শিরোনাম
প্রতিবেদন: বরুন কুমার দাশ
ঢাকা, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : ‘আব্বা, আমি আর বাঁচমু না। তোমাদের মনের আশা পূরণ করতে পারলাম না। আমাকে মাফ করে দিও। আমার ওপর থাইক্কা দাবি ছাইড়া দিয়ো আব্বা। আমি আর বাঁচমু না।’ এ কথাগুলো শহিদ আসিফুরের।
গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্ত্বর এলাকায় শহিদ হন তিনি। আহতাবস্থায় হাসপাতালে নেয়ার পথে রিকশায় বাবা মো. আজমত হোসেনকে এসব কথা বলেছিলেন আসিফুর।
জানা গেছে, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মিরপুর ১০ এলাকায় ছাত্র জনতার আন্দোলনে অংশ নেন আসিফুর রহমান। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সম্মিলিত আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পরে হাসপাতালে নিলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর-১০ এর মেহেদীবাগ এলাকার আব্বাস উদ্দিন রোডের বাসায় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসস’র প্রতিবেদকের সাথে আলাপকালে আন্দোলনে শহিদ আসিফুর রহমানের (১৭) পিতা মো. আজমত হোসেন (৪৮) এসব কথা জানান।
শহিদ আসিফুরের পিতা আজমত হোসেন বলেন, ‘আমার পোলা কোনো রাজনীতি করত না। আমি আগে মানুষের দোকানে কাজ করতাম। ধার করে এক বছর ধরে মিরপুর-১০ এ গোডাউন ভাড়া নিয়ে গার্মেন্টস জুটের ব্যবসা করছি। ১৯ জুলাই বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে আসিফুর তার বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার কথা বলে আন্দোলনে যোগ দেয়। পরে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়।’
মোবাইল ফোনে আসিফুরের দুটি ছবি দেখাতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘ছেলে আমার সঙ্গেই ঢাকায় থাইকা একটা গার্মেন্টসে চাকরি করত। গুলি লাগার পর বাঁচবার লাইগা আমার বাপধন আমার কাছে কতই না আকুতি করছে। কিন্তু আমি তো ওরে বাঁচাইতে পারলাম না। মাথায় গুলি কইরা আমার পুলাডারে মারছে খুনী হাসিনা।’
আজমত হোসেন বলেন, ‘ওইদিন (১৯ জুলাই) জুম্মার নামাজ পইড়া একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাইয়া বাপ-পোলা ঘুমাইতে যাই। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে পুলাডা কইলো একটু বন্ধুর সঙ্গে দেখা কইরা আসি। কিন্তু সন্ধ্যা ছয়টার দিকে ছেলে ফোন কইরা বলে-আব্বু তুমি তাড়াতাড়ি আসো, আমি অ্যাক্সিডেন্ট করছি। খবর পাইয়াই আমি দৌড়াইয়া যখন যাই তখনো ওই এলাকায় গোলাগুলি চলতাছে। কিন্তু গিয়া তো দেখি আমার পুলা মাথার ডান পাশে গুলির চিহ্ন লইয়া মিরপুরের আলোক হাসপাতালে পইড়া আছে।’
হাসপাতালের টিকিট দেখিয়ে আসিফুরের বাবা বলেন, ‘ ছেলেডারে আলোক হাসপাতাল থাইক্কা রিকশায় কইরা শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়া যাই।
সেখানে মাথায় ব্যান্ডেজ কইরা দিয়া আমার বাপধনরে নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে (ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস ও হাসপাতাল) নিতে বলে।
রিকশায় কইরা যখন নিউরোসায়েন্সে নিয়ে যাই তখন বাপে ব্যথায় কাতরাইয়া কইতাছিল-আমার ওপর থাইক্কা সব দাবি ছাইড়া দিয়ো আব্বা। আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করবার পারলাম না। আমি আর বাঁচমু না। পরে নিউরোসায়েন্সে কর্তব্যরত চিকিৎসক আসিফুরকে মৃত ঘোষণা করেন।’
