।। ফারাজী আহম্মদ রফিক বাবন ।।
নাটোর, ২৭ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ রসুন উৎপাদনকারী জেলা নাটোর।
চলতি মৌসুমে জেলায় অধিক ফলনের মধ্য দিয়ে রসুনের শ্বেত বিপ্লব ঘটেছে। উৎপাদিত রসুনের আর্থিক মূল্যমান অন্তত দুই হাজার কোটি টাকা।
জমি থেকে কৃষকদের রসুন সংগ্রহ শেষ হয়েছে। এখন গায়ের বধূরা ব্যস্ত সময় পার করছেন রসুন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কাজে।
চলতি মৌসুমের কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশের ১৪টি কৃষি অঞ্চলের ৬৪ জেলায় রসুনের মোট আবাদি জমির পরিমাণ ৭৭ হাজার ৯০০ হেক্টর।
দেশে মোট রসুন উৎপাদন হয়েছে ছয় লাখ ৯০ হাজার ৯০০ টন। পক্ষান্তরে দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ নাটোরে ২২ হাজার ৮৫৫ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ হয়েছে। অর্থাৎ দেশে রসুনের আবাদি জমির প্রায় ৩০ ভাগই নাটোর জেলায়। উৎপাদন হয়েছে দুই লাখ ১৫ হাজার টন রসুন।
কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, বিগত বছরগুলোতে জেলায় রসুনের আবাদি জমির পরিধি ও উৎপাদন উভয়ই ক্রমশ বেড়েছে। ২০২৩ সালে ১৬ হাজার ৭৪৫ হেক্টর জমিতে রসুন আবাদ করে ফলন পাওয়া গিয়েছিল এক লাখ ৪৮ হাজার ২৫৭ টন।
পরবর্তী বছর অর্থাৎ ২০২৪ সালে ১৮ হাজার ৫ হেক্টর জমি থেকে এক লাখ ৫৮ হাজার ২০১ টন রসুন উৎপাদন হয়। চলতি রবি মৌসুমে নাটোর জেলায় ১৮ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে চাষ হয়েছে ২২ হাজার ৮৫৫ হেক্টর। গত বছর বিঘাপ্রতি গড় ফলন ২৯ মণ পাওয়া গেলেও এ বছর বিঘা প্রতি গড় ফলন ৩১ টন ছাড়িয়ে গেছে। অর্থাৎ বাম্পার ফলন পাওয়া গেছে।
নাটোরে উৎপাদিত রসুনের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে বিনা চাষে রসুন উৎপাদন। প্রচলিত পদ্ধতিতে জমি চাষ করে রসুন লাগানো হয়। নাটোরে এবার রসুনের আবাদি জমির শতভাগই বিনা চাষের রসুন। ১৯৯৪-৯৫ সালে জেলার সীমান্তবর্তী বড়াইগ্রাম ও গুরুদাসপুর উপজেলার কৃষকরা স্বপ্রণোদিত হয়ে বিনা চাষে রসুন আবাদ করেন।
গুরুদাসপুর উপজেলার কাছিকাটা এলাকার কৃষক জেহের আলী কার্তিক মাসে বর্ষার পানি নেমে যাওয়ার পর জমিতে রসুনের কোয়া বুনে বিনা চাষে রসুন উৎপাদনের প্রচলন করেন। এ পদ্ধতিতে রসুন আবাদে জমি চাষ করতে হয় না, সেচও লাগে না। আগাছা থাকে কম এবং সারের ব্যবহার খুবই কম। উৎপাদন ব্যয় তুলনামূলক কম হওয়ার পাশাপাশি উৎপাদনের পরিমাণ বেশী হওয়ায় এ পদ্ধতি কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। প্রসার ঘটে জেলার অন্যসব উপজেলা ছাড়িয়ে দেশের অন্য জেলাগুলোতে।
জেলার বেশিরভাগ রসুন উৎপাদিত হয় গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম উপজেলায়। জেলার ২২ হাজার ৮৫৫ হেক্টর আবাদি জমির মধ্যে বড়াইগ্রাম উপজেলায় সর্বোচ্চ আট হাজার ৯৯৩ হেক্টর। গুরুদাসপুরে সাত হাজার ৩৭৫ হেক্টর, নাটোর সদর উপজেলায় দুই হাজার ৮৮০ হেক্টর ও লালপুরে এক হাজার ১০০ হেক্টর। বাগাতিপাড়ায় এক হাজার ৭৬ হেক্টর, সিংড়ায় এক হাজার ৫ হেক্টর এবং নলডাঙ্গা উপজেলায় ৪২৬ হেক্টর। জমি থেকে রসুন সংগ্রহ শেষ হয়েছে। জমি থেকে রসুন সংগ্রহের ব্যস্ততা আর নেই। এখন কৃষকদের বাড়ির আঙিনায় ব্যস্ততা।
