ডিজিটাল সেন্টারের আলোয় বদলে যাওয়া এক গ্রামের গল্প : কেন্দ্রবিন্দুতে উদ্যোক্তা লাভলী রানী

বাসস
প্রকাশ: ২৭ নভেম্বর ২০২৫, ১৬:১৭
প্রতীকী ছবি

ঢাকা, ২৭ নভেম্বর, ২০২৫ (বাসস) : রংপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরের হরিদেবপুর ইউনিয়নে আজ যে দৃশ্য দেখা যায়, কয়েক বছর আগেও তা ছিল অকল্পনীয়। প্রায় সাড়ে ৩৫ হাজার মানুষের এই ইউনিয়নে আগে কোনো দাপ্তরিক সেবা নিতে হলে মানুষের ভরসা ছিল জেলা শহর। জমির দলিল, জন্মনিবন্ধন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদন, কম্পিউটার সেবা-সবকিছুর জন্যই তাদের ছুটতে হতো দূর-দূরান্তে। এতে যেমন সময় নষ্ট হতো, তেমনই বাড়তি খরচ আর ভোগান্তির কারণেও সাধারণ মানুষ ছিলেন অতিষ্ঠ। কিন্তু এখন সেই চিত্র পাল্টে গেছে। ঘরের পাশে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারে এসে মিনিটেই মিলছে সরকারি-বেসরকারি নানা সেবা। আর এই পরিবর্তনের পিছনে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নারী-লাভলী রানী, যিনি নিজের সংগ্রাম জয় করে আজ গ্রামবাসীর জীবনে আলো ছড়াচ্ছেন।

মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে লাভলী রানীর শৈশব-যৌবন কেটেছে নানা সংকটের মধ্যে। বাবা ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে পড়লে পরিবারের আয় বন্ধ হয়ে যায়। তখনই উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ করে জীবনের কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হন তিনি। বেঁচে থাকার তাগিদে চাকরি খুঁজেও কোনো সাফল্য না পেয়ে যখন হতাশ, তখন সরকারের ডিজিটাল সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে পারেন। কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সাহস করে শুরু করেন উদ্যোক্তা হওয়ার পথচলা। তিনি জানতেন না পথটা কতটা কঠিন হবে, তবে শুরু করার সাহসটুকু ছিল তার নিজের ওপর অগাধ বিশ্বাস থেকে।

২০১০ সালে হরিদেবপুর ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে ডিজিটাল সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে কাজ শুরু করেন লাভলী। শুরুটা ছিল অত্যন্ত কঠিন। মানুষ জানতই না ডিজিটাল সেন্টার কী। কেউ আসত না সেবা নিতে। তখন তিনি নিজেই গ্রামে গ্রামে গিয়েছেন। বাড়ির উঠোনে, হাটে-বাজারে মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন, সেবাগুলো বুঝিয়েছেন। বলেছেন-কিভাবে সময়, টাকা ও ঝামেলা কমবে। সাধারণ মানুষ তার কথা শুনতে শুরু করলেন, বিশ্বাসও বাড়তে লাগলো। ধীরে ধীরে সেন্টারে আসতে লাগল মানুষ।

লাভলীর প্রথম দিককার আয় ছিল নামমাত্র। কখনো কখনো সারাদিন কাজ করে ৩০ টাকাও হাতে পেতেন না। পরিবার, সমাজ, আর্থিক সংকট—সব মিলিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হতো। কিন্তু তিনি থেমে যাননি। মনোবল আর পরিশ্রমই ছিল তার মূল শক্তি। লাভলীর ভাষায়, ‘আমি ভেবেছি, যদি পিছিয়ে যাই তবে শুধু নিজেরই নয়, পরিবারও অন্ধকারে ডুবে যাবে। তাই চেষ্টা চালিয়ে গেছি।’

এই চেষ্টা আজ সাফল্যের গল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে লাভলী রানী একজন সফল নারী উদ্যোক্তা। তার ডিজিটাল সেন্টারে কাজ করছেন আরও ৮ জন নারী-পুরুষ। প্রতিদিন ভোরে তিনি নিজেই স্কুটি চালিয়ে ১৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে সেন্টারে আসেন। একসময় মানুষ বলতো-‘মেয়ে হয়ে এসব চাকচিক্যের কাজ কেন?’ আজ সেই একই মানুষ তাকে দেখে অনুপ্রেরণা পান। সমাজ তাকে সম্মান করে, শ্রদ্ধা করে।

এই যাত্রাপথে ব্যক্তিগত জীবনও তার জন্য সহজ ছিল না। বিয়ের কিছুদিন পরই দুর্ঘটনায় এক পা হারান তার স্বামী। দায়িত্ব আরও বেড়ে যায় লাভলীর কাঁধে। বাবার বাড়ি ও নিজের সংসার-দুই জায়গার দায়িত্ব একই সঙ্গে সামলাতে হয়েছে তাকে। তবুও পড়াশোনা থামাননি। কাজ সামলে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। তার স্থিতিশীল মনোভাবই তাকে আজকের লাভলী হিসেবে তুলে ধরেছে।

