দেশী হাঁসের খামার করে দিন বদলেছেন সুনামগঞ্জের তরুণরা

বাসস
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:০৪ আপডেট: : ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩:৪০
সুনামগঞ্জে দেশী হাঁসের খামার করে দারিদ্র্যের কবল থেকে নিজেদের পরিবারকে মুক্ত করেছেন এ জেলার কয়েকজন তরুণ। ছবি : বাসস

।। মোহাম্মদ শাহজাহান চৌধুরী।।

সুনামগঞ্জ, ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : দেশী হাঁসের খামার করেই দারিদ্র্যের কবল থেকে নিজেদের পরিবারকে রক্ষা করেছেন এ জেলার কয়েকজন তরুণ। একসময় যাদের পরিবারের সামান্য কৃষি জমিতে চাষাবাদ করে কোনোরকমে দিন চলতো, তারাই এখন মাস শেষে লাখ টাকা ঘরে তুলছেন।

প্রাণীসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে এই জেলায় প্রতিদিন গড়ে সাড়ে ৭ লাখেরও বেশি হাঁসের ডিম উৎপাদিত হয়।  

জেলার সদর উপজেলার লক্ষণশ্রী ইউনিয়নের জমির উদ্দিন ও লিপাস বেগমের বড় পুত্র মনোয়ার হোসেন (৪২) প্রথম এলাকায় হাঁসের খামার করে সফল হন। তার দেখাদেখি এলাকার বেশ কয়েকজন তরুণ এখন হাঁস খামারি করে সফল উদ্যোক্তা। 

বাসসের সাথে আলাপকালে অষ্টম শ্রেণী পাশ মনোয়ার হোসেন বলেন, তার বাবার মাত্র ১৩ বিঘা জমিতে কৃষিকাজ করে যা ফসল ফলতো তাতে পরিবারের খরচ যোগানো কষ্ট হতো। ৪ ভাই, ২ বোন ও  বাবা-মাসহ মনোয়ারদের ৮ সদস্যের সংসার। তিনি বেকার ছিলেন এবং বাবাকে মাঝেমধ্যে কৃষিকাজে সহযোগীতা করতেন ।

তিনি বলেন,`২০০৮ সালের মে মাসে ৩৩ হাজার টাকা দিয়ে ১২৫টি হাঁসের বাচ্চা কিনে প্রথম হাঁসের খামার শুরু করি। সাড়ে ৫ মাস পর প্রথম দফায় ১০৯টি হাঁস ডিম দিতে শুরু করে। তারপর আর পেছনে ফিরে থাকতে হয়নি।'

তিনি জানান, বর্তমানে তার খামারে এক হাজার হাঁস রয়েছে। সাড়ে সাত’শ হাঁস প্রতিদিন ডিম দেয়। বর্তমানে প্রতিটি ডিম ১৫ টাকা দরে বিক্রি করছেন। এতে প্রতিদিন ১১ হাজার ২৫০ টাকা আয় হয়। এতে মাসিক আয় হয় ৩ লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ টাকা। প্রতিদিন হাঁসের খাবারের জন্য গড়ে ৭ হাজার টাকা খরচ হয়। হাঁস ও খামার  দেখাশোনা করার জন্য ৪ জন কর্মচারী কাজ করে। কর্মচারীদের জনপ্রতি মাসিক বেতন ১৫ হাজার টাকা। কর্মচারীদের বেতন, হাঁসের খাবার ও ঔষধসহ খরচ হয় মাসে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা।

হাঁসের ডিম ও হাঁস বিক্রি করে মনোয়ার মাঠে কৃষি জমিও কিনেছেন। আগে তার বাবার ১৩ বিঘা জমি ছিলো। আরো ১১ বিঘা জমি কিনে এখন তারা ২৪ বিঘা জমির মালিক। 

মনোয়ারের হাত ধরে তার ছোট ভাইয়েরাও এখন স্বাবলম্বী। একান্নবর্তী পরিবারে তার দ্বিতীয় ভাই বর্তমানে গরু পালন করেন। তিনি  মৌসুমি গরুর খামারি। এবার ১৪টি গরু পালন করছেন। আগামী ঈদ-উল আযহার সময় বাজারে বিক্রি করবেন। তৃতীয় ভাই কৃষি কাজ করেন। তিনি এখন নিজেদের ২৪ বিঘা জমিতেই চাষাবাদ করেন। সবার ছোট ভাইকে ফ্রান্স পাঠিয়েছন। বোনদেরও বিয়ে দিয়েছেন। 

মনোয়ার বলেন, ‘আমি এখন সুখি মানুষ। আমার দুই ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে এলাকার আলহাজ্জ্ব জমিরুন নূর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। মেয়ে একই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণিতে পড়ে। ছোট ছেলে গ্রামের পাঠশালায় প্রথম শ্রেণিতে পড়ে।’ তিনি জানান, হাঁসের খামারের আয়ে  পৈতৃক জমি বাড়িয়েছেন। ছোট ভাইকে ফ্রান্স পাঠিয়েছেন। পরিবারের খরচ, চিকিৎসা, ছেলে মেয়েদের শিক্ষা খরচ মেটাচ্ছেন।

