বড় বোনকে হাসপাতালে একা রেখে পালিয়ে এসেছিলাম আন্দোলনে : আহমেদ ইসহাক

বাসস
প্রকাশ: ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৩:৩৬ আপডেট: : ০৬ জুলাই ২০২৫, ১৮:০৫
জাতীয় যুবশক্তি’র কেন্দ্রীয় সংগঠক আহমেদ ইসহাক। ছবি : ফেসবুক

পলিয়ার ওয়াহিদ

ঢাকা, ৬ জুলাই, ২০২৫ (বাসস) : গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। দল-মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক এই অভ্যুত্থানের প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়েছেন। মুক্তিকামী সকল রাজনৈতিক শক্তি ছিল এই অভ্যুত্থানের অন্যতম অংশীদার। রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলনের সভাপতি আহমেদ ইসহাকও ছিলেন তাদের একজন।

আহমেদ ইসহাকের জন্ম ২০০০ সালের ২২ এপ্রিল কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার দয়াপুর গ্রামে। তিনি আরবি সাহিত্যে স্নাতক ডিগ্রি করেছেন। ২০১৮ সালে রাজনৈতিক পথচলা শুরু। পরবর্তীতে তিনি ‘রাষ্ট্র সংস্কার ছাত্র আন্দোলন’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রধান সমন্বয়ক এবং কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।

এ ছাড়া ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ১৬ ছাত্র সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রঐক্য, ডানপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর জোট সর্বদলীয় ছাত্রঐক্যের সমন্বয় পরিষদের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে ভূমিকা রাখেন তিনি। বর্তমানে জাতীয় যুবশক্তি এনসিপির কেন্দ্রীয় সংগঠক হিসেবে কাজ করছেন।

রাজনীতির পাশাপাশি লেখালেখিও করছেন সমানতালে। ২০২১ সালে প্রথম ছড়াগ্রন্থ ‘নষ্টকাব্য’ প্রকাশিত হলে তরুণ-তরুণীদের কাছে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেন তিনি। ২০২৩ সালে প্রকাশিত কবিতার বই ‘দ্বিতীয় ঈশ্বর’- এর জন্য শুরু হয় তুমুল হইচই। আলোচনা-সমালোচনার জেরে বুকশপগুলো বইটি সরিয়ে নেয়। ২০২৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘ফ্যাসিবাদের ছড়া’। আওয়ামী জাহেলিয়াতের যুগে এমন  স্পষ্ট, ঝাঁঝালো  ভাষায় সম্ভবত  আর কেউ ছড়া লেখেনি।

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তিতে সম্প্রতি নিজের অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করেছেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস) এর বিশেষ আয়োজন ‘জুলাই জাগরণ’-এ দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন পলিয়ার ওয়াহিদ।

বাসস : জুলাই গণঅভ্যুত্থান নিয়ে এখনো কাউকে বলেননি এমন কোনো স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন।

আহমেদ ইসহাক : জুলাইয়ে আমার জীবনে একজন বেহুলা এসেছিলেন। যিনি আমাকে ‘লখাই’ বলে ডাকতেন। আর বলতেন, সাত সমুদ্র, তেরো নদী পার হতে হলেও আমার সঙ্গে থাকবেন। কিন্তু মাত্র ছয় মাসেই আবিষ্কার করলাম তিনি বেহুলা নয়, মনসার আদিষ্ট কালীনাগ।

বাসস : তিনি কি আন্দোলনে রাজপথে আপনার সঙ্গে ছিলেন নাকি উৎসাহ দিয়েছেন?

আহমেদ ইসহাক : তিনি আমার সঙ্গেই রাজপথে ছিলেন। এমন কি আমরা একসঙ্গে রাজপথে শহীদ হওয়ার পণ করেছিলাম। নারীরা যে পুরুষদের যুদ্ধের উৎসাহ তা আমি তার কাছ থেকে শিখেছি। তার প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।

বাসস : আন্দোলনে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন জুলাইয়ের কত তারিখে?

