শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : ‘আম্মা আমরা জিতছি, আজকে মিছিল কইরা কালকে বাড়ি আমু। তুমি চিন্তা কইরো না, আমার জন্য দোয়া কইরো।’
গত ৫ আগস্ট বিজয় মিছিলে অংশ নিয়ে মা মমতাজ বেগমের সাথে বিজয়ের আনন্দ ভাগ করতে গিয়ে তোফাজ্জল হোসেন খান এমন কথা বলেছিলেন। মায়ের সঙ্গে এটাই ছিল নির্মাণ শ্রমিক তোফাজ্জল হোসেনের শেষ কথা। আর বাড়ি ফেরা হয়নি তোফাজ্জলের। সেদিন বিকেলে রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরে বিজয় মিছিল করতে গিয়ে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে শহিদ হন তিনি।
সম্প্রতি মোবাইল ফোনে তোফাজ্জলের মা মমতাজ বেগমের সঙ্গে বাসস প্রতিবেদকের সাথে কথা হলে তিনি এমন কথা জানান।
রাজধানীর মিরপুর-২ এর স্টেডিয়াম এলাকার একটি চায়ের দোকানে রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপ হয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে শহিদ তোফাজ্জল হোসেন খানের বড় ভাই মোফাজ্জল হোসেন খানের। তবে তোফাজ্জলের মা ও স্ত্রী ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়ার ভালুকজান গ্রামে অবস্থান করায় তাদের সাথে এই প্রতিবেদকের মোবাইল ফোনে কথা হয়।
তোফাজ্জল হোসেন খানের মা বলেন, ‘আপনারা আমার ছেলেরে আইন্না দেন। ও আমারে ফোনে কইছে আম্মা আমরা জিতছি, আজকে মিছিল কইরা কালকে বাড়ি আমু। তুমি চিন্তা কইরো না, আমার জন্য দোয়া কইরো। কিন্তু আমার ছেলেডা বাড়ি ফিরলো লাশ হইয়া।’
মা মমতাজ বেগম বলেন, ‘সেদিন বেলা দুইটার দিকে ফোন করলেও কথা বলতে পারিনি। বলেছিল, সন্ধ্যায় ফোন করবে। ছেলে ফোন না করায় আমি কয়েকবার চেষ্টা করে ওর ফোন বন্ধ পাই। তখন ওর সহকর্মী ও মালিককে ফোন করি। কিন্তু কেউ বলতে পারছিল না। পরের দিন তোফাজ্জলকে পাওয়া গেছে। তখনই আমি বুঝে যাই, আমার বাজানকে মেরে ফেলা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘আমার বাবা তো আর আমার সঙ্গে কথা বলতে পারল না। আমার ছেলেরে যারা মারছে, তাদের বিচার চাই।’
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে। এ খবর শোনার পর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে লাখ লাখ ছাত্র-জনতা ও সাধারণ মানুষ উল্লাস শুরু করে। লাখো মানুষের সাথে বিজয় উল্লাস করতে বের হন তোফাজ্জল হোসেন খান।
তোফাজ্জলের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ফুলবাড়িয়া পৌরসভার ভালুকজান গ্রামে। বাবা নেকবর আলী খান মারা গেছেন এক বছর আগে। মা মমতাজ বেগম (৫৫)। চার ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তোফাজ্জল ছিলেন তৃতীয়। সংসারের কষ্ট দূর করতে দুই বছর আগে মা, স্ত্রী ও সন্তানকে বাড়িতে রেখে তোফাজ্জল (২৯) ও তাঁর ভাই মোফাজ্জল হোসেন খান (৩৮) পাড়ি জমান রাজধানী ঢাকায়। ভবন নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে দুই ভাই কাজ শুরু করেন। ভালোই চলছিল সংসার। এক বোনকে বিয়ে দিলেও আরেক বোনের বিয়ে দেওয়া বাকি।
তোফাজ্জলের স্ত্রীর নাম হামিদা খাতুন (২৩)। তাঁর তাছফিয়া আক্তার নামে ১৬ মাস বয়সী একটি মেয়ে আছে।
তোফাজ্জলের স্ত্রী হামিদা খাতুন বলেন, ‘৪ আগস্ট রাতেও রাবার বুলেট খেয়ে আসার পর তোফাজ্জলের সাথে আমার কথা হয়েছিল। তখন বলেছিল, ‘আমি যদি মরে যাই, তাহলে আমার সন্তানকে দেখে রাখবা না?’ ৫ আগস্ট বেলা তিনটার দিকে সর্বশেষ আমার সঙ্গে কথা হয়। বলেছিল, স্টেডিয়ামের মধ্যে আছে। আমি তাকে সেখান থেকে চলে যেতে বলি।
চলে যাবে বলেছিল। রাতে কথা বলবে কথা দিয়েছিল। কিন্তু আর কথা বলতে পারেনি।’