মনোয়ার আরও জানান, এবছর এপ্রিলের শেষ দিকে হাঁসগুলো বিক্রি করে দেবেন। পরে মে  (জৈষ্ঠ্য) মাসে আবার হাঁসের বাচ্চা কিনবেন। ওই বাচ্চা ৫ থেকে সাড়ে ৫ মাস পর ডিম দেবে। ডিম দেয়া শেষে হলে আবার বিক্রি করবেন। এভাবেই পর্যায়ক্রমে হাঁসের খামার থেকে আয় করেন তিনি। ডিম দেয়া শেষ হলে পুরোনো হাঁস বিক্রি করে নতুন হাঁসের বাচ্চা কেনেন। প্রতিটি  দেশি হাঁস বছরে ১৫০ থেকে ২০০ ডিম দিয়ে থাকে।  

তার খামারের হাঁস ক্রয়ের জন্যও রয়েছে নির্ধারিত ক্রেতা। তিনি জানান, চট্টগ্রামের ২ থেকে ৩টি কোম্পানী এপ্রিলের শেষ দিকে এসে তার হাঁস কিনে নেয়। পুরনো হাঁস ডিম দেয়া শেষে মা হাঁস বিক্রি করা হয়। তারপর সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার হালুয়ারগাঁও এবং জেলার দিরাই উপজেলার দত্তগ্রাম থেকে হাঁসের বাচ্চা কেনেন ।  

জানা যায়, মনোয়ারের হাঁসের খামার দেখে সদর উপজেলার আব্দুল্লাহপুরের  তিন জন, গোবিন্দপুরের একজন, ছাতক উপজেলার জাউয়া বাজারের একজন  এবং তার চাচাতো ভাই ফয়সল আহমদ হাঁসের খামার দিয়ে লাভবান হয়েছেন। তারাও এখন সফল হাঁস খামারি।

মনোয়ারের চাচাতো ভাই ফয়সল আহমদ বাসসকে জানান, মনোয়ারের হাঁসের খামার দেখে ২০১৫ সালে তিনি শুরু করেন হাঁসের খামার। প্রথমে তিনি বুঝে উঠতে না পারায় তেমন লাভবান হননি। পরে মনোয়ারের পরামর্শ নিয়ে ফয়সল এখন সফল।  তিনি জানান, এখন তার খামারে রয়েছে সাড়ে ৪ শত হাঁস। এরমধ্যে ৪ শত হাঁস এখন ডিম দিচ্ছে। 

তিনি জানান, তার বাবা পেশায় একজন পাওয়ার টিলা মেকানিক। হাঁসের খামার দিয়ে তারা স্বাবলম্বী। তার বাবাকে এখন আর কাজ করতে হয়না।

সরেজমিনে,  জেলার বৃহত্তর দেখার হাওরের মারাইখলা নামক এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, মনোয়ার হাওর থেকে হাঁস খামারে নিয়ে আসছেন। দীর্ঘ হাওরের বুকে দল বেঁধে পায়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছে সারি সারি হাঁস। এর পাশেই রয়েছে চাচাতো ভাই ফয়সল আহমদের হাঁসের খামার। এ খামারগুলো মনোয়ার ও ফয়সলের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। রাতে কর্মচারীরা খামার পাহারা দেয়। 

তারা জানান, এখন হাওরের জলমহালের মাছ ধরা শেষ। তাই তারা হাওরেই খামার করেছেন। জৈষ্ঠ্য মাসে হাওরে পানি চলে আসার আগে আগে হাঁসের খামার বাড়ির পাশে নিয়ে যান। আবার হেমন্তে হাওরের মাছ ধরা শেষ হলে খামার হাওরে নিয়ে আসেন।

জেলার প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বাসসকে জানান, মনোয়ার হোসেন সুনামগঞ্জ জেলার মধ্যে একজন সফল ও অভিজ্ঞ হাঁসের খামারি। তিনি আরও জানান, এ জেলায় ছোট বড় অন্তত ২ হাজার ৮ শত হাঁসের খামার রয়েছে। এগুলোতে বছরে ২৭ কোটি ৫৫ লাখ ১১ হাজার ১৮৬টি ডিম উৎপাদন হয়। এতে প্রতিদিন গড়ে ৭ লাখ ৫৪ হাজার ৮২৫টি ডিম উৎপাদন হয়। 

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত
ইবির ‘ল এন্ড ল্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ বিভাগের নতুন চেয়ারম্যান বিলাসী সাহা
দুবাই পালানোর চেষ্টা ব্যর্থ : গাজীপুরের আন্তঃজেলা ডাকাত দলের প্রধান গ্রেফতার
বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে বিভেদ কেন প্রশ্ন এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জুর
বাংলাদেশ ও মালদ্বীপ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও গভীর করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে
বঙ্গোপসাগরে ট্রলারসহ ২৪ জেলেকে উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে বড় পতন, অধিকাংশ শেয়ারের দাম কমেছে
তথ্যপ্রযুক্তি খাতে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়কে কারিগরি সহায়তা প্রদানের জন্য এটুআই-এ আইসিটিসি সেল খোলা হবে : ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব
টিকিট ছাড়া সিলেট টেস্ট দেখার সুযোগ পাচ্ছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
নাগরিক সেবা প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হলো ডিএনসিসি
১০