টাঙ্গাইলে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কলেজ ছাত্র ইমন, চোখ হারান হিমেল

বাসস
প্রকাশ: ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১৫:৩৩
২০২৪ সালের ৪ আগস্ট হাসিনা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবিতে ছাত্র জনতার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠা টাঙ্গাইল। ছবি : বাসস

।। মহিউদ্দিন সুমন ।।

টাঙ্গাইল, ৪ আগস্ট, ২০২৫ (বাসস): ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট  তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের এক দফা দাবিতে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্র জনতার বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে টাঙ্গাইল।

জেলা শহরসহ বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের উপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ হামলা করলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মির্জাপুরে গোড়াই হাইওয়ে থানাতে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে । এ ঘটনায় থানার ওসিসহ ১০ জন আহত হয়। পুলিশ ও শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে টিয়ারসেল, বুলেট ছুঁড়ে পুলিশ। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কলেজ ছাত্র ইমন এবং পুলিশের ছররা গুলিতে দুটি চোখ হারান হিমেল।

এদিকে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে টাঙ্গাইল পৌর এলাকার বটতলায় আন্দোলনকারীদের মিছিলে ছাত্রলীগ বাধা দিলে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ ও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সে সময় ওই এলাকায় বিবেকানন্দ স্কুল অ্যান্ড কলেজে তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ্যাড. জহেরুল ইসলাম জোহের তার কর্মী বাহিনী নিয়ে অবস্থান করছিলেন। এ খবর পেয়ে আন্দোলনকারীরা সেখানে হামলা করে।  সে সময়ে অন্তত পাঁচজন আহত হয়। এ দিকে ময়মনসিংহ সড়কের সাবালিয়া এলাকায় আন্দোলনকারীদের মিছিলের ওপর ছাত্রলীগ ও যুবলীগ এর নামধারী কিছু দুর্বৃত্তরা গুলিবর্ষণ করে। এতে রাসিনুল খান নামের এক শিক্ষার্থীর পা গুলিবিদ্ধ হয়।

এ দিকে বিকেলে শহরের কালিবাড়ি সড়কের মোড়ে আন্দোলনকারীদের মিছিলে আবারো হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আন্দোলনকারীরা বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠে। তারা পূর্বআদালত পাড়ায় টাঙ্গাইল-২ (গোপালপুর-ভূঞাপুর) আসনের তৎকালীন এমপি তানভীর হাসান ওরফে ছোট মনিরের বাসভবনে হামলা চালায় ও অগ্নিসংযোগ করে। বাসার নিচে থাকা সাতটি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।

এর পর শিক্ষার্থীরা শহরের শিবনাথ পাড়া এলাকায় টাঙ্গাইল পৌরসভার তৎকালীন মেয়র এসএম সিরাজুল হকের বাসভবনে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরে আন্দোলনকারীরা শহরের বাইপাস সড়কের দরুন এলাকায় এমপি তানভীর হাসানের মালিকানাধীন পেট্রল পাম্প ও হাইওয়ে রেঁস্তোরায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে। এ ঘটনার পর ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু (বর্তমান যমুনা সেতু) মহাসড়কে দূরপাল্লার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এ সব ঘটনায় পর থেকে পুরো জেলাজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। শহরে দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়।

বিকেল সাড়ে ৩টায় প্রেসক্লাব, নিরালা মোড়, পুরাতন বাসস্ট্যান্ডসহ বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান করে বিক্ষোভ করে আন্দোলনকারীরা। এরপর আন্দোলনকারীরা মিছিল নিয়ে আবার শহরে প্রবেশ করেন। তারা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের দিকে প্রবেশের চেষ্টা করেন। পরে পুলিশ  তাদের সেখান থেকে ছত্রভঙ্গ করে দেয়। মিছিলকারীরা বেলা তিনটার দিকে শহরের আকুরটাকুর পাড়ায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জোয়াহেরুল ইসলামের বাসভবনে হামলা করেন। তারা ওই বাসভবনের প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত ভাঙচুর করেন। এরপর তাঁরা প্রেসক্লাবের সামনে ও পৌর উদ্যান এলাকায় গিয়ে বিক্ষোভ শুরু করেন। পুরো শহরে রণক্ষেত্রে পরিনত হয়।

এক পর্যায়ে তারা টাঙ্গাইল পৌরসভা ভবনে হামলা করেন। সেখানে ব্যাপক ভাঙচুর করার পর অগ্নিসংযোগ করা হয়। এতে পৌর ভবনের প্রথম ও দ্বিতীয় তলার ব্যাপক ক্ষতি হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে শহরের মেইন রোডে অবস্থিত জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেন। এ ঘটনায় পুরো শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করে। বন্ধ হয়ে যায় শহরের দোকানপাট। কর্মসূচি চলাকালে পুলিশ, র‌্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান করতে দেখা যায় ।

এর পর বিক্ষোভকারীরা শহরের থানাপাড়ায় তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ফজলুর রহমান খানের বাসভবনে হামলার চেষ্টা করেন। এ সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। সন্ধ্যায় পুলিশ সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে শহরের প্রধান সড়কগুলো থেকে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

বিকেলে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের গোড়াই হাইওয়ে থানাতে হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে । থানায় পুলিশের চারটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। পুলিশ ও ছাত্র জনতার মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এ সময় পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে সাউন্ড গ্রেনেড, কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট ছুড়ে।  এ ঘটনায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কলেজ ছাত্র ইমন এবং পুলিশের ছোররা গুলিতে দুটি চোখ হারায় হিমেল।

