সূর্যের রোদে কেমিক্যালমুক্ত শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন কুয়াকাটার জেলেরা

বাসস
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ২১:৩৬ আপডেট: : ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ২১:৫০
ছবি : বাসস

এনামুল হক এনা

পটুয়াখালী, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : সূর্যের রোদে কেমিক্যালমুক্ত শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপকূলীয় জেলা পটুয়াখালীর কুয়াকাটার জেলেরা। শীত আসতে না আসতেই কুয়াকাটায় শুরু হয়েছে শুঁটকি উৎপাদনের ধুম। শীতের হিমেল হাওয়ায় উপকূলীয় শুঁটকি পল্লীগুলোতে জমে উঠেছে কেমিক্যালমুক্ত ও প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে শুঁটকি প্রস্তুতের কর্মযজ্ঞ। সূর্যের প্রখর রোদে শুঁটকি শুকানোর এই ঐতিহ্যকে ঘিরে এখন স্থানীয় জেলে, শ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা ব্যস্ত রয়েছেন। বছরের এ মৌসুমে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কুয়াকাটার বিভিন্ন শুঁটকি পল্লী কর্মচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে থাকে। 

সরেজমিনে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ উপকূলজুড়ে সারি সারি বাঁশের মাচায় মাছ বিছানো, আবার কোথাও কোথাও বাশেঁর আড়ায় ঝুলিয়ে বিভিন্ন ধরণের মাছ শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হচ্ছে। কোথাও নারী-পুরুষ শ্রমিকেরা রোদে মাছ উল্টেপাল্টে দিচ্ছেন, কোথাও আবার নতুন মাচা তৈরির কাজ করছেন পুরোদমে। অনেকেই আবার ট্রলার মেরামত, জাল-দড়ি প্রস্তুত, মাছ রাখার জন্য অস্থায়ী ঘর, দোকান ও ‘চাং’ (মাচা) নির্মাণে ব্যস্ত।

জেলেদের ভাষায়—এ সময়টায় দম ফেলার ফুরসতও থাকে না। শুঁটকি পল্লী গড়ে তুলতে শুধু শ্রমই নয়, প্রয়োজন হয় সময় ও যত্নের।

কুয়াকাটার শুঁটকি পল্লীর জেলে আব্দুল করিম (৪৫) এর সাথে কথা হলে তিনি বলেন, আমাদের শুটকি কেমিকাল ছাড়া উৎপাদন করি। বিভিন্ন ধরণের মাছ পরিস্কার পরিছন্ন করে শুধু রোদে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করি। এতে কোনো ধরণের ভেজাল নেই। আমাদের তৈরি শুঁটকি সঠিক পরিবেশে উৎপাদন করা হয়।

আরেক জেলে লতিফ খান (৪০) বলেন, আমাদের শুঁটকি পল্লীতে বিভিন্ন জাতের শুটকি তৈরি করা হয়। সবচেয়ে বেশি চাহিদা লইট্টা শুটকির। এছাড়া সাগরের পোয়া থেকে শুরু করে চিংড়ি পর্যন্ত সব মাছেরই শুটকি করা হয়।

জেলেদের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, সাগর থেকে আহরিত লইট্টা, ছুরি, লাক্ষ্যা, চাপিলা, রূপচাঁদা, ছোট পোয়া, ছোট চিংড়ি ও ফাইস্যাসহ প্রায় ৩৫ প্রজাতির মাছ স্থানীয় পল্লীগুলোতে শুকানো হচ্ছে, যা সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পদ্ধতিতে। 

তারা জানান, কুয়াকাটার অধিকাংশ পল্লীতে কেমিক্যাল বা কোনো ধরনের সংরক্ষণকারী পদার্থ ব্যবহার করা হয় না। সূর্যের রোদ, সাগরের বাতাস এবং পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে উৎপাদিত এসব শুঁটকির দেশজুড়ে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রতিটি মৌসুমে এখান থেকে কোটি কোটি টাকার শুঁটকি দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করা হয়।

স্থানীয় নারী শ্রমিক সেতারা বেগম (৪০) জানান, শীত শুরু হলেই আমাদের কাজের চাপ কয়েকগুণ বেড়ে যায়। ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত মাচা পরিষ্কার, মাছ ধোয়া, শুঁটকি শুকানোসহ সবকিছু নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটে। একটি শুঁটকি পল্লী তৈরি করতেই প্রায় ১৭-১৮ দিন লেগে যায়। কেমিক্যাল ছাড়া পরিচ্ছন্নভাবে শুঁটকি উৎপাদন কার্যক্রমে অনেক মানুষের কর্মসংস্থানও তৈরি হয়েছে।

