বাসস
  ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৩:৩৯

চাকুরি আর ঘর চান নদীভাঙনে নিঃস্ব শহিদ ইমরানের বাবা

প্রতিবেদন: মো: এনামুল

পটুয়াখালী, ১২ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : ‘মা আমি কেবল যাবো আর আসবো’ এ কথা বলেই ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল ইমরান। ফিরে এলো লাশ হয়ে।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে পুলিশের গুলিতে শহিদ হন মো: সাইদুর রহমান ইমরান। 

তিনি পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নের বড় ডালিমা গ্রামের কবির হোসেনের (৫৫) মেজ ছেলে। ইমরানের মায়ের নাম লাভলী বেগম (৪৭)।

পরিবারের তিন সন্তানের মধ্যে ইমরান (২২) ছিলেন দ্বিতীয়। তারা মিরহাজিরবাগ এলাকায় ভাড়াবাসায় থাকেন। বাবা বেকার। তাই সংসারের হাল ধরতে ইমরান চাকুরি করতেন দোকান কর্মচারীর।

বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বাসস)’র এ প্রতিবেদকের কাছে ইমরানের শহিদ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে বাবা কবির হোসেন বলেন, গত ৫ আগস্ট সকালে আলুর ভর্তা বানাতে গিয়ে ওর মায়ের হাত কেটে যায়। পরে ভর্তা বানিয়ে মাকে ভাত খাইয়ে দিয়েছে আমার ছেলে ইমরান। এরপর আমার বড় ছেলে ইমরানকে বলে, আজ কোথাও যাবি না। এ কথা বলে বড় ছেলে বাইরে চলে গেল।

তিনি বলেন, এর কিছুক্ষণ পরে মেজ ছেলে ইমরান জামাকাপড় পরে দরজা খুলে বের হওয়ার সময় ওর মা ডেকে বললো, বাবা তুই আজ কোথাও যাসনে। ও বললো, ‘মা আমি কেবল যাবো আর আসবো’ এ কথা বলেই চলে গেল। ইমরান মূলত আন্দোলনে গেছে ১০টার দিকে। পরে ফোন করলে ইমরান জানায়, অনেক গণ্ডগোল চলতেছে। আমি আসতেছি। এরপর আর ফোন রিসিভ করেনি ইমরান।

ইমরানের পিতা আরো বলেন, এদিকে আমার বড়ছেলে বারবার ফোন করতেছে ইমরানকে, কিন্তু রিসিভ করছিল না সে। পরে আন্দোলনে অংশ নেয়া এক ছাত্র ফোন কল রিসিভ করলো। সে জানালো, যাকে ফোন করেছেন তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন। পরে আবার ফোন করা হলে ইমরানের অবস্থান জানিয়ে সে বলে, ঢাকা মেডিকেলে কলেজ হাসাপাতালে আছে এবং ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়েছে।

তিনি বলেন, ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে ইমরানের মা দেখতে পান তার সন্তানের লাশ। পরে লাশ মিরহাজিরবাগ বাসায় পৌঁছে দেন আন্দোলনের ছাত্ররা। ইমরানকে গোসল করানোর সময় দেখা যায়, তার কাঁধে গুলি লেগেছে। আর মাথার বাম পাশ দিয়ে একটি গুলি ডান পাশ হয়ে বের হয়েছে। আর কপাল থেঁতলে দেয়া হয়েছে। এতেই বুঝা যায় আমার ছেলেটাকে অনেক নির্যাতন করে মারা হয়েছে বলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন শহিদ সাইদুর রহমান ইমরানের বৃদ্ধ বাবা কবির হোসেন।

কবির হোসেন বলেন, প্রথম দফায় বাগিচা মসজিদের ইমামকে দিয়ে মিরহাজিরবাগে জানাজা নামাজ পড়ানো হয়। পরের দিন ৬ আগস্ট অ্যাম্বুলেন্সে করে পটুয়াখালীর বাউফলের নাজিরপুর ইউনিয়নের বড় ডালিমা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দ্বিতীয় দফায় জানাজা দিয়ে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় আমার আদরের সন্তান ইমরানকে।

অর্থনৈতিক সহায়তা প্রাপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে কবির হোসেন বলেন, সবার আগে জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা দিয়েছে। এরপর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। এছাড়া আর কোনো অর্থনৈতিক সহায়তা পাননি বলে জানান তিনি।

সরকারের কাছে শহিদ ইমরানের পিতার বিশেষ আবেদন, শেখ হাসিনার হুকুমে পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। খুব বাজে ভাবে মেরেছে। তাই বর্তমান সরকারের কাছে আমার মিনতি হচ্ছে, আমার ছেলের হত্যাকারীদের বিচার চাই। হুকুমের জন্য শেখ হাসিনা এবং যারা হত্যায় সম্পৃক্ত ছিলো সবার ফাঁসি চাই।

