ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজ : প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের দুঃসহ স্মৃতি আজও কাঁদায় উপকূলবাসীকে

বাসস
প্রকাশ: ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৯:৪৫
ফাইল ছবি

চট্টগ্রাম, ২৯ এপ্রিল, ২০২৫ (বাসস) : আজ দুঃসহ স্মৃতি জাগানিয়া ভয়াল ২৯ এপ্রিল। বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের ইতিহাসে এক ভয়াল দিন। ১৯৯১ সালের এই দিনে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পুরো উপকূল। 

চট্টগ্রামসহ দেশের উপকূলীয় জেলা-উপজেলার অসংখ্য মানুষ সেই প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রাণ হারান। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিল সর্বত্র। ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল বিস্তীর্ণ উপকূলীয় অঞ্চল। বিশ্ববাসী বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির নিষ্ঠুর এই আঘাত। সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের তিন দশক পেরিয়ে গেলেও, সেই বিভীষিকার স্মৃতি আজও কাঁদায় চট্টগ্রামের উপকূলীয় অঞ্চলের বাসিন্দাদের।

সেই সময়ে স্বজন হারানোর আর্তনাদে ভারী হয়ে উঠেছিল চারদিকের পরিবেশ। 

এ দেশের মানুষ এর আগে আর কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের এত বড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়নি। 

পরদিন সারা বিশ্বের মানুষ অবাকবিস্ময়ে তাকিয়ে দেখেছিলেন ধ্বংসলীলা। আর্তনাদে কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব-বিবেক। সরকারিভাবে বলা হয়, এই দুর্যোগের ১ লাখ ৩৫ হাজার থেকে ১ লাখ ৪৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারায় । তবে বেসরকারিভাবে প্রকৃতির এ ধ্বংসযজ্ঞে মৃতের সংখ্যা আরো বেশি বলে জানা যায়। 

এই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ‘ম্যারি এন’ নামে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি আঘাত হেনেছিল কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পুরো উপকূল। উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারছে না সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি।

এই ঘূর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা, পতেঙ্গা, সন্দ্বীপ, সীতাকুণ্ড, মিরসরাই, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া, পেকুয়া, কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও হাতিয়াসহ পুরো উপকূলজুড়েই মানুষ মারা গিয়েছিলেন। এসব এলাকার কিছু অংশে নির্মিত হয়নি টেকসই বেড়িবাঁধ। এসব এলাকার বেশির ভাগ বেড়িবাঁধ পুরোনো ও দুর্বল। বেড়িবাঁধের অনেক স্থানই ভেঙে গেছে। 

উপকূলীয় এলাকাগুলোতে স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ না হওয়ায়, সামান্য ঘূর্ণিঝড়ের সম্ভাবনাতেও স্থানীয়রা আতঙ্কে দিন কাটান।

ওই ঘূর্ণিঝড়ে বাঁশখালী উপজেলার ছনুয়া ইউনিয়নের মধুখালী গ্রামের বাসিন্দা শওকত আরা বেগম (৫৬) হারিয়েছেন তার তিন ছেলেমেয়েসহ দশ স্বজনকে। সেই প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় তছনছ করে দিয়েছিল গৃহবধূ শওকত আরার পুরো সংসার। তিন দশকের বেশি সময় ধরে সেই দুর্বিষহ স্মৃতি নিয়ে দিন কাটে তার। আজও খুঁজে পাননি ঘূর্ণিঝড়ে হারিয়ে যাওয়া তিন সন্তানের লাশ। 

তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় শব্দটি শুনলেই আমার বুকে কম্পন শুরু হয়। এই বুঝি আবারও সব কেড়ে নিবে সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড়। ছেলেমেয়েদের বাঁচাতে গিয়ে আমিও পানিতে ডুবতে বসেছিলাম। তখন স্বজনদের কেউ একজন আমাকে বাঁচিয়েছে।’

সেদিন চোখের সামনে নিজের ভাই ও নিজ গ্রামের ১৫০ মানুষের মৃত্যুর কথা স্মরণ করে ৭৫ বছর বয়সী আনোয়ারা উপজেলার রায়পুরের আবুল কাশেম জানান, কারো কল্পনায়ও ছিল না যে, এমন কিছু ঘটবে। ঘূর্ণিঝড় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই আমার বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মধ্যরাতে বাতাসের বেগে আমার ঘর ভেঙে যায়। সেখানেই চাপা পড়ে মারা যায় প্রায় এক’শ মানুষ। আমার ছোট ভাইসহ তার পুরো পরিবারও সেদিন মারা যায়। 

১৯৯১ সালের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে অন্যতম। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল মধ্যরাতে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিমি (১৫৫ মাইল/ঘণ্টা)। ঘূর্ণিঝড় ও এর প্রভাবে সৃষ্ট ৬ মিটার (২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরও বেশি। 

ঘূর্ণিঝড়ে মানুষ ছাড়াও মারা যায় প্রায় ২০ লাখ গবাদিপশু। গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। আর্থিক ক্ষতি হয়েছিল ২৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ। প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছিল।

