শিরোনাম
প্রতিবেদন : বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ২৭ জানুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন ইয়াসিন আহামেদ রাজ। তাকে হারিয়ে মা সাহিদা বেগম এখন অকূল সাগরে। উপার্জনক্ষম সন্তানের মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে ঘোর অমানিশা। বেদনা কাতর সাহিদার যখনই মনে পড়ে সন্তানের মুখখানি, তখনই ছুটে যান তাঁর কবরের পাশে। অপলক চোখে উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকেন সন্তানের চিরনিদ্রায় শায়িত কবরের দিকে। তার বুকভরা হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে যেন ভারি হয়ে ওঠে চারপাশের বাতাস।
সাহিদা বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে ইয়াসিন আহামেদ রাজ ও মেয়ে ফারজানা আক্তারকে রেখে তার বাবা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছেন ১০ বছর আগে। ছেলে রাজ পিকআপ ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতো। ছেলেই ছিল আমার একমাত্র সম্বল। এখন আমার কি হবে? কে কিনে দেবে ঔষধ? আর কিভাবে দেবো বাসা ভাড়া? আমার মেয়ের পড়াশোনার খরচ পাবো কোথা থেকে?’
তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে কষ্ট করে সংসার চালাতো। আমি অসুস্থ। কোনো কাজ করতে পারি না। মেয়েটা বড় হয়েছে। ওকে কি করে বিয়ে দেব? সরকার যদি আমার মেয়েকে একটা চাকুরি দিতো তাহলে আমরা মা-মেয়ে খেয়ে পরে বাঁচতে পারতাম।’
সম্প্রতি রাজধানীর কোতোয়ালি থানার বাবু বাজার এলাকার কে পি ঘোষ ষ্ট্রীটের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ ইয়াসিন আহামেদ রাজের মা সাহিদা বেগম এসব কথা বলেন।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন। এরপর দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। এ খবর শোনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ উল্লাস শুরু করে। তবে সারাদেশ ব্যাপী যখন চলছে বিজয় উৎসব, তখনও বংশাল চৌরাস্তায় চলছে পুলিশ ও সাধারণ জনতার মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া এবং গোলাগুলি। এর একপর্যায়ে বংশাল চৌরাস্তায় পুলিশের গুলিতে শহিদ হন পিকআপ ভ্যান চালক ইয়াসিন আহামেদ রাজ। পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম সন্তানকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন মা সাহিদা বেগম ও বোন ফারজানা আক্তার।
ইয়াসিন আহামেদ রাজ পুরান ঢাকার স্থায়ী বাসিন্দা। তার মা সাহিদা বেগম (৫২)। বাবা ফারুক আহামেদ (৬৪)। বোন ফারজানা আক্তার বদরুন্নেসা কলেজে অনার্স ১ম বর্ষে লেখা পড়া করছেন। রাজের মা ও বোন কে পি ঘোষ ষ্ট্রীট এলাকায় একটি ছোট রুমের বাসায় ভাড়া থাকেন।
গত ৫ আগস্ট রাতে পিকাপ ভ্যানটি ঠিক আছে কি না দেখতে বের হন রাজ। তখন তার পিঠে গুলি লেগে তিনি ঘটনাস্থলেই শহিদ হন। পরদিন ৬ আগস্ট সকাল ১১ টার দিকে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে শহিদ রাজের মা সাহিদা বেগম বলেন, সারাদেশের আন্দোলনের কারণে ৩ আগস্ট থেকে রাজের গাড়ি চালানো বন্ধ ছিল। বংশাল চৌরাস্তার পাশের একটি গ্যারেজে পিকআপ ভ্যান রাখতো সে। সেদিন দুপুরে যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলো, এর পরে সন্ধ্যায় নাস্তা করে, আমাকে বলে আম্মু আমি গাড়িটা দেখে আসি। গত দুদিন তো গাড়িটার কোন খবর রাখতে পারিনি। এখনতো আন্দোলন থেমে গেছে, আমি গিয়ে দেখে আসি। এই বলে সে বাসা থেকে বের হয়ে যায়। পরে রাত ১০ টার দিকে ওর চাচার ফোনে কল করে জানানো হয় রাজের গুলি লাগছে। তখন ওর চাচা আমাদের ফোন করে ঘটনা জানায়। এই শুনে আমি আমার ভাইকে সাথে নিয়ে বংশাল চৌরাস্তায় যাই। তখনও গোলাগুলি চলছে। এর মধ্যে জনতা রাজকে তাৎক্ষণিকভাবে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে আমরা মেডিকেল থেকে লাশ নিয়ে আসি এবং পরের দিন আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করি।
সরেজমিনে রাজের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে, দ্বিতীয় তলার একটি ছোট অন্ধকার রুমের এক পাশে ছেলে রাজের ছবি নিয়ে বসে আছেন মা। বার বার ছবিতে হাত দিয়ে মুখ মুছে দিচ্ছেন। আর চোখের জল ফেলছেন। একই সাথে বারবার বলছেন, ‘কোথায় গেলি বাবা? আমাকে কে দেখবে? তোর বোনকে কে দেখবে? এই ভাবে আমাদের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলি?’
