পাহাড়ি পথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনিবন্ধিত ৩ হাজার চাঁদের গাড়ি, অদক্ষ চালকের হাতে অনিরাপদ জীবন

বাসস
প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৭:৩৬
খাগড়াছড়ির পাহাড়ি পথে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে অনিবন্ধিত ৩ হাজার চাঁদের গাড়ি। ছবি: বাসস

জীতেন বড়ুয়া

খাগড়াছড়ি, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): নিলামে কেনা অনিবন্ধিত, অকেজো ও ফিটনেসবিহীন ৩ হাজার গাড়ি দাপিয়ে বেড়াচ্ছে পাহাড়ি সড়কে। অদক্ষ চালকের বেপরোয়া গতির কারণে বাংলার ভূ-স্বর্গখ্যাত সাজেকের পথে প্রায় সময় ঘটছে দুর্ঘটনা। এদের নেই লাইসেন্স, নেই রোড পারমিট। অদক্ষ চালকের হাতে প্রায়ই ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণহানি হচ্ছে পর্যটকসহ সাধারণ মানুষের। 

জানা যায়, গত এক মাসে চাঁদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পর্যটকসহ অন্তত ৩ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ৫০ এর বেশি। তারপরও খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্র ও অভ্যন্তরীণ সড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে প্রায় ৩ হাজার চাঁদের গাড়ি। তার ওপর সরকারি নীতিমালার তোয়াক্কা না করে স্থানীয় পরিবহন সিন্ডিকেটের নির্ধারিত ভাড়া গুণতে হচ্ছে পর্যটকদের। 

দেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র সাজেক ভ্যালিতে যাওয়ার সড়ক যোগাযোগ খাগড়াছড়ি হয়ে। বিকল্প রাস্তা না থাকায় সহজেই সিন্ডিকেটের খপ্পরে জিম্মি সাধারণ পর্যটকরা। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে নিলামে কেনা অকেজো, ফিটনেসবিহীন ও স্থানীয় ভাবে তৈরি গাড়িই পর্যটকদের একমাত্র মাধ্যম। সাজেকসহ খাগড়াছড়ির বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে যাতায়াতের জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। পাহাড়ে ওঠার জন্য এই গাড়িগুলোকে ভরসা করতে হয় পর্যটকদের। 

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের খাগড়াছড়ির সাধারণ সম্পাদক মো. দুলাল হোসেন বাসসকে বলেন, খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা-সাজেক সড়কে অনেক জায়গায় ঝুঁকিপূর্ণ বাঁক ও সড়ক সংকীর্ণ। এ পথে চলার সময় পর্যটকবাহী পরিবহনের চালকদের অসচেতনতা ও বেপরোয়া গতির কারণে প্রায় ঘটছে দুর্ঘটনা। ফিটনেসবিহীন গাড়ি পাহাড়ি পথে চলতে গিয়ে প্রায় হচ্ছে অকেজো। এতে করে পর্যটকরা পড়েন দুর্ভোগে। 

তিনি জানান, খাগড়াছড়ি-সাজেক সড়কে গত জানুয়ারি মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় ৩ জন নিহত ও অন্তত অর্ধশতাধিক আহত হয়েছেন। তিনি আরো বলেন প্রায় ৬০/৭০ বছর ধরে পুরনো এ জিপ গাড়ি খাগড়াছড়ির বিভিন্ন সড়কে চলাচল করে আসছে। আগে একশ থেকে দেড়শ গাড়ি চলাচল করলেও বর্তমানে অন্তত ৩ হাজার চাঁদের গাড়ি খাগড়াছড়ির ৯ উপজেলার বিভিন্ন সড়কে চলাচল করছে । মূলত চন্দ্রযানের মতো দুর্গম পাহাড়ে চলাচল করতে সক্ষম বলে এটি চাঁদের গাড়ি নামে পরিচিতি লাভ করেছে। ছাদ খোলা হওয়ায় পর্যটকদের কাছেও এ যানটি জনপ্রিয়। কিন্তু ফিটনেসবিহীন ও অদক্ষ চালকের কারণে প্রতিনিয়িত ঘটছে দুর্ঘটনা। প্রাণ হারাচ্ছে পর্যটকসহ অভ্যন্তরীণ সড়কে চলাচলকারী যাত্রীরা।

নেত্রকোনা জেলা সদর থেকে সাজেক বেড়াতে আসা পর্যটক মো. সোলেমান ও রওশন আরা বেগম চাঁদের গাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে বলেন, অল্প বয়সী ছেলেরা এ গাড়িগুলো নিয়ে সহজেই পাহাড়ি রাস্তায় উঠে যাচ্ছে এবং সাহসের সাথেই চালাচ্ছে । তাদের নিজেদের কোন ভয় নেই বরং যাত্রীদের সাহস যোগাচ্ছে। তবে পুরনো গাড়ির যন্ত্রপাতি স্থানীয়ভাবে তৈরি করে লাগানোর কারণে রিস্ক থেকে যায়। সেজন্য বিআরটিএ যদি গাড়িগুলো পরীক্ষা করে ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতো তা হলে যাত্রীরা একটু আশ্বস্ত থাকতো এবং ভয় কম পেতো ।