আহমেদ ইসহাক : সম্ভবত সেদিন ছিল জুলাইয়ের ৮ তারিখ। ৭ তারিখ সন্ধ্যায় নাহিদ ইসলাম কল করে জিজ্ঞেস করলেন, পার্টি অফিসে আছি কিনা। নাহিদ ইসলাম, আখতার হোসেনসহ কয়েকজন আন্দোলনের নেতা কাইয়ুম ভাইয়ের (রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক এডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম) সাথে সাক্ষাৎ করতে আসেন কোটার আইনি/সাংবিধানিক বিষয় ও আন্দোলনের সার্বিক দিক নিয়ে আলাপ করতে। আমি লাগাতার সাংগঠনিক সফর করে অসুস্থ হয়ে বাড়িতে ছিলাম। নাহিদ ইসলাম বললেন— ‘কোটা তো হয়ে যাচ্ছে, আপনারা বাড়িতে থাকলে কীভাবে হবে, ঢাকায় ফিরেন ভাই।’ রাতে হাসনাত কাইয়ুম ভাইও কল করে ঢাকায় ফেরার তাগাদা দিলেন। আমি পরদিন ঢাকায় ফিরি। সংগঠনের নেতাকর্মীদের সংগঠিত করে আন্দোলনে যোগ দেই।

বাসস : ঢাকা মেডিকেলে চিকিৎসারত আহত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা করে ছাত্রলীগ। আপনি সেখানে আহত যোদ্ধাদের সাহায্যে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। সেই দিনের স্মৃতি নিয়ে কিছু বলুন।

আহমেদ ইসহাক : ১৪ জুলাই শেখ হাসিনা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকারের নাতিপুতি’ সম্বোধন করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তাল হয়ে ওঠে। রাতেই শিক্ষার্থীরা রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে অবস্থান গ্রহণ করে। ১৫ জুলাই ১২টা থেকেই বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে আগত শিক্ষার্থীদের স্লোগানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় উত্তাল হয়ে ওঠে। মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদেরও অংশ নিতে দেখি। আনুমানিক ৩টায় খবর আসে বিভিন্ন হলগুলোতে আন্দোলনকারীদের আটকে রাখা হয়েছে। আমরা আনুমানিক পাঁচ শতাধিক আন্দোলনকারী মিছিল নিয়ে বিভিন্ন হলের সামনে যাই। মাইকে যারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে চায় তাদের নেমে আসার আহ্বান জানাই। এর মধ্যেই বিজয় একাত্তর, কবি জসিমউদদীন, মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে পূর্ব থেকেই ওঁত পেতে থাকা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও বহিরাগত সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। তারা ছাদ থেকে ইট, কাঁচের বোতল ছুঁড়ে মারতে থাকে।  সেখানে তাদেও হামলায় আমাদের অনেক সহযোদ্ধা আহত হয়। একপর্যায়ে সমন্বয়ক নাহিদ ইসলামকে (তিনি রাজুতে ছিলেন) কল করে পরিস্থিতি জানাই। আরও ছাত্রকে আমাদের সাহায্যে পাঠাতে বলি। সন্ত্রাসীরা একপর্যায়ে তিন দিক থেকে সমান তালে গুলি ও ইট পাটকেল ছুঁড়তে ছুঁড়তে এগিয়ে আসে। আরিফুল ইসলাম আদিব (বর্তমান এনসিপির যুগ্ম আহবায়ক) ভাই এসে বললেন আমরা আর ধরে রাখতে পারব না। আমাদের প্রস্থান করা উচিৎ। এর মধ্যেই পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। আমিও রক্তান্ত হই। আমার পাশের এক শিক্ষার্থীকে মাথায় আঘাত করার পর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। মাটিতে ফেলেই তাকে বেদম লাঠিপেটা করা হয়। আমি আবার পেছনে এসে তাকে রিক্সা চালকের সাহায্যে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে যাই।

