ঢাকা, ১৮ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): নওশিন একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। শিক্ষকতার বাইরে তার আরও একটি পরিচয় একক মা (সিঙ্গেল মাদার) হিসেবে। তবে নওশিন নানা ধরনের পারিবারিক ও সামাজিক আচরণের ভেতর দিয়ে বুঝতে পারে এই পরিচয়টিকে সহজ বা সম্মানজনকভাবে গ্রহণ করছে খুব কম মানুষই। যে দু একজনের কথা বলা যায় তারা মূলত নওশিনের কাছের বন্ধু। নওশিন এই জীবন বেছে নিয়েছে তার নিজের ক্যারিয়ার ও সন্তানের স্বার্থে।
তার উচ্চ পদস্থ সম্মানজনক পেশা থেকে জোরপূর্বক অব্যাহতির প্রশ্ন বার বার জর্জরিত করেছে দাম্পত্য সম্পর্ককে। পেশাগত কাজে নানামুখী ব্যস্ততা ও একমাত্র কন্যাসন্তানকে নিয়ে নৈমিত্তিক কলহ ও মানসিক নির্যাতনের হাত থেকে মুক্তি পেতেই বিবাহবিচ্ছেদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে তাকে। কেবল শ্বশুরবাড়ি নয়, নওশিনের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের কাছ থেকেও এ বিষয়ে প্রতিকূল সাড়া পেয়েছে নওশিন। সকলেই তাকে ছাড় দেবার কথা, মানিয়ে নেবার কথা বলেছে। নওশিন ঘরে-বাইরে সমানতালে ব্যস্ত থেকে পরিবারের কাছে সম্মান ও মানসিক প্রশান্তি আশা করেছিল। এর পরিবর্তে অসম্মান ও ক্রমাগত দুর্ব্যবহার পাওয়ায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছিল সে। যা তার সন্তানের ওপর ও পেশাগত জায়গায় বিরূপ প্রভাব ফেলছিল। কাজেই নওশিন সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও বিবাহবিচ্ছেদে যেতে বাধ্য হয়। এরপর সন্তানের অভিভাবকত্বের আবেদন করে এবং দীর্ঘ জটিল আইনি প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার পর তা লাভে সক্ষম হয়।
সিঙ্গেল প্যারেন্টদের অনেকেই এই গল্পটির সাথে নিজেদের অনেকটাই মিল খুঁজে পাবেন। বাস্তব পরিস্থিতি বলে, একক অবিভাবকদের ভেতর নারী পুরুষ উভয়কেই নানা রকম প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হতে হয়। তবে তুলনামূলক ভাবে নাজুক অবস্থানে আছেন নারীরা। সেকারণে বিশেষ করে উল্লেখ করা প্রয়োজন একক মায়েদের (সিঙ্গেল মাদার) কথা। বৈষম্যপূর্ণ সামাজিক শ্রেণিবিন্যাসের সমাজে নারীর বাস্তবতা পুরুষের চেয়ে ভিন্ন। কোনো নারী বৈবাহিক সম্পর্ক থেকে বের হতে এবং সন্তানের অভিভাবকত্ব গ্রহণ করতে চাইলে তার সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়ায় বাংলাদেশের আইনি জটিলতাসমূহ। সেসব বাধা ডিঙাতে তাকে পার হতে হয় দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। যদি বা কোনো ক্রমে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, তার পরে শুরু হয় সিঙ্গেল মাদারদের নতুন যুদ্ধ। এ যুদ্ধ সামাজিক ও পারিবারিক, যা একপর্যায়ে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে রূপ নেয়।