তৎকালীন গোড়াই হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আদিল মাহমুদ সাংবাদিকদের অভিযোগ করে বলেন, অসহযোগ আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতা হঠাৎ গোড়াই থানায় হামলা চালায়। পরে তারা গোড়াই থানা ভাঙচুর করে আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ার শেল, সাউন্ড গ্রেনেড ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করা হয়। পরে মির্জাপুর থানা পুলিশের সহযোগিতায় পুলিশ সদস্যদের উদ্ধার করে মির্জাপুর থানায় নিয়ে আসা হয়। এ ঘটনা দশ পুলিশ সদস্য আহত হয়।

এ দিকে জেলার মধুপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে মধুপুর উপজেলা শহর ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়। সে দিন বিকেলে দুই ঘণ্টাব্যাপী ধারাবাহিকভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় তারা।

মধুপুর পৌরসভা কার্যালয়ের সকল কক্ষ ভাঙচুর, অফিসের বাইরে ও ভেতরে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। মধুপুর পৌরসভার চারটি গাড়ি, বিভিন্ন স্থানে ১৫টি মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। মধুপুরের দমকল বাহিনীর সদস্যরা গিয়ে মধুপুর পৌরসভা কার্যালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণ আনে। এ সব ঘটনায় অন্তত ১৭ জন আহত হয়। তাদের মধ্যে তিনজনকে গুরুতর আহত অবস্থায় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

কলেজ ছাত্র শহীদ ইমনের মা রিনা বেগম সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বাসসকে জানান, হঠাৎ পুলিশের একটি বুলেট ইমনের বুক দিয়ে ঢুকে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। পিচ ঢালা রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে ইমন। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ১৫ দিন মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে গত ১৮ আগস্ট ২০২৪ সকালে না ফেরার দেশে চলে যায় আমার ছেলে ইমন । ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় ইমনসহ সকল নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী প্রত্যেক ব্যক্তিকে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।

সেদিন পুলিশের ছররা গুলিতে দুটি চোখ হারানো হিমেলের মা নাসিমা বেগম বাসস কে জানান, গণ-অভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময়ে গত ৪ আগস্ট বিকেল তিনটার দিকে ছাত্র-জনতার সঙ্গে হিমেলও মির্জাপুর গোড়াই হাইওয়ে থানার সামনে মহাসড়কে অবস্থান নেয়। এই সময় পুলিশ হঠাৎ গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। প্রথমে হিমেলের শরীরে রাবার বুলেট এসে লাগে। এরপরও তিনি সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে তার পুরো মুখ মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় প্রায় দেড় শতাধিক ছোররা গুলি লাগে। গুলি লাগে চোখেও। এই আঘাতেই দৃষ্টিশক্তি হারায় আমার ছেলে।

তিনি আরো জানান,  আমার ছেলে হিমেল অনেক আশা নিয়ে অপেক্ষা করছিল বর্তমান সরকার ও জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন তার চোখের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবে। হিমেল এখন কারো সাথে কথা বলে না। চুপচাপ থাকে। অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে গেছে। শুধু বলে আমার জীবনটা ধ্বংস হয়ে গেল। অভাব অনটনের সংসারে আমার অবর্তমানে হিমেলের বাকি জীবন কিভাবে চলবে? সরকার যেন সে দিকে একটু নজর দেয়। এটাই আমার একমাত্র প্রত্যাশা।

টাঙ্গাইলের "হাসিমুখ' (প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র) এর পরিচালক ও ড্যাব নেতা ডা. মো. আনোয়ার সাদাত বাসস কে জানান, সারাদেশের মতো টাঙ্গাইলেও ছাত্র-জনতা স্বৈরাচার হাসিনার পতনের লক্ষ্যে একযোগে মাঠে নেমেছিলো। তারা পেটোয়া বাহিনীর হামলার শিকার হয়েছে, পুলিশের গুলিতে রক্তাক্ত হয়েছে, তবু রাজপথের দখল ছেড়ে যায়নি। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
দেশে প্রথমবার কক্সবাজার রেলস্টেশনে বসলো স্ক্যানার 
৪ আগস্ট ছাত্র জনতার দখলে ছিল সাতক্ষীরার রাজপথ
আগামীকাল জুলাই ঘোষণাপত্র পাঠ করবেন প্রধান উপদেষ্টা
‘জুলাই আন্দোলনে মোবাইল সাংবাদিকদের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে থাকবে’
ফিরে দেখা জুলাই: দ্রোহের মিছিলে সিলেটের গ্রামীণ জনপদ
জুলাই বর্ষপূর্তি উপলক্ষে নওগাঁয় ফ্রি ব্লাড গ্রুপিং কর্মসূচি
‘জুলাই-গণঅভ্যুত্থান দিবস’ উপলক্ষে রাজধানীতে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণে ডিএমপির নির্দেশনা
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে ‘সুজন’ প্রণীত ‘জাতীয় সনদ’ হস্তান্তর
আসুন এমন এক বাংলাদেশ গড়ে তুলি, যেখানে আর কোনো স্বৈরাচারের ঠাঁই হবে না : প্রধান উপদেষ্টা
চট্টগ্রামের আনোয়ারায় হত্যা মামলায় ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড
১০