এদিকে আজ (মঙ্গলবার) কক্সবাজার-চট্টগ্রামসহ উপকূলীয় এলাকায় সেই দিনের ভয়াল স্মৃতির স্মরণে দোয়া মাহফিল, খতমে কোরআন ও টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণের দাবিতে র‌্যালি-মানববন্ধন করে স্বজনদের স্মরণ করছে মানুষ। দিবসটি স্মরণে পৃথক দোয়া ও আলোচনা সভার আয়োজন করেছে উপকূলীয় উন্নয়ন ফাউন্ডেশন, সন্দ্বীপ সমিতি, পতেঙ্গা সমাজ বিরোধী প্রতিরোধ কমিটি, চট্টগ্রামের আনোয়ারা সমিতি ও কুতুবদিয়া সমিতি।

১৯৯১ সালের ভয়াল ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড় ‘মেরি এন’ স্মরণে আজ মঙ্গলবার সকালে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব আলোকচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন করে। প্রদর্শনীতে মোট ৫০টি ছবি প্রদর্শিত হয়। এসব ছবিতে ৯১-এর ঘূর্ণিঝড়ের ভয়াবহতা ফুটে উঠে। 

‘কাকঁড়ার ভোজ’ শিরোনামে প্রদর্শিত একটি ছবির বর্ণনা দিতে গিয়ে আলোকচিত্রী শিশির বডুয়া বলেন, লাল কাকঁড়ার দলকে একটি লাশ ৪৫ মিনিটের মধ্যে পুরোপুরি নিঃশেষ করতে দেখেছি। সেই বীভৎস চিত্র ধারণ করেছি আমার ক্যামেরায়। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৯১-এর ভয়াবহতার চিত্র ক্যামেরায় ধারণ করেছিলাম। সেই স্মৃতিগুলো চোখে ভাসলে এখনো কষ্ট পাই। 

তিনি দুর্লভ এই ছবিগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে সংরক্ষণের দাবি জানান।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, ঘূর্ণিঝড় থেকে রক্ষা পেতে আমাদের টেকসই বেড়িবাঁধের বিকল্প নেই।

একই সাথে আমাদেরকে প্রচুর বৃক্ষ রোপণ করে পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে হবে। 

এ লক্ষ্যে শহরের ৪১টি ওয়ার্ডে ১০ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হবে বলে জানান তিনি। 

চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সদস্য সচিব জাহিদুল করিম কচির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত চিত্র প্রদর্শনীতে আরও বক্তব্য রাখেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি মোহাম্মদ শাহ্ নওয়াজ, সাধারণ সম্পাদক সালেহ নোমান, আলোকচিত্র প্রদর্শনী উপ-কমিটির আহ্বায়ক গোলাম মাওলা মুরাদ, আলোকচিত্রী সাংবাদিক শিশির বড়ুয়া ও রূপম চক্রবর্তী প্রমুখ। 

কুতুবদিয়া বাঁচলে দক্ষিণাঞ্চল বাঁচবে, কুতুবদিয়াকে সমুদ্রের বিস্তীর্ণ জলরাশি থেকে রক্ষা করতে টেকসই বেড়িবাঁধ নির্মাণ ও মগনামাঘাট থেকে কুতুবদিয়ায় চলাচলের সুবিধার্থে ফেরি সার্ভিস চালুর জন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি দাবি জানিয়েছেন কুতুবদিয়া সমিতি-চট্টগ্রাম। 

মঙ্গলবার (২৯ এপ্রিল) বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচি থেকে এ আহ্বান জানান হয়। 

এসময় বক্তারা বলেন, ১৯৯১ সালে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ের পর কুতুবদিয়ায় বিগত সময়ে বেড়িবাঁধের জন্য বরাদ্ধ আসলেও, তা ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হওয়ায় আজ কুতুবদিয়ার মানুষ তাদের জীবন নিয়ে সন্ধিহান। বিগত সময়ে কুতুবদিয়ার মানুষকে শুধু স্বপ্নই দেখানো হয়েছে। কিন্তু কেউ তা বাস্তবায়ন করেনি। তাই আজকে কুতুবদিয়ার মানুষ তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সোচ্চার হয়েছে। 

কুতুবদিয়া সমিতি-চট্টগ্রামের সভাপতি ডা. এ কে এম ফজলুল হকের সভাপতিত্বে আরো বক্তব্য রাখেন- উপদেষ্টা সফিউল আলম, সাধারণ সম্পাদক নজিবুল্লাহ হক বাচ্চু, বিশিষ্ট পরিবেশ বিজ্ঞানী ও চট্টগ্রাম শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি ড. কামাল হোসেন প্রমুখ।  

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার প্রজ্ঞাপন পরবর্তী কর্মদিবসে : আইন উপদেষ্টা
রুয়েটে নবীনবরণ অনুষ্ঠিত
যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হওয়ায় ভারত ও পাকিস্তানের প্রশংসা করেছেন প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে নজর দিচ্ছে নেপাল : রাষ্ট্রদূত
মাতৃত্বের প্রতি উৎসর্গিত এক অনন্য দিবস ‘মা দিবস’: তারেক রহমান
৮ লাখ টাকার জাল নোটসহ দুজন গ্রেফতার
সিলেটে কোরবানিযোগ্য পশু তিন লাখ ৯ হাজার
সাবেক এমপিসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন সংগঠনের পাঁচ সদস্য গ্রেফতার
বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ
সীমান্তে বসবাসকারীদের সচেতনতা ও সতর্কতা বৃদ্ধিতে ঝিনাইদহে বিজিবির মতবিনিময়
১০