বাসস
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৪:৪২

ফুলের রাজ্য সাবদি, ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে দর্শনার্থীর ভিড়

ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ফুলের রাজ্য সাবদিতে দর্শনার্থীরা ফুলের বাগানে ঘুরছেন। ছবি: বাসস

নারায়ণগঞ্জ, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস): চারদিকে লাল, নীল, সাদা, হলুদ, গোলাপি ও খয়েরি রঙের ছড়াছড়ি। যেদিকে দু’চোখ যায় দেখা যায় ফুল আর ফুল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। বিস্তীর্ণ মাঠে রঙবেরঙের ফুল। ফুলের সুবাস যেন মন ভরিয়ে দেয়। অপরূপ এই দৃশ্যের দেখামিলে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নারায়ণগঞ্জের বন্দর উপজেলার কলাগাছিয়া ইউনিয়নের সাবদি গ্রামে।

নদীর তীরবর্তী সাবদি গ্রামের পরিবেশ ফুল চাষে অনুকূল হওয়ায় দিনে দিনে এই এলাকায় ফুলের বাণিজ্যিক আবাদ হচ্ছে। অন্য ফসলের তুলনায় লাভজনক হওয়ায় ফুলচাষে ঝুঁকেছেন কৃষক। এতে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবন। আর্থিক দৈন্যতা কাটিয়ে হয়েছেন লাখপতি। কর্মসংস্থান হয়েছে শত শত নারী-পুরুষের। এখানকার প্রতিটি পরিবার কোনো না কোনোভাবে ফুলের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন। পরিচিতি পেয়ে লোকমুখে নাম হয়েছে সাবদি থেকে 'ফুলের গ্রাম সাবদি'।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা মিলে, এই গ্রামের অপরূপ সৌন্দর্য্যের। বিস্তীর্ণ মাঠের যতদূর চোখ যায় গ্লাডিওলাস, গাঁদা, জিপসি, স্টারকলি, জারবেরা ফুল, ক্যালেন্ডেলা, ডালিয়া, সূর্যমুখী, চেরি, চন্দ্রমল্লিকা, নয়নতারাসহ নানান ফুলের সমারোহ। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত নারী, পুরুষ ও শিশুরা ক্ষেতে কাজ করে। কেউ ফুল ছিঁড়ছেন, কেউ বাগানের আগাছা পরিষ্কারে ব্যস্ত। কেউ বা সার ও কীটনাশক প্রয়োগসহ পরিচর্যা করছেন। আবার অনেকে ছিঁড়ে আনা ফুল নিয়ে বাড়ির আঙিনায় বসে মালা গাঁথেন।

সকালে বিকালে দর্শনার্থীদের আগমনে টুরিস্ট স্পট হয়ে উঠেছে এই এলাকা। এছাড়া বছরের বিশেষ দিন ও ছুটির দিন গুলোতে জমে উঠে ফুল বিক্রি। দর্শনার্থীদের কাছে ফুলের মালা, ফুলের ক্রাউন বিক্রি করেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। মালা গেঁথে ঘরে বসেই পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও বাড়তি আয় করে সংসারে সহায়তা করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠছেন। ফুল শ্রমিকরা বলেন, এখানকার নারীরা সাংসারিক কাজের ফাঁকে ফাঁকে ডালা ভরে ফুল ও কলি তুলে যার যার বাড়িতে ফিরে আসে। তারপর এসব ফুল দিয়ে বিভিন্ন গহনা তৈরি করে বিক্রি করেন।

কেরানীগঞ্জ থেকে ফুলের গ্রামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে এসেছেন  ব্যবসায়ী মাহবুব ও তার পরিবার। ফুলের সাথে নিজের ও তার পরিবারের ছবি তুলে দিচ্ছেন। তিনি বলেন, শহুরে পরিবেশে থেকে দালানকোঠায় মন অস্তির হয়ে পড়ে। এজন্য বাচ্চা সহ পরিবারকে নিয়ে এসেছি। এখানে এতো ফুল দেখে ভালো লাগছে, বাচ্চারাও আনন্দ পাচ্ছে।

অপর একজন দর্শনার্থী ফুল প্রেমি আফসানা বলেন, এখানকার  ফুল গুলো শাহবাগ কিংবা অন্য দোকান থেকে কিনি। কিন্তু এই ফুল গুলোর উৎস দেখতে এসেছি আজ। বাচ্চারা ফুলের গাছগুলো দেখবে চিনবে এজন্যই ঢাকা থেকে এখানে এসেছি। এতো ফুল এতো রং একসাথে দেখে চোখ জুড়িয়ে গেছে।