সেন্টারের প্রতিদিনের ব্যস্ততা এখন চোখে পড়ার মতো। জমির পর্চা, দলিলের নকল, ই-নামজারি, জন্মনিবন্ধন, বিধবা-বয়স্ক-প্রতিবন্ধী ভাতার আবেদন, চাকরির ফরম, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, ই-মেইল প্রেরণ, ছবি তোলা বা কম্পিউটার টাইপিং-প্রায় শতাধিক মানুষ আসে সেবা নিতে। আগে যেসব কাজের জন্য মানুষকে জেলা শহরে যেতে হতো, আজ সেগুলো ইউনিয়নেই সেরে ফেলতে পারছেন কয়েক মিনিটে।

মল্লিকা রানি, যিনি দ্বিতীয় সন্তানের জন্মনিবন্ধন করাতে এসেছিলেন, বললেন, ‘আমার প্রথম সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য অনেক ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছিল। এখন ইউনিয়নেই সেবা মিলছে। লাভলী দিদির সেন্টারে আসলেই মুহূর্তে কাজ হয়ে যায়।’

জমি খারিজের আবেদন করতে আসা মো. আক্তার হোসেন জানান, ‘একই কাজ আগে দালাল ধরে হাজার হাজার টাকা দিয়ে করতে হতো। এখন অল্প টাকায় সরকারি ফি দিয়েই কাজ করে নিতে পারছি। কোনো দৌড়ঝাঁপ নেই।’

ডিজিটাল সেন্টারগুলোর পেছনে কাজ করছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের আওতায় অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই)। তাদের লক্ষ্য-সমাজের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছে স্বচ্ছ, দ্রুত ও কম খরচে সেবা পৌঁছে দেওয়া। এটুআই-এর হেড অব কমিউনিকেশনস মোহাম্মদ সাইফুল আজম জানান, বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৯০০টি ডিজিটাল সেন্টার সক্রিয় আছে, যেখানে ৩৫০টিরও বেশি সেবা দেওয়া হচ্ছে।

তিনি জানান, ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ কোটিরও বেশি সেবা দেওয়া হয়েছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের যাতায়াত, সময় এবং অর্থ-সবই বাঁচছে। ১৬ হাজারের বেশি উদ্যোক্তা এখন এই সেন্টারকে কেন্দ্র করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক-৫ হাজার ২০০ জন নারী উদ্যোক্তা, যারা নিজে দাঁড়িয়েছেন এবং অন্যদেরও দাঁড়াতে সাহায্য করছেন।

এটুআই-এর মতে, ডিজিটাল সেন্টার শুধু সেবা প্রদানের জায়গা নয়; এটি স্থানীয় অর্থনীতিকে গতিশীল করছে, নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষমতায়ন বাড়াচ্ছে এবং সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে শুরু করে সারাদেশে ডিজিটাল সেবা পৌঁছে দেওয়ার এই উদ্যোগ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিও পেয়েছে।

হরিদেবপুরের নারী উদ্যোক্তা লাভলী রানীর গল্প সেই পরিবর্তনেরই বাস্তব উদাহরণ। তিনি দেখিয়েছেন, ইচ্ছা থাকলে একজন নারীও গ্রাম থেকে উঠে এসে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজের পরিবার তো বটেই-পুরো সমাজকেও বদলে দিতে পারেন। তার প্রতিষ্ঠিত ডিজিটাল সেন্টার আজ শুধু সেবাকেন্দ্র নয়; এটি আশার আলো, স্বপ্ন তৈরির জায়গা, পরিবর্তনের প্রতীক।

বাংলাদেশের গ্রামগঞ্জের হাজার হাজার নারী এখন এই আলো দেখে নতুন করে স্বপ্ন দেখছেন। আর সেই স্বপ্নের দিশারি হিসেবে লাভলী রানীর মতো নারীরা এগিয়ে আসছেন নিজেদের জীবনের অভিজ্ঞতা, শক্তি ও সাহস নিয়ে-একটি উন্নত, দক্ষ ও ডিজিটাল বাংলাদেশের পথে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ও বিচারপতিদের জন্য অবমাননাকর কনটেন্ট প্রচার করা যাবে না
ন্যাশনাল প্রিভেন্টিভ মেকানিজমের দায়িত্ব পেল জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দ্রুত আরোগ্য কামনায় দোয়া চেয়েছে বিএনপি
ট্রাম্পের নিষেধাজ্ঞার নিন্দা জানালো দক্ষিণ আফ্রিকা
ডিএসইতে সূচকের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা
মোল্লাহাটে নানা আয়োজনে তারুণ্যের উৎসব উদযাপন
দেশজুড়ে ভবন ও নির্মাণ কাজ অনুমোদনের জন্য পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
রাজধানীতে ফ্ল্যাট বিক্রির নামে প্রতারণার ঘটনায় গ্রেফতার ৩ 
ডা. তাহেরকে দেখতে হাসপাতালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল
ডা. মিলন ছিলেন আবু সাঈদ ও মুগ্ধ’র মতো অগ্নিস্ফুলিঙ্গ : নজরুল ইসলাম খান
১০