স্থানীয় শুঁটকি ব্যবসায়ী বিল্লাল মৃধা বলেন, আমরা সম্পূর্ণ কেমিক্যাল ও বিষমুক্ত শুঁটকি তৈরি করি। এ কারণে কুয়াকাটার শুঁটকির সুনাম দেশজুড়ে। আপনাদের মাধ্যমে ক্রেতাদের অনুরোধ—তারা যেন কুয়াকাটায় শুঁটকি উৎপাদনের পুরো প্রক্রিয়া নিজের চোখে দেখতে অন্তত একবার পল্লীতে আসেন। এতে আমাদের প্রতি তাদের আস্থা আরো বাড়বে বলে আমার বিশ্বাস।

শুঁটকি মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক সোহেল মাহমুদ জানান, মৌসুম শুরুর কারণে সব কিছুর দাম কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে প্রতি মণ বড়ো চিংড়ি শুঁটকি ৪০ হাজার টাকা এবং লইট্টা শুঁটকি ৩৬ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা ভালো থাকায় আমরা আশাবাদী—এবারের মৌসুমে অন্যান্য বছরের তুলনায় লাভবান হবো।

এ বিষয়ে কলাপাড়া উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বাসস’কে জানান, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুঁটকি মৌসুম চলে। তিনি বলেন, ‘জেলেদের আমরা নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিই। পরিচ্ছন্নতা, প্রাকৃতিক উপায়ে শুকানো এবং বাজারজাতকরণ—সবকিছু নিয়েই তাদের নিয়ে কাজ করছি। এবারের মৌসুমে চার হাজার মেট্রিক টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে আমরা যা আশা করছি, তা ছাড়িয়ে যাবে।

কুয়াকাটা পৌর প্রশাসক ও উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ইয়াসিন সাদেক এ বিষয়ে বাসস’কে বলেন, ‘কুয়াকাটার শুঁটকি প্রস্তুতকারীরা বেশ দক্ষ ও অভিজ্ঞ। তবে বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে শুঁটকি উৎপাদন হওয়ায় কিছুটা বিশৃঙ্খলা দেখা যায়। তাই সকল উৎপাদনকারীকে একটি ছাতার নিচে এনে নির্দিষ্ট এলাকায় শুঁটকি উৎপাদনের ব্যবস্থা করা হবে। এতে পরিবেশও সুরক্ষিত থাকবে এবং পর্যটকদেরও অসুবিধা হবে না।’ 

তিনি জানান, এই উদ্যোগের কাজ ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে এবং দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে।

উপকূলীয় কুয়াকাটা অঞ্চলের শুঁটকি পল্লীগুলোর বর্তমান ব্যস্ততা জানিয়ে দিচ্ছে—শীত এসেছে, আর তার সঙ্গে এসেছে জীবিকা, কর্মসংস্থান ও স্বপ্ন গঠনের মৌসুম। সূর্যের আলোয় কেমিক্যালমুক্ত শুঁটকি তৈরি এখন শুধু পেশাই নয়, উপকূলের মানুষের ঐতিহ্য, গর্ব ও অর্থনৈতিক সম্ভাবনারও একটি উজ্জ্বল প্রতীক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
টিকিটবিহীন ৪,৭৩৩ যাত্রীর কাছ থেকে রেলওয়ের সাড়ে ৮ লাখ টাকা আদায়
আগামীতে তারেক রহমানের নেতৃত্বে সরকার গঠন হবে : আব্দুল আউয়াল মিন্টু
প্রথমবারের মতো ডিআরইউ নারী সদস্যদের ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের উদ্বোধন
তাহিতিতে ভূমিধসে ঘর চাপা পড়ে নিহত ৭
খুলনায় বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া মাহফিল
ঢাবির হল পরিদর্শন ও নিরীক্ষণ অব্যাহত রেখেছে কারিগরি কমিটি
সরকার রোহিঙ্গা সংকটকে আবার বৈশ্বিক ফোরামে তুলেছে : শফিকুল
সব শিশুর জন্য নিরাপদ ও সমান সুযোগের ওপর গুরুত্বারোপ নরওয়ের
কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত
সংসদ নির্বাচন ও গণভোট ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে একই দিনে হবে : ইসি সচিব
১০