খাগড়াছড়ি জেলা সদরের পরিবহন ব্যবসার সাথে সম্পৃক্ত মো. শাহ আলম বাসসকে বলেন, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময় আর্মিদের ফেলে যাওয়া ছাদখোলা জীপই হচ্ছে চাঁদের গাড়ি । স্থানীয়ভাবে  সামান্য  মেরামত করে , বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে ইঞ্জিন পরিবর্তন করে প্রায় নতুনের মত করে গাড়িগুলোকে রাস্তায় নামানো হয় । ইদানিং দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে সরকারি পুরাতনা জীপগুলো অকশনে ক্রয় করেও চাঁদের গাড়ি বানানো হচ্ছে। তিনি বলেন, অতি পুরাতন গাড়িগুলোর পুরনো নাটবল্টু ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি ভেঙে যাওয়ার কারণেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে ।

খাগড়াছড়ি-দীঘিনালা সড়কে নিয়মিত যাতাযাতকারী স্কুল শিক্ষিকা প্রতিভা ত্রিপুরা বলেন, মেয়াদোত্তীর্ণ এসব চাঁদের গাড়িগুলোকে অকেজো ঘোষণা করে নতুন নতুন পিকআপ বা জীপ সার্ভিস চালু করা হলে যাত্রী সাধারণ উপকৃত হতো এবং দুর্ঘটনা থেকেও যাত্রীরা রক্ষা পেতো ।

এদিকে চাঁদের গাড়ি চালকদের দাবী তাদের সবকিছু ঠিক আছে। চাঁদের গাড়ির চালক মোঃ জসিম, মো. কুদ্দুছ, মো. জাকির হোসেন ও মো. সাহেদ জানান, আমরা সমতলের চেয়ে পাহাড়ে খুব ভালোভাবে গাড়ি চালাতে পারি। যা সমতলের চালকরা পারে না। অনেক সময় সমতলের চালকরা পাহাড়ে এসে পাহাড়ি রাস্তায় গাড়ি চালাতে গিয়ে দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এতে বদনাম হচ্ছে আমাদের । 

চাঁদের  গাড়ির চালক লাপ্রু মারমা  বলেন, চালকদের মধ্যে অবশ্য কিছু কিছু চালকের ড্রাইভিং লাইন্সেস নেই এটা সত্য। তবে তারা অবশ্যই দক্ষ। টাকার অভাব এবং ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার  ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতার  কারণে অনেকে লাইসেন্স করতে পারছেনা ।

এ নিয়ে চাঁদের গাড়ির মালিক ও মোটরযান কর্মকর্তাদের রয়েছে পরস্পর বিরোধী বক্তব্য। বিআরটিএ’র খাগড়াছড়ির সদ্য বিদায়ী উপ সহকারী পরিচালক মো: কাউসার আলমের মতে, এ চাঁদের গাড়িগুলো দেশিয় ভাবে তৈরি হওয়ার কারণে বিআরটিএ-এর কোন অনুমোদন নাই। সে কারণে রেজিস্ট্রেশন ও ফিটনেস দেওয়ারও সুযোগ নাই। কারিগরি সনদবিহীন, ক্রটিপূর্ণ গাড়ি, চালকরাও অদক্ষ হওয়ার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে।

অপর দিকে খাগড়াছড়ি জীপ মালিক সমিতির সভাপতি আব্দুল আজিম বাসসকে বলেন, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন সমিতি ভুক্ত তিন হাজার চাঁদের গাড়ি রয়েছে । আমাদের সবকিছুই রয়েছে। সরকার ইচ্ছে করলেই আমাদের কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে গাড়ী গুলোর রেজিস্ট্রেশন নবায়ন ও ফিটনেস সার্টিফিকেট দিতে পারে। তা হলে আমরা ভোগান্তির স্বীকার হতাম না । 

নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ পুরাতন মেয়াদোত্তীর্ণ লক্কর-ঝক্কর মার্কা যানবাহনগুলোকে অকেজো ঘোষণা করে পর্যটকসহ সকল নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবী জানান। 

তবে এ বিষয়ে যারা ব্যবস্থা নেবেন তারা সাংবাদিকদের সাথে কথা বলতে রাজি হননি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ব্রাজিলের কারখানায় বিস্ফোরণে ৯ জনের মৃত্যু
চুরি রোধে তিন জেলায় অবৈধ গ্যাস সংযোগ উচ্ছেদ
বাগেরহাটে আরাফাত রহমান কোকোর জন্মদিন পালিত
ট্রাম্পের সঙ্গে আলাস্কা সম্মেলনের আগে ফোনে পুতিন ও কিমের ফোনালাপ
রাজবাড়ীতে জাতীয় যুব দিবস পালিত
মানিকগঞ্জ পৌর আওয়ামী লীগ নেতা আটক 
ইসরাইলের হামলায় নিহতদের মধ্যে ৪ জন সাংবাদিক: আল জাজিরা
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গ্র্যাজুয়েট প্লাস ভিসা দেওয়ার সম্ভাবনা
নাটোরে সপ্তাহ ব্যাপী বৃক্ষ মেলা শুরু
হাসপাতালে যাওয়ার পথে অ্যাম্বুলেন্স খাদে পড়ে নিহত ১
১০