক্তের ফিনকির ছিটায় ভিঁজে যায় আমার শরীর, জামা-কাপড়। মাথার মগজ বেরিয়ে যায়। পিচঢালা রাজপথে জসিম ভাইয়ের নিথর শরীর পড়ে থাকে বিজয়ের মিছিল দেখার অপেক্ষায়। দুপুর শেষে বিকেল গড়ালো। পালালো আ' লীগ, ছাত্রলীগ আর আত্মসমর্পণ করলো বিপদগামী হাসিনার পুলিশ বাহিনী। এরপর বিজয় মিছিলের বীরযোদ্ধারা মুক্তির লাল সালাম জানিয়ে জসিম ভাইয়ের রক্তাক্ত প্রাণহীন হীমশীতল শরীরটাকে নিয়ে গেলো জীবনচলার আপন মানুষগুলোর কাছে। 

ওইদিনের দানবীয় রণাঙ্গনের প্রত্যক্ষদর্শী ভোলার সিনিয়র সাংবাদিক উমর ফারুক তাদের-ই একজন। তিনি জানান, ১২ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত স্বৈরাচার পতনের একদফা আন্দোলনের মিছিল আর প্রতিবাদ সভার প্রতিটি মুহূর্তে আমি উপস্থিত ছিলাম। চলমান আন্দোলননটি যে ৪ আগষ্ট হঠাৎ করেই বিস্ফোরম্মূখ হয়ে উঠবে তা বুঝে উঠতে পারিনি। ৪ আগস্ট আওয়ামী নেতাকর্মীরা পুলিশের সহযোগিতায় আন্দোলনরত ছাত্রজনতার ওপর আক্রমন চালানো শুরু করলো। 

গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে ক্ষমতাসীনদের অন্যায় অপকর্ম নিয়ে ভোলায় যে ক'জন সাংবাদিক কলমের ট্রিগার চাপেন, উমর ফারুক তাদের-ই একজন। এ কারণে ওইদিন অতীত পুঞ্জিভূত ক্ষোভে সাংবাদিক উমর ফারুককে জেলা আ'লীগ অফিসের সামনে দুর্বৃত্তদল চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। সাংবাদিক উমর ফারুক বলেন, তাদের টার্গেট ছিলো আমাকে মেরে ফেলা। কিন্তু আল্লাহর অশেষ রহমতে অতি কাছের কোনো একজনের হস্তক্ষেপে বেঁচে যান সাংবাদিক উমর ফারুক। 

সদর রোডে সন্ত্রাসীদের তান্ডবলীলার জ্বলন্ত স্বাক্ষী ওই শহরের বাসিন্দা, মামুম, জামাল, লাকী, কহিনুর, বাদল, রাজীব ও ব্যবসায়ী মিজান। তাদের সকলের একটাই কথা, ওইদিন যে আওয়ামী স্বৈরাচারের দোসররা সাধারণ মানুষের ওপর নির্বিচারে গুলি চালিয়েছ, বোমায় পথচারীদের ক্ষতবিক্ষত করেছে, তারা এখনো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। ওইদিন তাদের হাতে ছিল, কাটা রাইফেল, শর্টগান, পিস্তল আর নতুন নতুন নাম না জানা মরণাস্ত্র। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে ওইসব ক্যাডাররা এখনো বীরদর্পে প্রকাশ্যে ঘুরছে। এদেরকে এখনো কেনো গ্রেপ্তার করা হচ্ছেনা? কেনো একবছরেও তাদের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার হলো না এমন প্রশ্ন এখন ভোলার ভুক্তভোগী মানুষের মুখে মুখে। 

জুলাই বিপ্লবকালে ছাত্র জনতার ওপর হামলা ও গুলিবর্ষণের কুশীলবদের বিষয়ে কথা হয়, এখানকার জেলা প্রশাসকের সাথে। 

এ বিষয়ে ভোলার জেলা প্রশাসক মো. আজাদ জাহান বাসস'কে জানান, ২০২৪ এর ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জেলায় ব্যাপক অভিযান অব্যহত রেখেছেন। মাসিক আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে আমরা জেলার সার্বিক অপরাধ পরিস্থিতি নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি এবং প্রতিকার ও প্রতিরোধের কৌশল নির্ধারণ করছি। 

ভোলার পুলিশ সুপার মো. শরীফুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ভোলার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে আমার পুলিশ প্রশাসন জিরো টলারেন্স। তিনি বলেন, ভোলার মাটি থেকে সন্ত্রাসীদের শিকর উপড়ে ফেলা হবে। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
‘জুলাই-গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির নির্দেশনা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ‘সুজন’ প্রণীত ‘জাতীয় সনদ’ হস্তান্তর
আসুন এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না : প্রধান উপদেষ্টা
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় হত্যা মামলায় ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড
স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা বাংলাদেশে টিকতে পারবে না: মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা
প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভূমিকা সহায়তাকারীর: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা
৪ আগস্ট খুলনায় আন্দোলনকারীদের বিজয় উল্লাস
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে আলেম-উলামাগণের সহায়তা চায় সরকার: পরিবেশ উপদেষ্টা
ঢাবি’র ৮ শিক্ষার্থীর ‘আয়েশা-আমিরুল ট্রাস্ট ফান্ড বৃত্তি’ লাভ
বেরোবির পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক রশীদুল সাময়িক বরখাস্ত
১০