বাসস
  ২২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:৪৭

বাবা মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর স্বপ্ন দেখা তরুণ তামিম এখন কেবলই স্মৃতি

বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ আহসান হাবিব তামিম - ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ

ঢাকা, ২২ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : তামিম ছিল আমার অহংকার। আমি ঘরবাড়ি করি নাই দেশে, ভেবেছি ছেলেরা করতে পারলে করবে। ওদেরকে মানুষ করাই ছিল আমার লক্ষ্য।
রাজধানীর মিরপুর কাফরুল থানার ১৪ নং (পার্ট) ওয়ার্ডের সেনপাড়ার বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ আহসান হাবিব তামিমের বাবা মোটর মেকানিক মো. আব্দুল মান্নান এ কথাগুলো বলছিলেন।

শহিদ তামিমের বাবা জানান, তামিমের স্বপ্ন ছিল পড়ালেখা শেষ করে বড় সরকারি কর্মকর্তা হবে। বাবা-মার দুঃখ কষ্ট লাঘব করে তাদের মুখে হাসি ফোটাবে।

আব্দুল মান্নান বলেন, ‘বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন সফল হয়েছে। কিন্তু আমার ছেলের স্বপ্ন পূরণ হয়নি। তামিম মেধাবী ছাত্র ছিল। তার আস্থা ও বিশ্বাস ছিল, কোটা প্রথা বাদ না হলে, যত ভাল লেখাপড়া করুক না কেন এ দিয়ে কোন কাজ হবে না। কোটা প্রথা বাতিল হলে মেধাগুণে একটা ভালো সরকারি চাকরি তার হবে। চাকরি হলে বাবা-মার দুঃখ-কষ্ট লাঘব হবে। তাদের মুখে হাসি ফুটবে। তার সে স্বপ্ন পূরণ হল না। পুলিশের গুলিতে সব শেষ হয়ে গেলো।’

শহিদ তামিমের পিতা আব্দুল মান্নান (৪৪) ঢাকার মিরপুরের কাজীপাড়ায় একটি গাড়ির গ্যারেজে কাজ করেন। তিনি মিরপুর এলাকায় ভাড়া বাসায় স্ত্রী রাজিয়া সুলতানা (৪০) ও তিন ছেলে নিয়ে থাকেন। তামিম ছিল তার মেজো ছেলে। আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বড় ছেলে আরমান হোসেনকে (২২) লেখাপড়া করাতে পারেননি। বড় ছেলে বাবার সঙ্গে গাড়ির গ্যারেজে কাজ করেন। ছোট ছেলে রায়হান হোসেনের বয়স বর্তমানে পাঁচ বছর।

তামিমের বাড়ি নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার ৩নং পরকোট ইউনিয়নের পূর্ব শোশালিয়া গ্রামে। গত ১৯ শে জুলাই পুলিশের গুলিতে তার স্বপ্নের সাথে পরিবারের স্বপ্নও তছনছ হয়ে গেছে। ওই দিন বিকালে রাজধানীর মিরপুর ১০নং গোলচত্বর এলাকায় কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে আহত হন তামিম। পরে সন্ধ্যা ৭ টার দিকে তামিমের নিথর দেহের খোঁজ পাওয়া যায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার শরীরের ডান পাঁজরের নিচ ও বাম হাত গুলিবিদ্ধ হয়।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন তামিম। ২০ জুলাই ভোরে নিহত তামিমকে চাটখিলে নিজ গ্রামে পারিবারিক কবরস্থানে জানাজা শেষে দাফন করা হয়।

শহিদ তামিমের বাবা বলেন, ‘গত ১৯ জুলাই বিকেলে আমরা দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বাসায় ঘুমিয়ে ছিলাম। আমি তার বন্ধুদের থেকে শুনেছি, তামিম বাসা থেকে বের হয়ে তাদের সঙ্গে আন্দোলন দেখার জন্য গিয়েছিল। আন্দোলনের ভয়াবহতা দেখে সে মিরপুরের শাহ আলী মার্কেটের পেছন দিয়ে ফিরে আসছিল। এ সময় সে গুলিবিদ্ধ হয়।’

তিনি বলেন, ‘ফোনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে আমি প্রথমে মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর, তারপর আল হেলাল হাসপাতালে যাই। আল হেলাল হাসপাতালে গেলে সেখান থেকে আমাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যেতে বলা হয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে আমি তামিমের গুলিবিদ্ধ মরদেহ খুঁজে পাই।’

আবদুল মান্নান কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, অতি কষ্টে মেজো ছেলে আহসান হাবিব তামিমকে লেখাপড়া করিয়েছেন। তামিম তার পরিবারের অভাবের কথা চিন্তা করে মিরপুর এলাকায় একটি কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে খণ্ডকালীন চাকরি করতেন। তিনি তার মা-বাবাকে স্বপ্ন দেখিয়ে বলতেন, লেখাপড়া শেষ হলে পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে তিনি চাকরি করবেন। কিন্তু তার সে স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। পুলিশের গুলিতে সব তছনছ হয়ে গেলো।

পরিবারের সঙ্গে এই প্রতিবেদক কথা বলতে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তাঁর মা রাজিয়া সুলতানা। বিলাপ করতে করতে বলেন, ‘আমার তামিম সব সময় হাসি মুখে থাকত। ভালো চাকরি পেয়ে সংসারের হাল ধরবে, বলত সব সময়। ওই দিন আমি কত করে বললাম নিচে যাইস না। ও শুনল না। ওর স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। তামিম আমারে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল।’

তিনি বলেন, ঘটনার দিন তামিম বাসার নিচে যাবে বলে বড় ভাইয়ের কাছে টাকা চায়। নিচে সংঘর্ষ চলায় টাকা না দিয়ে বাসায় থাকতে বলে ভাই। তবুও আমার ব্যাগ থেকে ২০ টাকা নিয়ে নিচে যায় তামিম। ওই সময় আমাকে বলে, ‘মা আমি যাব আর আসব। আমি মারামারিতে যাব না। এখনই আসছি।’ কিন্তু তামিম ফিরেছে লাশ হয়ে।

কারো কাছ থেকে কোন সহযোগিতা পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে আব্দুল মান্নান বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচলাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পেয়েছি।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে প্রত্যাশার বিষয়ে বাবা মান্নান বলেন, আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই। পরিবারের নিরাপদ ভবিষ্যত চাই। সরকারের প্রতি আহবান, আমার ছেলেদের ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে যাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পাশাপাশি যারা বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে নিহত হয়েছেন রাষ্ট্রীয় ভাবে সবাইকে শহিদের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, ‘অকালেই এমন একজন মেধাবী শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরে যাওয়া কখনোই কাম্য নয়। আমরা তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।’

তামিমের চাচা মো. মোস্তফা বলেন, ‘আমাদের আশা ভরসা সবই শেষ। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই তো বাবা-মা একজন সন্তানকে লালন পালন করেন। সে আশা শেষ হয়ে গেল। আমাদের আফসোস করা ছাড়া তো আর কিছুই করার নাই।’

এদিকে তামিমের শহিদ হওয়ার ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরসহ ৯৫ জনের বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় হত্যা মামলা করা হয়েছে। শহিদ তামিমের পিতা আব্দুল মান্নান বাদী হয়ে এ মামলা দায়ের করেন।