শহিদ ইমরানের বাবা বলেন, প্রতিদিন আমাদের চোখের পানি ঝরে। সারাদিন আমরা ঘরে ইমরানের আলোচনা করি। ওর স্মৃতিগুলো মনে করে কান্না করি। কে দেবে কাকে সান্ত্বনা। আমরা সান্ত্বনার ভাষা খুঁজে পাই না। বলে হু হু করে কাঁদেন শহিদ ইমরানের বাবা কবির হোসেন। 

তিনি বলেন, আমার ঘরটাতে শুধুই শূন্যতা। মনে হয় কেউ যেন ঘরে নাই।

তিনি আরো বলেন, সরকারের কাছে আমার একান্ত চাওয়া। আমরা নদী ভাঙনের লোক। আমাদের সকল সম্পদ নদীতে নিয়ে গেছে। আমাদের মাথা গোজার ঠাঁই নাই। তাই সরকারের কাছে আমার আবেদন। আমার বড় ছেলেটাকে যেন সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। তাহলে বাকি জীবনটা একটু ভালোভাবে কাটিয়ে দিতে পারবো।

আর একটা ঘরের ব্যবস্থা যদি করে দেয়া হয় তাহলে আমরা সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবো বলে জানান শহিদ ইমরানের এই পিতা।

কান্নাজড়িত কন্ঠে শহিদ ইমরানের মা লাভলী বেগম বলেন, আমাকে ইমরান বলেছিল, ‘মা দেশ স্বৈরাচার মুক্ত করতে প্রয়োজনে জীবন দেব। কত মায়ের সন্তান মরতেছে।

আমি কেন ঘরে বসে থাকবো? কত মায়ের বুক খালি হয়েছে, আর আমি বাসায় থাকবো তা হয় না মা।’ ইমরান যখন আন্দোলনে রওনা দিয়েছে, হাত ধরে বলছি বাবা যাস নে। ও বললো, ‘একটুপরেই আসতেছি। টেনশন কইরো না।’ ঘর থেকে বের হওয়ার এক ঘণ্টাও হয়নি, এরমধ্যে খবর পেলাম ইমরান নেই। 

তিনি বলেন, আমার ছেলেকে যারা নির্মমভাবে হত্যা করেছে তাদের সবার বিচার চাই। আমি সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার চাই। তার হুকুমে যারা এই হত্যায় জড়িত ছিলো সবার ফাঁসি চাই। আমি আল্লাহর কাছেও বিচার চাই। বর্তমান সরকারের কাছেও এই খুনিদের সঠিক বিচার চাই। আমি যেন খুনিদের ফাঁসি দেখে মরতে পারি।

এটাই আমার শেষ ইচ্ছা বলে মন্তব্য করেন ইমরানের মা লাভলি বেগম। 

কান্না করতে করতে ইমরানের মা বলেন, আমি ২১ বছর কত কষ্ট করে আমার সন্তান মানুষ করেছি। আমি ছয় বছর আগে একটা মেয়ে হারিয়েছি। এখন আবার ছেলে হারালাম।

এত শোক আমি কিভাবে মেনে নেব? আমি কিভাবে সহ্য করবো? আমার ছেলে আমার ভক্ত ছিলো। সব সময় আমার যত্ম করতো। এখন তো কেউ আমার যত্ম করে না। কেউ বলে না, মা ঠিকমতো ওষধ খাবা বলে কান্নার তীব্রতায় আর কথা বলতে পারেননি লাভলি বেগম।

কিছুক্ষণ পর চোখ মুছতে মুছতে লাভলি বেগম আরো বলেন, আমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই দূর্বল। সরকার এসব বিবেচনা করে সাহায্য সহযোগিতা করলে একটু বেঁচে থাকতে পারি। আর আমার বড় ছেলেকে সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়া হোক। তাহলে আমার সংসারটি কোনোমতে চলে যাবে। সংসার চালানো এখন বড়ই কষ্টের হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা ইমরানই সংসার চালাতো। আজ সে আর আমাদের মাঝে নেই। আমার স্বামীও বেকার। বাকি দুই ছেলেও লেখাপড়া করে। কঠিন অবস্থায় আছি আমরা।

ইমরানের চাচি সুমি আক্তার (৩০) বলেন, ইমরান আমার ভাসুরের ছেলে। সে অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র ছেলে ছিলো। এলাকায় তার অনেক সুনাম আছে। সংসারটি চাকুরি করে একাই চালাতো ইমরান। তার মৃত্যুতে এখন আমার ভাসুরের সংসারে অভাব চলে এসেছে। তাই সরকার যেন ইমরানের ভাইকে একটা সরকারি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেয়।

আর ইমরানের খুনিদের যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়। এটাই সরকারের প্রতি আমার দাবি।

উল্লেখ্য, যাত্রাবাড়ি থানায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রধান করে ১৪৩ জন আসামির বিরুদ্ধে একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে। এতে বাদি হয়েছেন শহিদ ইমরানের মা লাভলী বেগম।