সকল নারীই যে বিবাহবিচ্ছেদের পর সন্তানের অভিভাবকত্ব লাভ করে তা নয়। একক মাতৃত্বের বিষয়টি নির্ভর করে উদ্ভুত আরো নানান পরিস্থিতির উপর— বিবাহবিচ্ছেদ ও সম্পর্কচ্ছেদ, স্বামীর মৃত্যু, অংশীদারিত্বের অভাব, দাম্পত্যজীবনে জেন্ডার রোলের পরিবর্তিত ধারণা ইত্যাদি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতর নারীর ভূমিকা এখনও গৌণ (প্যাসিভ)। পরিবার ও সমাজ নারীর ভূমিকাকে এভাবে দেখতে পছন্দ করে। নারীর মুখ্য (অ্যাকটিভ) ভূমিকা পরিবারে সমাজে নানাভাবে নিন্দিত হয়, সমালোচিত হয়। অনেক পুরুষতান্ত্রিক তাত্ত্বিক এটিকে সরলীকরণ করার চেষ্টা করে যায়। একটা ‘হার্মলেস’ চেহারা দাঁড় করায় পুরুষ ও পুরুষতান্ত্রিক নিয়মের। যে কারণে খোদ নারী এসকল নিয়মের বাইরে যাওয়ার কথা সহসা ভাবতে পারে না। কিন্তু পরিবর্তিত সময়ে অনেক পরিস্থিতিতে কখনও বাধ্য হয়ে, কখনও সচেতনভাবে নারী এই পাতা ফাঁদে পা দেন না।
একক মাতৃত্ব নিয়ে বাংলাদেশে কিছু সমীক্ষা ২০১৯, ২০২৩ ও ২০২৪এ পরিচালিত হয়েছে। তার ভিত্তিতে বাংলাদেশের নগরজীবনের প্রেক্ষাপটে একক মায়ের সংখ্যা ক্রমশ বেড়ে চলেছে বলাটা অত্যুক্তি হবে না। স্বামীর মৃত্যুর কারণে ৪৪ শতাংশ নারী, ডিভোর্সের কারণে ৩৪.৬ শতাংশ নারী, স্বামীর দ্বিতীয় বিয়ে, পরকীয়া কিংবা শারীরিক নির্যাতনের ফলে ২১.২ শতাংশ নারী একক মাতৃত্বের দায়িত্ব পালন করে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অফ স্ট্যাটিস্টিকসের গবেষণায় পাওয়া গেছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ এর ভেতর একক মাতৃত্বের হার শতকার ৯.১ থেকে ১০.৮ ভাগে বেড়ে গেছে। কাজেই এটি যে ক্রমবর্ধমান একটি বাস্তবতা সেটা নির্দ্বিধায় বলা যায়। একক মায়েরা মুখোমুখি হন নানা প্রতিবন্ধকতার।
কারণ অর্থনৈতিকভাবে নারীর দুর্বলতা তাকে আত্মবিশ্বাসহীন করে রাখে। দ্বিতীয়ত পারিবারিক ও সামাজিকভাবে হেনস্থার শিকার হতে হতে আত্মমর্যাদাবোধে ঘাটতি দেখা যায় অনেক নারীর ভেতরে। আর এসকল কারণে আবেগীয় ও মানসিক চাপ নারীকে নিয়ে যায় একাকিত্ব ও অবসাদের দিকে। এতো রকমের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও একক মায়েরা তাদের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। অনেক নারীর জন্যেই উচ্চ আয়ের পেশায় প্রবেশের সুযোগ কম। অনেক পরিবারে উপার্জনকারী নারীর আয় সংসারের মূল আয়ের কেবল সহায়ক আয়।
একক মাতৃত্বকে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির জায়গা থেকে এখনও মনে করা হয় এটা এক ধরনের সামাজিক কলঙ্ক। একক মা’কে সহজভাবে সমাজ নেবে এমন পরিস্থিতি বাংলাদেশে এখনও তৈরি হয়নি। পরিবারেও একে তেমন একটা ভালো চোখে দেখা হয় না। নারীকে পুরুষের পরিচয়ের আড়ালে থাকাটাকেই স্বাভাবিক মনে করে। নারী নিজের পয়সায় নিজে বাজার করছে, নিজের ভাড়ায় বাড়িতে থাকছে, সন্তানের সমস্ত কাজ তদারকি করছে— এটা দেখতে ও মেনে নিতে সমাজ অভ্যস্ত নয়।
তবে গত আড়াই দশকে এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন এসেছে। আমরা বুঝতে পারি আশেপাশের নানা উদাহরণ থেকে। পরিবর্তনের গতি ধীর হলেও পথ একেবারে অবরুদ্ধ নয়। নারী ও পুরুষের জেন্ডার ভিত্তিক বোঝাপড়া ও ভূমিকা বদল হবে, রাষ্ট্রীয় সহায়তায় আইনি জটিলতার অবসান হবে, সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়টি আলোচিত ও কার্যকরী হবে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে, এই প্রত্যাশা সকলের।