বাসস
  ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪:৪৪
আপডেট : ২৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১৫:২৮

‘কোটি টেকা দিলেও ফুয়া হারানির জ্বালা মিটতো নায়’- শহিদ পাভেলের পিতা

শহিদ পাভেল আহমদ কামরুল -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন: সেলিম আউয়াল ও শুয়াইবুল ইসলাম

সিলেট, ২৫ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : ‘আমার ফুয়া (ছেলে) শহিদ হওয়ার পর অনেকে টাকা দিছইন, অনেকভাবে সাহায্য করছইন। আমরা তারার কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু হাছা কথা অইছে, কোটি টেকা দিলেও ফুয়া হারানির (হারানোর) জ্বালা মিটতো নায়। আমি চাই আমার ফুয়ারে যারা হত্যা করছে তারার বিচার অউক (হোক)। ন্যায় বিচার ফাইলেই আমার মনে শান্তি আইবো।’

কথাগুলো জুলাই বিপ্লবের শহিদ পাভেল আহমদ কামরুলের বাবা মো. রফিক উদ্দিনের। তার বাড়ি সিলেট নগরীর পাশের উপজেলা গোলাপগঞ্জে। উপজেলা সদর থেকে প্রায় নয় কিলোমিটার দূরে উত্তর কানিশাইল গ্রামে। গ্রামটি সালামগাঁ রোডের পাশে। এটি ৬নং ঢাকা দক্ষিণ ইউনিয়নের এক নম্বর ওয়ার্ডের একটি গ্রাম। রফিক উদ্দিন একসময় ছোটোখাটো ব্যবসায়ী ছিলেন। এখন শাকসবজির চাষ করে জীবন চালান। তাদের এলাকাটি মৌসুমী শাকসবজির জন্যে খুব বিখ্যাত। পাভেল (২৪) ছিলেন তার পাঁচ ছেলে-মেয়ের মধ্যে চতুর্থ।

রফিক উদ্দিনের অন্য সন্তানেরা হচ্ছেন, প্রথম পিপলু আহমদ, দ্বিতীয় টিপু সুলতান, তৃতীয় কন্যা মাসুমা আক্তার (বিবাহিত), চতুর্থ পাভেল এবং পঞ্চম সায়েল আহমদ। পাভেলের মা মোছাম্মত দিলারা বেগম।

পাভেল দারুল উলুম হোসাইনিয়া মাদ্রাসা থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ ২৮ পারা হিফজ করেছেন। মাদ্রাসাটি গোলাপগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণে। তিনি সিলেট নগরীর গোটাটিকরের আনজুমানে তালিমুল কোরআন নামক প্রতিষ্ঠান থেকে কারিআনাও পড়েছেন।

পাভেলের মামার বাসা সিলেট নগরীর কাজির বাজারে। এটি প্রায় দুশো বছরের পুরনো একটি বাজার। এখানে কাজিরবাজার জামেয়া নামে একটি মাদ্রাসার খুব সুনাম। পাভেল সেই মাদ্রাসায় পড়ার জন্যে গ্রাম ছেড়ে সিলেট নগরীতে চলে আসেন। থাকতেন মামার বাসায়। আর মাদ্রাসায় ভর্তির প্রস্তুতি হিসেবে একটি মুদির দোকানে পার্টটাইম জব নেন।

পাভেলের ভাই পিপলু বলেন, ৫ আগস্ট বিকেল ৪টার দিকে আমরা গোলাপগঞ্জ উপজেলা সদরের চৌমুহনা নামক স্থানে। হাজার হাজার মানুষে ছেয়ে আছে চৌমুহনা চত্বর, শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর আকাশ-বাতাস। সেনাবাহিনী শান্ত রাখছে জনতাকে। তখুনি আমাদের কাছে খবর আসে পাভেলের গায়ে গুলি লেগেছে। পাঁচ-সাত মিনিট পরই খবর আসে গুলিটা লেগেছে পাভেলের বুকে।

পরিবারের কাছ থেকে শোনা ওই দিনের ঘটনা সম্পর্কে জানা গেছে, ৫ আগস্ট, বেলা ৩টা। সিলেট নগরী তখন স্বৈরাচারমুক্ত হতে চলেছে। নগরী জনতার পদভারে প্রকম্পিত। কিন্তু পুলিশ তখনো জনতার ওপর চালাচ্ছে গুলি। পাভেলরা তাদের মিছিল নিয়ে নগরীর চাঁদনিঘাট এলাকায়। ঘাটটি সুরমা নদীর পাড়ে। সিলেটের ঐতিহ্যবাহী একটি স্থান। এখানে ত্রিভুজাকৃতির কোমরতক উঁচু একটি বাউন্ডারির ভেতরে ‘আলী আমজাদের ঘড়ি’ নামে গির্জার চূড়ার মতো শতবর্ষী পুরনো বিশাল ঘড়িঘর। পাশেই ‘কিন ব্রিজ’ নামে লোহার ব্রিজ।

পাভেলদের মিছিল ঘড়িঘরের কাছে আসতেই পুলিশ মিছিলের মানুষের ওপর গুলি চালায়। বুকে এসে গুলি লাগে পাভেলের। পাভেল ঘড়িঘরের বাউন্ডারির দেয়ালের ওপর ঢলে পড়েন। তার সাথে ছিলেন রাশেদ নামের কাজিরবাজারের আরেক ব্যবসায়ী, তার পায়ে গুলি লাগে। রাশেদের বয়স ২৭/২৮ বছর। তারপর সেবুল নামে কাজির বাজারের আরেক ব্যবসায়ী পাভেল ও অন্যান্য আহতকে ওসমানী হাসপাতালে নিয়ে যান। পাভেলের মামারাও ওসমানী হাসপাতালে যান। তারা সেখান থেকে নিয়ে আসেন পাভেলের প্রাণহীন দেহ।

পাভেলের বাবা রফিক উদ্দিন পাঁচ বছর আগে স্ট্রোকের শিকার হয়েছিলেন। পাভেলের লাশ বাড়িতে আনার পর একবার পুত্রের মুখটা দেখেন। বুকে ধড়ফড় শুরু হয়। আর দেখেতে পারেননি।

রফিক উদ্দিনের বাড়ি থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সুউচ্চ একটি পাহাড়ের চূড়ায় ‘গরিবুল্লাহ শাহ তের অলির মাজার শরিফ’-এর পাশে পাভেলকে দাফন করা হয়েছে।

এদিকে রফিক উদ্দিন স্থানীয় পুলিশকে আসামী করে মামলা করেছেন। তাকে নিয়ে আমরা টিলা বেয়ে যখন চূড়ায়  উঠি, দেখি চোখ দুটো ভেজা। আমরা যখন কবরের পাশ দাঁড়িয়ে দোয়া করছি, পাভেলের পিতার হাত দুটো আকাশের দিকে। তার চোখে তখন পানির বান ডেকেছে।