ঢাকা মেডিকেলে সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ আনুমানিক পাঁচ শতাধিক আহত চিকিৎসা নেয়। এর মধ্যেই ঢাকা মেডিকেলের ইমারজেন্সির দুইটা গেট দিয়ে ঢুকে ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা লাঠি, রামদা, চাপাতি ও পিস্তল নিয়ে হামলা চালায়। এ রকম নির্মমতাকে শুধু ফিলিস্তিনের গাজার হাসপাতালগুলোর সঙ্গে তুলনা করা যায়। যেভাবে অবৈধ দখলদার ইহুদিবাদীরা ফিলিস্তিনের হাসপাতালগুলোতে আক্রমণ করে, একই কায়দায় হাসিনার পোষা সন্ত্রাসীরা আমাদের আহত ভাই-বোনদের ওপর নির্মম নিষ্ঠুর নির্যাতন চালায়। সে দিনের অভিজ্ঞতা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতি দেখে আমি মাশকুর রাতুল ভাই (রাষ্ট্র সংস্কার যুব আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক), মুনাব্বির নিশাত ভাইসহ (সহ-সমন্বয়ক) যুব আন্দোলনের নেতাকর্মীরা ছাত্রলীগের মিছিলের সাথে  ঢুকে আমাকে সুকৌশলে উদ্ধার করে নিয়ে আসে।

বাসস : ১৫ তারিখে ঢাবিতে হামলা হলে আপনি আহত হন। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ শহীদ হওয়ার পর কোথায় আন্দোলন করেন? ১৭, ১৮, ১৯ জুলাই ইন্টারনেট শার্টডাইনে আন্দোলন কীভাবে চালিয়ে গেলেন?

আহমেদ ইসহাক : অধিকাংশ সময় আমি স্বশরীরে পল্টন, বিজয়নগর, কাকরাইল, শাহবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উপস্থিত ছিলাম । আবু সাঈদ যখন শহীদ হয়, তখন এই আন্দোলন আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তারপর থেকেই ইউকে ও ইউএস হাইকমিশন, আল জাজিরাসহ আমেরিকান ও অন্যান্য দেশের বিভিন্ন সাংবাদিক, মানবাধিকার কর্মীরা নানাভাবে আমার সাথে যোগাযোগ শুরু করে। ৫ আগস্ট পর্যন্ত তাদের সাথে যোগাযোগ ছিল। চেষ্টা করেছি আন্দোলনের গতিপথ, ছাত্রদের অবস্থান, সরকারের পরিস্থিতি সঠিকভাবে তুলে ধরতে।

বাসস : আন্দোলনে আপনার সামনে শহীদ হয়েছেন এমন কোনো স্মৃতি আছে? থাকলে বলুন? 

আহমেদ ইসহাক : অনেক স্মৃতি আছে। আন্দোলনে আমার সামনে অনেকেই শহীদ হয়েছেন। আবার অনেককেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। তাদের অনেকের কথাই তো শেষ পর্যন্ত জানা যায়নি। নিঃসন্দেহে তাদের অনেকেই শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছে। তবে ১৯ জুলাই আমার একদম পাশেই এক সহযোদ্ধার মাথায় গুলি লাগে। সাথে সাথেই তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং শহীদ হন। এই গুলিটি আমার গায়ে লাগতে পারতো।  বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কি, কালভার্ট রোড, পল্টন টাওয়ার ও জামান টাওয়ারের এলাকায় আমরা  পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছি। সেই বুলেটটি এখনো আমার সংগ্রহে আছে।

বাসস : ১ দফা ঘোষণার আগে আপনি কখনো কি বুঝতে পেরেছিলেন হাসিনা পালিয়ে যাবে?

আহমেদ ইসহাক : হাসিনা এভাবে পালিয়ে যাবে তা সত্যিই ভাবি নাই। তবে ১৬ তারিখ পরবর্তীতে আর অস্পষ্টতা থাকলো না যে গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়ে গেছে। ঘরে ফেরার সব পথ বন্ধ। হয় বিপ্লব, নয় মৃত্যু। হাসিনার ঘাড়ত্যাড়ামি ও অব্যাহত গণহত্যা বাংলাদেশকে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ, মাহফুজ আলম, রিফাত রশীদ, আদীব ভাইসহ আমরা মানসিকভাবে তার প্রস্তুতিই নিচ্ছিলাম।

বাসস : ৫ আগস্ট তথা ৩৬ জুলাই সকালে কোথায় ছিলেন? হাসিনা পালানোর খবর কখন কার মাধ্যমে জানতে পারেন? অনুভূতি কেমন ছিল?

