নেত্রকোনা, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : জেলার লেভেল ক্রসিং বাজারে মাছ ব্যবসায়ী রিফাত মিয়ার কাছে দেখা মিললো প্রায় ১২ কেজি ওজনের এ বিলুপ্তপ্রায় মহাশোল মাছটির। তিনি জানান এ মাছ তিনি দুর্গাপুর থেকে এনেছেন। দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী নদীতে এখন খুব কমই দেখা মিলে বিলুপ্ত এ মাছটি।অথচ একসময় এ সোমেশ্বরী নদী ই ছিলো এ মাছের আবাসস্থল।
মহাশোল একটি বিলুপ্তপ্রায় মাছ। পাহাড়ি খরস্রোতা স্বচ্ছ পানির নদীতে মহাশোল মাছের আবাস। নদীর পাথর-নুড়ির ফাঁকে ফাঁকে 'পেরিফাইটন' নামের এক রকমের শ্যাওলা জন্মে। এগুলোই মহাশোলের প্রধান খাদ্য। মহাশোল সর্বোচ্চ ১৫ মিটার গভীর পানিতে চলাচল করতে পারে। জলের উষ্ণতা ১৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত তাদের জীবনধারণের পক্ষে সহায়ক। মহাশোল দেখতে অনেকটা মৃগেল মাছের মতো। তবে এর আঁশগুলো আরও বড়। পরিণত মাছের আঁশ শক্ত, উজ্জ্বল সোনালি রঙের ও দীপ্তিমান। পাখনা ও লেজ রক্তিম। নাকের সামনে ছোট্ট দুটি গোঁফের মতো আছে। সব মিলিয়ে দেখতে খুব সুন্দর। আমাদের মিঠাপানির মাছের মধ্যে মহাশোল স্বাদেও সেরা।নেত্রকোনার দুর্গাপুরে কংস নদী ও সোমেশ্বরী নদী মহাশোলের আবাস। এ নদ-নদীর উৎসমুখ এখন প্রায় বন্ধ। শুকনো মৌসুমে নদী দুটি প্রায় শুকিয়ে যায়। বসবাস ও বংশবৃদ্ধির জায়গা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় মহাশোল ধীরে ধীরে কমতে থাকে। একপর্যায়ে প্রায় বিলুপ্ত হয়ে পড়ে। সোমেশ্বরী ও কংস ছাড়াও বিচ্ছিন্নভাবে দু-একবার সাঙ্গু নদেও মহাশোল পাওয়া গেছে।
মহাশোল মাছ সম্পর্কে নেত্রকোনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোহাম্মদ শাহজাহান কবীর বাসসকে জানান," এটি একটি বিলুপ্তপ্রায় মাছ, বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এ মাছের অস্তিত্ব রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে, নেত্রকোনায় সোমেশ্বরী, কংশ নদীতে মহাশোলের টরটর প্রজাতির আবাসস্থল, এ মাছ সাধারণত উজানে বংশবৃদ্ধি করে, সোমেশ্বরী নদীতে কয়েকমাস ধরে বালু উত্তোলন বন্ধ থাকায় এ মাছের বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা রয়েছে আসন্ন বর্ষাকালে।বিলুপ্তপ্রায় মহাশোলের এ প্রজাতির মাছ অনেক সময় সোমেশ্বরী ,কংশ থেকে জেলেরা ধরে তা তাদের পুকুরে রেখে বড় করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে থাকেন তবে তা খুবই কম সংখ্যক। "
নব্বইয়ের দশক থেকে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) বিলুপ্তপ্রায় মহাশোল মাছের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনে কাজ করে যাচ্ছে। বর্তমানে মহাশোলের তিনটি প্রজাতি নিয়ে কাজ করছে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট। এগুলো হলোু টর টর,টর পুটিটোরা, টর ব্যারাকি। তারই ধারাবাহিকতায় এখন পর্যন্ত গবেষকরা টর পুটিটোরা মহাশোলের কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন এবং চাষ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবন করেছেন। বর্তমানে এ জাতের মহাশোলটির পোনা চাষীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছে এবং দেশের বিভিন্ন জেলায় চাষাবাদ করা হচ্ছে। বাকি দুটি প্রজাতির কৃত্রিম প্রজনন উদ্ভাবনের কাজ চলমান রয়েছে। মহাশোল মাছটি নিয়ে কাজ করার উদ্দেশ্য হলোু এ মাছটিকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা এবং কৃত্রিম প্রজনন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাছটিকে সাধারণ ভোক্তার খাবারের পাতে ফিরিয়ে আনা।
মহাশোল বাংলাদেশে বিদ্যমান বিপন্ন প্রজাতির কার্পজাতীয় মাছগুলোর মধ্যে অন্যতম। উপমহাদেশে এটি ‘স্পোর্ট ফিশ’ হিসেবে সমাদৃত। এ মাছের জন্ম ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাদদেশে নেত্রকোনার সীমান্তবর্তী সুসং দুর্গাপুরের সোমেশ্বরী এবং কংস নদে। কয়েক দশক আগেও বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলের (যেমনু ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, সিলেট, দিনাজপুর এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম) খরস্রোতা নদী, ঝরনা, লেক এবং পার্শ্ববর্তী খাল-বিলে এর প্রাচুর্যতা ছিল। বর্তমানে বিভিন্ন মনুষ্যসৃষ্ট এবং প্রাকৃতিক কারনে এ দেশে মহাশোলসহ বহু মূল্যবান মৎস্য প্রজাতির বিচরণ এবং প্রজনন ক্ষেত্র ক্রমান্বয়ে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে প্রাকৃতিক জলাশয়ে মহাশোলের প্রাপ্যতা ব্যাপকভাবে কমে মাছটি প্রায় বিলুপ্তির পথে। মাছটির জীববৈচিত্র্য কমার অন্যতম কারণ কার্পজাতীয় অন্যান্য মাছের তুলনায় কম ডিম ধারণক্ষমতা। মহাশোলের বিলুপ্তির কারনে আশির দশকে নেপাল থেকে এ মাছের পোনা আমদানি করা হয়। পুকুরে পোনা ছেড়ে প্রজনন কৌশল ও জিনপুল সংরক্ষণ করা হয়। পরে ইনস্টিটিউট থেকে এ মাছের ব্যাপক পোনা উৎপাদনসহ চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবন করা হয়। এখন অন্যান্য কার্পজাতীয় মাছের চেয়ে এ মাছটি আকারে তুলনামূলক বড় হয়। সাধারণত লম্বায় সর্বোচ্চ ৫২ সেন্টিমিটার এবং ওজনে ৮ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। খেতে সুস্বাদু বলে অন্যান্য মাছের তুলনায় এ মাছটির দাম তুলনামূলক বেশি।