বন্দর উপজেলা কৃষি অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাবদি গ্রামের ফুল চাষ দেখে কলাগাছিয়া ইউনিয়নের দীঘলদি, সেলশারদি, মাধবপাশা ও আইছতলাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে বাণিজ্যিকভাবে এ ফুল চাষ করা হচ্ছে। এই ইউনিয়নের ৮৪ হেক্টর আবাদি জমিতে ২৪-২৫ ধরনের ফুল চাষ হচ্ছে। এই ইউনিয়নের ১৫-১৬ হাজার নারী-পুরুষ এ ফুল চাষে এখন স্বাবলম্বী।

স্থানীয় কৃষকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, বন্দর উপজেলার সাবদীসহ কয়েকটি এলাকায় ফুল চাষ হয়েছে। গাছে ফুল ফুটতেও শুরু করেছে। আর কদিন পরেই পরিপূর্ণ ফুলের দেখা মিলবে। চাষের জমিতে ধীরগতিতে পানি শুকানোর কারণে গাছ রোপনে দেরি হওয়ায় এ বছর সময়মতো ফুল ফুটেনি বলে জানান চাষিরা। এদিকে ফুল বিক্রির মৌসুম ফুরিয়ে যাচ্ছে।

সামনেই আসছে রোজা। রোজায় সামাজিক অনুষ্ঠান কমে যায় ফুলের চাহিদা কমে যায়। তাই কাঙ্ক্ষিত লাভ নিয়ে শঙ্কিত চাষীরা।

সাবদি গ্রামে ৪৫ শতাংশ জমিতে ফুল চাষ করেছেন জাকির হোসেন। তিনি বলেন, সাবদিতে সারাবছরই ফুলের চাষ হয়। এই সময়ে গ্রামের প্রতিটা ঘরের মানুষ ফুলের চাষ করেন, যার জমি নাই,  সেও উঠানে গাছের ফুল চাষ করেন। আমরা এই মৌসুমে ফুলের বিক্রি নিয়ে বেশি আশা করি। কিন্তু ফুল সময়মতো না ফোটায় ফুল বিক্রি নিয়ে চিন্তায় আছি। জাকির হোসন পাইকারি ও খুচরাভাবে প্রতিদিন ৭-৮ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করেন। ছুটিরদিনে প্রায় দ্বিগুণ বিক্রি করেন।  ভালোবাসা দিবস আর শহীদ দিবসকে কেন্দ্র করে ৬০-৭০ হাজার টাকার ফুল বিক্রি করতে পারবেন বলে আশা করছেন।

ফুলের বাগান করা একসময় শুধুই শখের বিষয় হলেও এখন তা বাণিজ্যিক পণ্য। কিছু দিন আগেও এই গ্রামের যে বেকাররা হতাশায় ভুগছিল তারা এখন ফুল চাষ করে স্বাবলম্বী। পড়াশোনা শেষে চাকরি না পেয়ে হতাশায় ভুগছিলেন সাব্বির। কিন্তু এখন বাবার সাথে ফুল চাষ করে স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, পড়াশোনা করলেই কৃষি করা যাবেনা এমন ভাবনা করা ঠিক না। আমি চাকরি করে যে বেতন পাইতাম তার চেয়েও বেশি উপার্জন করছি। নারায়ণগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ফুলের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। আজকে পহেলা ফাল্গুন, ভালবাসা দিবস। আবার সামনেই পহেলা বৈশাখ, একুশে ফেব্রুয়ারি, ছাব্বিশে মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ জাতীয় দিবসগুলো ছাড়াও জন্মবার্ষিকী, মৃত্যুবার্ষিকী, গায়ে হলুদ, গাড়ি সাজানো, বিভিন্ন ধরনের পূজা-পার্বন ও সভা-সমাবেশে ফুলের বেশ চাহিদা রয়েছে। এসব দিবস আসলে ফুলের দাম একটু বেশি পাওয়া যায়।

বন্দর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইয়াসিন আরাফাত বলেন, বন্দর কলাগাছিয়া ইউনিয়ন ফুল চাষের জন্য উপযোগী স্থান। এখানে ফলন বেশ ভালো হয়। ফুল চাষে লাভ হওয়ায় এখানের মানুষ চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। আমরা তাদের প্রশিক্ষণ সহ সার্বিকভাবে সহায়তা করার চেষ্টা করছি।  এ বছর ৮০ হেক্টর জমিতে ফুলচাষ হয়েছে। তবে সামনে রোজা চলে আসায় কৃষকেরা ফুল বিক্রি নিয়ে চিন্তিত।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) সেলিমা খাতুন বলেন, ফুল চাষ লাভজনক। বিশেষ করে বন্দরে ফুল চাষ ব্যাপকতা লাভ করেছে। ফুল চাষীদের আমরা কারিগরি বিষয়গুলো যেমন প্রশিক্ষণ, ফুলের রোগ-বালাই প্রতিরোধে মাঠ পর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা দেখভাল করছে। কৃষকদের কাজে সহয়তার উদ্দেশ্য গুড এগ্রিকালচার অনুশীলনের জন্য তাদের টেকনিক্যাল সাপোর্ট দিয়ে থাকি।