রেজাউল করিম মানিক
রংপুর, ১ অক্টোবর, ২০২৫ (বাসস): মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় গরু, ছাগলের মাংসের পরিমাণ নিয়ে চিকিৎসকরা নানা পরামর্শ দেন। রান্না করা এসব মাংসের সীমিত ব্যবহার শরীরের জন্য উপকারী হলেও অসুস্থ গরু-ছাগলের কাঁচা মাংস থেকে অ্যানথ্রাক্সের সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে। সম্প্রতি রংপুরের পীরগাছার পর এবার মিঠাপুকুর ও কাউনিয়া উপজেলায় অ্যানথ্রাক্স উপসর্গের রোগী পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় এলাকায় আতঙ্ক বিরাজ করছে।
তবে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ বলছে, জেলার গবাদিপশুকে অ্যানথ্যাক্স প্রতিরোধী টিকা দেওয়া হয়েছে।
অ্যানথ্যাক্স নিয়ে আতঙ্কের কারণ নেই। প্রাণিসম্পদ বিভাগ মসজিদ, মন্দির, হাটবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে সচেতনতা কার্যক্রম চালানো হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অ্যানথ্রাক্স হলো ব্যাসিলাস অ্যাথ্রাসিস নামক ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ঘটিত একটি রোগ; যা প্রথমত গবাদিপশুকে আক্রান্ত করে। আক্রান্ত পশুদের দ্বারা পরবর্তী পর্যায়ে মানুষ আক্রান্ত হয়। তাই অ্যানথ্রাক্সকে জুনোটিক ডিজিজ বলা হয়। মানুষ থেকে মানুষে এ রোগ ছড়ায় না।
নিয়ম অনুযায়ী মাংসের ব্যবসার আগে সিভিল সার্জন থেকে স্বাস্থ্য পরীক্ষা সনদ ও প্রাণিসম্পদ দপ্তর থেকে লাইসেন্স পাওয়া বাধ্যতামূলক হলেও অধিকাংশ ব্যবসায়ীর কাছে এসব নেই। ফলে রোগাক্রান্ত পশুর মাংস সরাসরি মানুষের খাদ্যচক্রে প্রবেশ করছে। এর মধ্য দিয়ে জনস্বাস্থ্য, পরিবেশ ও খাদ্য নিরাপত্তা একসঙ্গে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। পশুর রোগ ছড়াচ্ছে মানবদেহে।
ইতোমধ্যে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বিশেষজ্ঞরা জেলার পীরগাছায় ১৩ জন অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত রোগী শনাক্ত করেছেন।
চিকিৎসকরা সতর্ক করে বলছেন, মাংস ভালোভাবে সিদ্ধ করে খেতে হবে এবং রোগগ্রস্ত পশুর রক্ত-মাংসের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা জরুরী।
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র বলছে, গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে রংপুরের পীরগাছায় অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গ নিয়ে দুজন মারা গেছেন। একই সময়ে অ্যানথ্রাক্স রোগে উপজেলার চারটি ইউনিয়নে শতাধিক ব্যক্তি আক্রান্ত হন।
ওই সময় ঘটনাস্থল থেকে অসুস্থ গরুর মাংসের নমুনা পরীক্ষা করে অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত করেছিল প্রাণিসম্পদ বিভাগ।
পরে আইইডিসিআরের একটি প্রতিনিধিদল গত ১৩ ও ১৪ সেপ্টেম্বর পীরগাছা সদর এবং পারুল ইউনিয়নের অ্যানথাক্সের উপসর্গ থাকা ১৮ নারী-পুরুষের নমুনা সংগ্রহ করে।
দেশে রোগের প্রকোপ ও প্রাদুর্ভাব নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান আইইডিসিআরের পরিচালক তাহমিনা শিরীন বলেন, আমরা পীরগাছার ১৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করেছি। এর মধ্যে ১৩ জনের অ্যানথ্রাক্স শনাক্ত হয়েছে।
স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, রংপুরে অ্যানথ্রাক্সের তেমন সংক্রমণ ছিল না আগে। গরুর পাশাপাশি ছাগলের মাংসেরও অ্যানথ্রাক্সের জীবাণু শনাক্ত হওয়ায় মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা মুহাম্মদ তানভীর হাসনাত বলেন, সব মিলে ৬০ জন রোগীর তথ্য আমাদের কাছে আছে। কিছুদিন আগে আক্রান্ত এলাকায় মেডিকেল টিম গিয়েছিল, যারা আক্রান্ত, তারা যাতে শঙ্কিত না হন, এ জন্য তাদের সচেতন করতে। সেখানে ১৫-২০ জন রোগীর দেখা হয়েছে, যাদের ৯০ শতাংশ রোগী সুস্থ হয়েছেন।
সম্প্রতি এ রোগ ছড়িয়ে পড়ে পাশের জেলা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলায়ও। সেখানেও মাংস ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নেই। করা হয় না নিয়মিত পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা।
এ বিষয়ে উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. বিপ্লব কুমার দে বলেন, সুন্দরগঞ্জ পৌরসভা এবং রামগঞ্জ বাজারের কসাইখানায় ফুললি সাপোর্ট দিচ্ছি আমরা। সেখানে পরীক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই গরু-ছাগল জবাই করতে দেওয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া বাকি কসাইখানাগুলোতে চিঠি পাঠানো হয়েছে।
একই চিত্র রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলাও। এখানে মাংস ব্যবসায়ীর সংখ্যা ৬০ জনেরও বেশি; কিন্তু কারও লাইসেন্স নেই। এমনকি এই উপজেলায় জবাইয়ের আগে পশুর স্বাস্থ্যও পরীক্ষা করা হয় না।
এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসকরা বলছেন, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত গবাদিপশুর শ্লেষ্মা, লালা, রক্ত, মাংস, হাড়, নাড়িভুঁড়ির সংস্পর্শে এলে মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগ গবাদিপশু থেকে মানুষে ছড়ায়, তবে মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না। মানুষের শরীরে এ রোগের প্রধান লক্ষণ হচ্ছে চামড়ায় ঘা সৃষ্টি হওয়া। এ জন্য প্রাণিসম্পদ বিভাগকে গরু-ছাগলের প্রতিষেধক টিকা কার্যক্রম জোরদার করার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।
রংপুর বিভাগের প্রাণিসম্পদ দপ্তরের বিভাগীয় পরিচালক ডা. মো. আব্দুর হাই সরকার বলেন, প্রাণিসম্পদ থেকে মাংস ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স নেওয়ার জন্য আমরা মাঠপর্যায়ে উদ্বুদ্ধ করছি। আমরা নিয়মিত পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করতে চাই। কিন্তু চরম জনবল সংকটের কারণে তা সম্ভব হয় না। প্রতিটি হাটে চিকিৎসক পাঠানো সম্ভব হয় না।
তারপরও আমরা চেষ্টা করছি স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে হাট-বাজারগুলোতে পশুর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করার।