রাজের ছোট বোন ফারজানা আক্তার বলেন, ‘ভাইয়াকে হারিয়ে সব সময় কান্না করেন মা। কোন কোন সময়ে শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে নিশ্চুপ বসে থাকেন ঘরের এক কোণে। ভাইয়ের ইনকামেই আমাদের সংসার চলতো। এখন আমাদের কি হবে? কে দেখবে আমাদের? বাসা ভাড়া কিভাবে শোধ করবো, এই ভেবেই দিন কাটে আমাদের।’
সন্তান হত্যার বিচার চান কি না? এমন প্রশ্ন করলে রাজের মা সাহিদা বেগম বলেন, আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, আমি তদন্ত করে দোষিদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই। আমার ছেলে মারা যাবার পর আমি তাকে দেখেছি। হাসপাতালে গিয়ে দেখি তাকে সাদা কাফনের কাপড় পরিয়ে রেখেছে।
ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা রাজনীতি করিও না, বুঝিও না। আমরা সাধারণ মানুষ। ছেলেকে হারিয়েছি। এ জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ সরকার। আমি দোষীদের বিচার চাই।’
কারো কাছ থেকে কোন আর্থিক সহযোগিতা না পাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা খুব বিপদে আছি।’
ইয়াসিনের মামা ইকবাল হোসেন বলেন, রাজ ৫ আগস্ট বিকেলে টিএসসি, শাহবাগ, গণভবনসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে সন্ধ্যায় বাসায় ফেরে। এরপর খাওয়া দাওয়া করে পিকআপ ভ্যানটি দেখতে গিয়ে বংশাল চৌরাস্তায় শহিদ হয়। ওর বাবা ওদের ছেড়ে চলে যাওয়ার পর রাজ এই সংসারের হাল ধরে। ছেলেটা অনেক কষ্ট করে এই সংসার চালাতো। পিকআপ ভ্যান চালিয়ে যা আয় করতো তাই দিয়ে চলতো আমার বোনের সংসার। এখন এই পরিবারের আয়ের কোন পথ রইলো না। সরকার যদি আমার ভাগ্নিডারে একটা চাকুরির ব্যবস্থা করে দিত, তাহলে পরিবারটা বেঁচে যেত।
ইয়াসিন আহমেদ রাজ অনেক ভালো মানুষ ছিল বলে জানান বাসার নিচের জনতা ট্রেডার্সের কর্মচারি রুবেল হোসেন।
তিনি জানান, রাজ ভাই খুব ভালো মানুষ ছিলেন। তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুব দুর্বল ছিল। তার বাবা তাদের ছোট রেখে চলে গেছেন। তখন তার মা খুব কষ্ট করে তাদের বড় করেছেন।
এদিকে ইয়াসিন আহমেদ রাজ হত্যার ঘটনায় গতবছরের ১৯ সেপ্টেম্বর বংশাল থানায় একটি হত্যা মামলা করেন তার মা সাহিদা বেগম। এতে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলার আবু সাইদকে প্রধান আসামী করে ২৭ জনের নামে মামলা করা হয়েছে।