তিনি বলেন, ‘স্বামী আমাদের অথই সাগরে ফেলে চলে গেছে। মেয়ে তার বাবার জন্য কান্নাকাটি করে। ব্যানারে থাকা ছবি দেখে বাবাকে ধরতে চেষ্টা করে। বাবাকে ডাকে। সে (তোফাজ্জল) সব সময় আমার কথা শুনলেও সেদিন আমার কথা না শুনে আন্দোলনে যায়। বাবার খুব আদরের মেয়ে ছিল তাছফিয়া। বাবা কী জিনিস, বোঝার আগেই তাকে ছেড়ে চলে গেছেন তিনি।’
তোফাজ্জলের বড় ভাই মোফাজ্জল হোসেন জানান, তারা চার ভাই ও দুই বোন। এক ভাই শারীরিক প্রতিবন্ধী।
কোনো জায়গা জমি নেই তাদের। ভিটেমাটি বলতে একটি থাকার ঘর করার জায়গা রয়েছে।
তিনি বলেন, অভাবের সংসারে আমরা লেখাপড়া করতে পারিনি। গরিব ঘরের ছেলে, মা, ভাইবোনদের তো খাওয়াতে হবে। তাই দুই ভাই কাজের সন্ধানে চলে আসি ঢাকায়।
আমাদের আয়ে দু’বেলা খেয়ে কোনোরকমে সংসার চলছিল। কিন্তু এরইমধ্যে তোফাজ্জল মারা গেলো। গত ৫ আগস্ট বিকেল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে মিরপুর-২-এর স্টেডিয়াম এলাকায় গুলিবিদ্ধ হয় সে।
জানা গেছে, ওই দিন সন্ধ্যা থেকে তোফাজ্জলের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছিল। এরপর সহকর্মী ও স্বজনেরা খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। মিরপুর এলাকার বেসরকারি আজমল হাসপাতালে গিয়ে তোফাজ্জলের ছবি দেখালে হাসপাতালের লোকজন তাঁকে শনাক্ত করেন। পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে তোফাজ্জলের লাশ পাওয়া যায়। স্বজনেরা জানতে পারেন, গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর স্থানীয় লোকজন তোফাজ্জলকে ওই হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করে লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠান। অজ্ঞাতনামা হিসেবে ৫ আগস্ট রাতে লাশ ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়। মরদেহের বুকে লাগানো টোকেন থেকে তাঁরা সময়টি জানতে পারেন। ৬ আগস্ট বিকেলে ময়নাতদন্ত ছাড়াই লাশ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়।
শরীরে ছররা গুলি নিয়েই গত ৫ আগস্ট ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেন তোফাজ্জল। সেদিন মাথার পেছনে গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি শহিদ হন।
মোফাজ্জল রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকায় নির্মাণ শ্রমিকের কাজ করেন। তিনি বলেন, শুরু থেকেই আন্দোলনে অংশ নিচ্ছিলেন তোফাজ্জল। গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার আগের দিন শরীরের বিভিন্ন অংশে সাতটি রাবার বুলেট লেগেছিল। পরদিন আবার মিছিল করতে গেলে পেছন দিক থেকে গুলি লাগে। মাথার পেছনে দুটি গুলি লেগে একটি বেরিয়ে গেলেও অন্যটি আটকে ছিল।
তিনি বলেন, গুলি লাগার পরপরই আমার ভাই মারা গেছিল বলে শুনেছি। ৬ আগস্ট ঢাকা মেডিকেলের মেঝেতে শোয়ানো অবস্থায় লাশ পাই। তোফাজ্জলের সঙ্গে থাকা মুঠোফোন, মানিব্যাগ কিছুই পাওয়া যায়নি।
মোফাজ্জল জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চেক ও জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে ২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
শহিদ তোফাজ্জলের সহকর্মী আশিক বলেন, কারও কথা না শুনে ভবনের কাজ ফেলে ছাত্র আন্দোলনে চলে যেতেন তোফাজ্জল। মৃত্যুর আগের দিন আন্দোলনে গিয়ে শরীরের বিভিন্ন জায়গায় রাবার বুলেটবিদ্ধ হয়েও চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে আন্দোলন করেছেন। রাবার বুলেটবিদ্ধ হওয়ার পর আন্দোলনে যেতে তাকে আমরা মানা করি। কিন্তু কোনো কথাই তাঁকে দমাতে পারেনি।
এদিকে এ হত্যার ঘটনায় বড় ভাই মোফাজ্জল হোসেন খান বাদী হয়ে ঢাকার মিরপুর মডেল থানায় ২৭ আগস্ট একটি মামলা করেন। মামলায় শেখ হাসিনাসহ ২৬ জনের নাম উল্লেখ করার পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা আরও ৬০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।