আহমেদ ইসহাক : ৪ আগস্ট রাত এক মহাতঙ্কের নাম। বহু চেষ্টা করেও একটুও ঘুমাতে পারিনি। যেহেতু ১৬ তারিখ পরবর্তীতে দিনে আন্দোলন, রাতে একেক দিন একেক জায়গায় আত্মগোপনে কেটেছে। অস্থিরতায় না খেয়ে, না ঘুমিয়ে শরীর জীর্ণশীর্ণ হয়ে গেছে। খুব ভোরে গোসল করে, সালাত আদায় করে আরও দুই সহযোদ্ধা লেখক, এক্টিভস্ট নাঈম হাসান ও বন্ধুবর মাওলানা শফিকুর রহমানকে নিয়ে শহীদ মিনারের উদ্দেশ্যে বের হই। আমরা কয়েকজন মিলে শহীদ মিনার পরিচ্ছন্ন করার চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে কিছু আন্দোলনকারী এসে জমায়েত হচ্ছিলো। সংখ্যায় দুই শতাধিক হবে। শফিক দৌঁড়ে এসে বলল, ভাই পুলিশ গুলি করতে করতে এগিয়ে আসছে। যেহেতু আমরা সংখ্যায় কম, সকলকে শহীদ মিনারের ওপরে উঠে আসতে বললাম। পুলিশ আমাদের গ্রেফতার করলেও আমরা শান্ত থাকব। কিন্তু পুলিশ আমাদের ১০০ গজের মধ্যে এসেও গুলি করতে থাকল। নারীদেরও বেদম প্রহার করল। কয়েকজনকে গ্রেফতার করল। আমার হাতেও ছররা বুলেট লাগল। আমরা শহীদ মিনারের পেছনের দেয়াল টপকে আশ্রয় নিলাম ঢাকা মেডিকেলে। কিন্তু ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা ঢাকা মেডিকেলের ভেতরেও খুঁজে খুঁজে আন্দোলনকারীদের বের করে নিয়ে আসছে। এই পরিস্থিতি দেখে কালিমা পড়ে শাহাদাতের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেললাম। আমার সাথে ছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক কামরুল হাসান।

ওইদিন নিজের ছবি, নাম, রক্তের গ্রুপ, সংগঠনের নাম ও পদবীসহ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের তিনজন নেতা দিদারুল ভূঁইয়া (অর্থ সমন্বয়ক) ফরিদুল হক (রাজনৈতিক সমন্বয়ক) ইমরান ইমন (সাংগঠনিক সমন্বয়ক) তাদের নাম ও নাম্বার লিখে মোবাইলের ওয়ালপেপার দিলাম। যাতে পরিচয়হীন লাশ হিসেবে দাফন না হই। বেলা একটা পর্যন্ত  রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনসহ পরিচিত কাউকেই ফোনে পেলাম না। ফোনে মেসেজেও যাচ্ছিল না নেটওয়ার্কের কারণে। বেলা একটার দিকে সাহস করে বাইরে বেরিয়ে কল করলাম ফরিদুল হক ভাইকে। তিনি জানালেন দুইটায় সেনাপ্রধান ভাষণ দেবেন। আমরা সুখবরের প্রত্যাশা করছি। ধৈর্য ধরেন। ওপরে গিয়ে বারবার ঘড়ি দেখছিলাম কখন ২টা বাজবে। ২টায় নিচে নেমে  সবাইকে বললাম সেনাপ্রধান ভাষণ দিতে যাচ্ছেন। হাসিনা পদত্যাগ করতে পারে। আমার কাছ থেকে শুনে পেছন থেকে এক ভাই চিৎকার করে বলে ফেলল ‘হাসিনা পদত্যাগ করেছে’ এবং তিনি ঢাকা মেডিকেলে ঢুকে চিৎকার করতে করতে ঘোষণা করলেন, ‘হাসিনা পদত্যাগ করেছে।’ লোকজনকে আর থামায় কে! সবাই বিজয় মিছিল করতে করতে শাহবাগের দিকে রওনা হলো। শাহবাগ এসে শুনি সেনাপ্রধান একঘন্টা পরে ভাষণ দেবেন। ততক্ষণে শাহবাগেও বিজয়ের উল্লাস শুরু হয়ে গেছে। তারপরের ঘটনা তো মুক্তিকামী জনতা কখনোই ভুলবে না...