সফলতা ও সমৃদ্ধির সুখ স্বপ্নে বিভোর গ্রামের বধূরা এখন রসুন প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণ কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এ কাজে কৃষক বধূদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মত।
বড়াইগ্রাম উপজেলার তিরাইল গ্রামের রসুন চাষী তোফাজ্জল হোসেন চলতি মৌসুমে ১ বিঘা জমিতে রসুন আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, মৌসুমের শুরুতে অনুকূল আবহাওয়া বিরাজ করায় রসুন বীজের অঙ্কুরোদগম ভালো হয়েছিল। বিঘাপ্রতি ৩০ মণ ফলন পেয়েছেন তিনি। উপজেলার বাজিতপুর এলাকার হাসানুল বান্না উজ্জল বিঘায় ফলন পেয়েছেন ৩১ মণ। গুরুদাসপুর উপজেলার সিধুলি গ্রামের খলিলুর রহমানের বিঘায় ফলন পেয়েছেন ২৮ মণ। সিংড়া উপজেলার বড় সাঁঐল গ্রামের কৃষক নেতা আনিসুর রহমান সরকার এক বিঘা জমিতে রসুন চাষ করে ফলন পেয়েছেন ২৯ মণ। তিনি বলেন, খরচ হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার টাকা। বর্তমান চার হাজার টাকা মণ গড় বাজার দরে লক্ষাধিক টাকায় বিক্রি করলে মুনাফা থাকবে অন্তত ৫০ হাজার টাকা। তবে সংরক্ষণ করলে পরে আরো বেশী দাম পাওয়া যাবে।
বড়াইগ্রাম উপজেলা কৃষি অফিসার শারমিন সুলতানা বলেন, উপজেলা জমি থেকে রসুনের সংগ্রহ কাজ শতভাগ শেষ হয়েছে। বিঘাপ্রতি ৩১ মণ গড় ফলনে সন্তোষ প্রকাশ করে কিছু ক্ষেত্রে রসুনের উৎপাদন কম হওয়া এবং রসুনের আকার ছোট হওয়ার কারণ সম্পর্কে কৃষিবিদ শারমিন সুলতানা বলেন, একই জমিতে বার বার রসুন চাষ এবং মাটিতে জৈব সারের ঘাটতির কারণে ক্ষেত্র বিশেষে এমন হতে পারে।
গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অফিসার হারুনর রশীদ জানান, শুধু বিনা হালে রসুন চাষই নয়, রসুনের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে তরমুজ ও বাঙ্গী চাষের উদ্ভাবনও এ এলাকা থেকেই হয়েছে।
বড়াইগ্রাম উপজেলার সরকার বাড়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক খাদেমুল ইসলাম বলেন, ৯০-এর দশকে উদ্ভাবনের পর থেকে রসুন চাষের মাধ্যমে এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। এলাকার কাঁচাবাড়ীগুলো পাঁকা হয়েছে। বাড়িতে বাড়িতে শিক্ষার্থীরা ব্যয় নির্বাহ করে উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছেন।
বিগত আড়াই দশকে নাটোরে কৃষি ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈচিত্রকরণ হয়েছে। কৃষকদের সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কৃষি বিভাগের নতুন নতুন প্রযুক্তি ও প্রশিক্ষণের সমন্বয়ে প্রচলিত শষ্যের বাইরে কৃষকরা অপ্রচলিত কিন্তু লাভজনক শষ্যের প্রতি ঝুঁকে পড়েছেন। এক্ষেত্রে রসুন অগ্রগামী শস্য। বর্তমানে রসুন চলনবিল অধ্যুষিত গুরুদাসপুর ও বড়াইগ্রাম এলাকার সবচেয়ে লাভজনক শস্য।
নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ পরিচালক মো. হাবিবুল ইসলাম খান বাসসকে বলেন, কৃষকদের প্রচেষ্টা এবং কৃষি বিভাগের পরামর্শ ও সহযোগিতায় রসুনের আশাতীত উৎপাদন হয়েছে। রসুনের বহুমুখী ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়াতে মৌসুমের শুরুতেই উর্ধ্বমুখী বাজার দর ভবিষ্যতে আরো বৃদ্ধি পেয়ে কৃষকরা অধিক লাভবান হবেন বলে আশা প্রকাশ করেন উপ পরিচালক।