শিরোনাম
প্রতিবেদন : মোঃ তানভীর হায়াত খান
নেত্রকোনা, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫(বাসস) : রমজান, বয়স ২৪। বাবা মায়ের প্রথম সন্তান। গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের নন্দীপুর গ্রামে। এসএসসি পাশের পর হাল ধরতে বাধ্য হন সংসারের। পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। জীবিকার জন্যে চলে গিয়েছিলেন রাজধানী ঢাকায়। কাজ করতেন আকিজ গ্রুপের সেলসম্যান হিসেবে। রামপুরায় আত্মীয়ের বাসায় খরচ ভাগাভাগি করে থাকতেন। কৃষক বাবার এই সন্তান চাকরি করে যা আয় করতেন নিজের খরচের টাকা রেখে বাকি টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন বাবা, মা এবং ছোট ভাইয়ের জন্যে। দুই ভাই, এক বোন আর বাবা -মা নিয়ে ছোট্ট সুখের নীড় ছিল তাদের।
ছোট বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ঢাকায় গার্মেন্টসে কাজ করে বোন। মায়ের ইচ্ছে ছিলো এ বছর ডিসেম্বরে পুত্র রমজানের বিয়ে দেবেন। ঘরে তুলবেন নতুন বউ। রমজানের বৃদ্ধ দাদির স্বপ্ন ছিলো নাতবউ দেখার। বাড়ির সামনে রমজানের কবর। সারাক্ষণ চেয়ে থাকেন নাতির কবরের দিকে। কতো ছেলে আসে রমজানের কবর দেখতে, কিন্তু প্রিয় নাতিকে তিনি আর দেখতে পারবেন না সেই আফসোসে অনবরত চোখের জল ফেলেন।
রমজানের একমাত্র ছোট ভাই শাহিন। নিজে পড়াশোনা চালিয়ে না গেলেও ছোট ভাই যেন পড়াশোনা করতে পারে রমজানের সে খেয়াল ছিল সবসময়। ছোট ভাইকে ভর্তি করিয়ে দেন নেত্রকোনার একটি কারিগরি কলেজে।
একমাত্র ছোটভাই শাহিনকে ফোন করে আন্দোলনে না গিয়ে বাড়িতে বাবা মায়ের পাশে থাকতে বলেছিলেন তিনি।
কিন্তু ১৯ জুলাই নিজেই নেমে আসলেন রাজপথে। বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে তিনি যোগ দেন ছাত্র জনতার আন্দোলনে। রামপুরায় তখন ছাত্র-জনতার বিপ্লবী শ্লোগানে উত্তপ্ত রাজপথ। রমজান যোগ দিলেন রামপুরার ওয়াপদা রোডের ছাত্র-জনতার মিছিলে। পুলিশ মিছিলে গুলি চালালো। রমজান গুলিবিদ্ধ হলেন। রাজপথে লুটিয়ে পড়েন তিনি। গলার ঠিক নিচ দিয়ে রমজানের ফুসফুস ভেদ করে চলে যায় গুলি। রক্তে রঞ্জিত হয় রাজপথ। ছাত্র-জনতা রক্তাক্ত রমজানকে ধরাধরি করে নিয়ে যায় রামপুরার ওয়াপদা রোডের বেটার লাইফ হসপিটালে। সেখানে শুরুতে তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু যখন সহযোদ্ধারা মোবাইল ফোনে ভিডিও করা শুরু করেন তখন কর্তৃপক্ষের বোধোদয় হয়। সেখানকার চিকিৎসকরা তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছানোর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন রমজান। সেদিনই তাঁর লাশ নিয়ে আসা হয় গ্রামের বাড়ি নন্দীপুরে।
বাড়ির সামনে ফসলের মাঠ। নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় সবুজ ধানক্ষেতের পাশে নারকেল গাছের ছায়ায় দাফন করা হয় শহিদ রমজানকে।
সন্তানকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ শহিদ রমজানের পিতা লিটন মিয়া ও মা মোছাম্মত মনোয়ারা। লিটন মিয়া পেশায় কৃষক। সামান্য জমি যা আছে তাতে কৃষিকাজ করে কোনরকম সংসার চালান তিনি। মা মনোয়ারা গৃহিণী এবং সময় পেলে বেত, বাঁশের তৈরি পণ্য বানান এবং স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে কিছু অর্থ আয় করে সংসারে ব্যয় করেন।
শহিদ রমজানের পরিবার জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী থেকে ২ লাখ টাকা, আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন থেকে ১ লাখ টাকা, উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে ৪৮ হাজার টাকা, জেলা প্রশাসকের অফিস থেকে ১০ হাজার টাকা, বিএনপি নেতা ডাক্তার আনোয়ারের কাছ থেকে ৫ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছে বলে জানান রমজানের পিতা।
রমজান পড়াশোনা করেছেন বাড়ির পাশের নন্দীপুর সোনার বাংলা উচ্চবিদ্যালয়ে। বিদ্যালয়ের সামনে রয়েছে ছোট্ট একটি মোড়। রমজানের বন্ধুরা এবং গ্রামবাসী মিলে সে মোড়ের নাম দিয়েছে ‘শহিদ রমজান মোড়’।
শহিদ রমজান মোড়ে দাঁড়িয়ে রমজানের বাবা তাঁর সন্তান হত্যার বিচার দাবি করেন। এলাকাবাসী শহিদ রমজানের স্মরণে তাঁর বিদ্যালয়ের মাঠটিকে একটি মিনি স্টেডিয়াম করার দাবি জানায়।
গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে নতুন বাংলাদেশ নির্মাণের এক অপার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
শহিদ রমজানের পিতা লিটন মিয়া একজন গর্বিত পিতা। একজন শহিদের পিতা হিসেবে তিনি গর্ববোধ করেন বলে জানিয়েছেন। তাঁর সন্তান দেশের জন্যে প্রাণ দিয়েছেন। তিনি বিশ্বাস করেন তাঁর সন্তানের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। মদনপুরের নন্দিপুর গ্রামে নিজ বাড়ির আঙ্গিনায় সোনালি ধানক্ষেতের পাশে নারিকেল গাছের ছায়ায় শায়িত আছেন শহিদ রমজান।
এ সময়ে শহিদ সন্তানের কবরে হাত বুলিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে রমজানের বাবা নতুন বাংলাদেশ দেখার প্রবল আগ্রহ ব্যক্ত করেন।