বাসস : ইদানিং জুলাইকে মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?

আহমেদ ইসহাক : দ্যাখেন পলিয়ার ভাই মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি সশস্ত্র যুদ্ধ। জুলাই একটি গণ-অভ্যুত্থান। দুইটা লড়াইকে যারা তুলনা করে এবং যারা মুখোমুখি করে দুপক্ষই স্বার্থান্বেষী ও ভণ্ড। তবে জুলাই মুক্তিযুদ্ধ থেকে আলাদাও নয়। মুক্তিযুদ্ধের অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করাই জুলাইয়ের আকাঙ্খা। মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্খা বাস্তবায়িত হলে ৯০, ১৩ কিংবা ২৪ এর প্রয়োজন হতো না।

বাসস : ১৯ জুলাই পুলিশ বায়তুল মোকাররমে মুসল্লিদের যেতে বাধা দেয়। জানতে পারি আপনি সেদিন পল্টন এলাকায় ছিলেন। সেদিনের অভিজ্ঞতা বলুন।

আহমেদ ইসহাক : জুমাবার হওয়ায় সকালে বের হওয়ার সময়-ই জুমার নামাজের প্রস্তুতি নিয়ে বের হয়েছিলাম। জুমার পূর্ব মুহূর্তে পুরানা পল্টন মোড়ে দেখা হয় মাওলানা এহতেশামুল হক সাখী

(সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ), নিজামুদ্দীন আল আদনান (সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ছাত্র জমিয়ত বাংলাদেশ), আশিকুর রহমান (সাবেক কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল বাংলাদেশ খেলাফত ছাত্র মজলিস), মোশাররফ হোসাইন (প্রধান সমন্বয়ক ভাসানী ছাত্র পরিষদ), বিএম আমীর জিহাদী (কেন্দ্রীয় সভাপতি বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রসমাজ), গাজী আহমদ আব্দুল্লাহ মুসা (তরুণ আলেম সমাজ) সহ অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সাথে। আমরা নামাজের উদ্দেশ্যে বাইতুল মোকাররমের দিকে আগাতেই পুলিশ আমাদের বাধা দেয়। আমরা নামাজ আদায় করবো বলার পরও রাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়ায় তারা আমাদেরকে যেতে দেয় না । এক সময় আমি পল্টন মোড়েই সহযোদ্ধাদের নিয়ে রাজপথে সালাত আদায়ের উদ্যোগ নেই। তাৎক্ষণিক পুলিশ আমাদের সামনে একটি সাউন্ড গ্রেনেট মারে। আমরা দিকদ্বিক ছোটাছুটি শুরু করি। দৌঁড়ে বিজয়নগর পানির ট্যাঙ্কির কাছাকাছি গেলে রিক্সাওয়ালা মামারা পুরো রাস্তা রিক্সা দিয়ে ব্লক করে রিক্সা চালিয়ে স্লোগান দিতে দিতে পল্টন মোড়ের দিকে অগ্রসর হয়। সেখানে আমরা পুলিশকে পিছু হটতে বাধ্য করি। নামাজ পড়ার জন্য পল্টন মসজিদে যাই। মসজিদের বাইরে টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়ায় অন্ধকারাচ্ছন্ন। সাউন্ড গ্রেডের আওয়াজে খুতবার আওয়াজ ঠিকঠাক কানেও আসছিল না।

একটি দৃশ্য আমি কখনোই ভুলবো না । একজন ছিন্নমূল কিশোর এক হাতে ইট নিয়ে পুলিশের সাথে লড়াই করছিল। পুলিশ তার দিকে টিয়ারশেল ছুঁড়লে আমি তাকে টেনেহিঁচড়ে মসজিদে ঢুকাই। নামাজের পরে পল্টন টাওয়ারের সামনে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের  সময় আমি, আমার বন্ধু মাজহারুল ইসলাম ফকির (এনসিপি শ্রমিক উইংয়ের প্রধান সমন্বয়কারী), মোল্লা রহমতউল্লাহ (সাবেক আহ্বায়ক ছাত্র অধিকার পরিষদ একাংশ) গুরুতর আহত হই।

বাসস : আন্দোলনের সময় পারিবারিক কোন বাধা পেয়েছেন? বা এমন কোন স্মৃতি যা পরিবারকে খুব উপলব্ধি করেছেন?

আহমেদ ইসহাক : আম্মা সব সময় কল করে কান্নাকাটি তো করতেনই। তাকে সব সময় আশ্বস্ত করতাম আমি নিরাপদ আছি। তবে দুইটি ঘটনা আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল।

এক. পরপর তিনবার পুলিশের রেড থেকে বাঁচার পর আমার গ্রামের বাড়ি কুমিল্লায় চলে যাই। ৩ আগস্ট আমার বোনকে শহরের একটি হাসপাতালে ভর্তি করাই। আমার ভাগ্নি হয়। তার পাশে দায়িত্বশীল কোনো পুরুষ না রেখেই আমি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে ফের আন্দোলনে যোগ দিতে ঢাকায় চলে আসি। সমস্ত রাস্তা আমি কাঁদতে কাঁদতে আসি। একদিকে বিপ্লব আরেক দিকে প্রিয় বড় বোন! এই কথা বলে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। 

দুই. ১৯ জুলাই শুক্রবার। আন্দোলনে বের হওয়ার সময় আম্মাকে কল দিয়ে কিছুক্ষণ কথা বলে নিলাম। আম্মা সবসময় বলেন, আমাকে নাকি সাদা পাঞ্জাবিতে সুন্দর দেখায়। তাই সাদা পাঞ্জাবি-পায়জামা পরে আন্দোলনে বের হয়েছিলাম। সাথে একটা দীর্ঘস্থায়ী আতর মাখলাম। যদি শহীদ হই, আম্মা যেন দেখে তার শহীদ ছেলেকে সুন্দর দেখাচ্ছে। যেন নিজেকে শান্তনা দিয়ে বলতে পারে— আমার ছেলের শরীর থেকে একটা বেহেশতি খুশবু বের হচ্ছিল।

বাসস : মূল্যবান সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

আহমেদ ইসহাক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা এবং আপনাকেও ধন্যবাদ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
৫ আগস্ট আমাদের লক্ষ্য ছিল গণভবন, এবার সংসদ : নাহিদ ইসলাম
দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় জনগণ ঐক্যবদ্ধ : মির্জা ফখরুল
আমার দেশ সম্পাদক ড. মাহমুদুর রহমানের মায়ের মৃত্যুতে তারেক রহমানের শোক
আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলার মধ্যেই নিহিত এতিম লালন পালনের স্বার্থকতা : ধর্ম উপদেষ্টা
আগামীকাল জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার আলোচনা পুনরায় শুরু
নতুন বাংলাদেশ গড়তে ন্যায়বিচার, সংস্কার ও নতুন সংবিধান জরুরি : নাহিদ ইসলাম
নদীতে গোসল করতে নেমে ৩ শিক্ষার্থীর মৃত্যু
ডিএমপির কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হলো তাজিয়া মিছিল
ভূঁইফোড় সংগঠন বিষয়ে সর্তক করলো বিএনপি 
যুক্তরাজ্য সফরে যাচ্ছেন মাখোঁ, ইইউ’র সঙ্গে সম্পর্ক ‘পুনরুদ্ধারে’ মনোযোগী স্টারমার
১০