তিনি বলেন, নিউরোসায়েন্স হাসপাতাল থেকে তিন হাজার টাকায় অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে আসিফুরের মরদেহ মিরপুরে নিয়ে আসি। পরে সাড়ে ১২ হাজার টাকায় ট্রাক ভাড়া করে রাত সাড়ে ৩ টার দিকে লাশ নিয়ে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পরেরদিন সকাল সাড়ে ৭টায় গ্রামে পৌঁছাই। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আমার পোলাডা খুব শান্ত স্বভাবের ছিল।’
আসিফুরের গ্রামের বাড়ি শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার রামচন্দ্রকুড়া ইউনিয়নের কেরেঙ্গাপাড়া গ্রামে। দুই ভাই ও চার বোনের মধ্যে আসিফুর ছিলেন দ্বিতীয়। বড় বোনের আরফিনের ঢাকায় বিয়ে হয়েছে। আসিফুর বাবার সঙ্গে মিরপুরে থাকতেন। শিশুপুত্র ও অপর তিন মেয়েকে নিয়ে গ্রামে থাকেন মা ফজিলা খাতুন। আসিফুরের বড় বোন আরফিন আক্তার, বয়স ২২ বছর, মেজ বোন আয়রিন আক্তার, ১৩ বছর, সেজ বোন মারিয়া আক্তার ৯ বছর ও ছোট বোন আরিফি আক্তার ১ বছর এবং আব্দুল্লাহ নামে ২ বছর বয়সি ছোট ভাই রয়েছে তার।
গত ১৯ জুলাই ঢাকার বাড্ডা, প্রগতি সরণি, রামপুরার মতো মিরপুর এলাকাতেও ছাত্র-জনতার সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। পুলিশ আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে। আসিফুর রহমান সেদিন মিরপুরে সন্ধ্যা ৬টার দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাত ৯টা ৪০ মিনিটে মারা যান। পরদিন ঢাকা থেকে তার মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে জানাজা শেষে দুপুরের পর কেরেঙ্গাপাড়া-ফুলপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
শহিদ আসিফুরের মা ফজিলা খাতুন (৪০) মোবাইল ফোনে বাসস প্রতিবেদককে বলেন, ‘বাপধনের শখ ছিল বাইক কিনব। দুর্ঘটনার ভয়ে আমরা কিন্যা দেই নাই। কিন্তু বাপধন তো গুলি খাইয়া মরল। আমার কলিজার টুকরা তো কোনো দল করত না। তাও গুলি কইরা আমার বাপেরে মারছে। যারা আমার বাপেরে মারছে আল্লাহ তাগো বিচার কইরো।’
মা ফজিলা খাতুন আরো বলেন, ‘আমার ছেলে ধীর-স্থির ও শান্ত স্বভাবের ছিল। স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় কুরআনে হাফেজ হওয়ার জন্য পড়াশোনা করত। অভাব-অনটনের সংসার, তাই এক বছর আগে ঢাকার মিরপুরের ১৩ হাজার টাকা বেতনে একটি গার্মেন্টেসে চাকরি নেয়।’
তিনি বলেন, ‘আসিফুরই ছিল আমাদের পরিবারের সম্বল। অকালে তার মৃতুতে আমাদের সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। সরকার যদি এখন আমাদের জন্য কিছু করে তাহলে বাঁচার শক্তি পাবো।’
আসিফের ফুফাতো ভাই আনোয়ার হোসেন জানান, ১৯ জুলাই সন্ধ্যা ৬টার দিকে মিরপুরে ধাওয়া-পালটা ধাওয়া শুরু হলে আসিফ মোবাইল ফোনে ছবি তোলার চেষ্টা করে। ওই সময় তার মাথায় গুলি লাগে।
সন্তান হত্যার বিচারের বিষয়ে বাবা আজমত হোসেন বলেন, আমার ছেলেকে যারা হত্যা করেছে, আমি তদন্ত করে দোষীদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই। ভবিষ্যতে আর যেন কোন মায়ের বুক খালি না হয়।
সহযোগিতার বিষয়ে তিনি বলেন, জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে আমরা পাঁচ লাখ টাকার চেক পেয়েছি। এছাড়াও জামায়াতে ইসলামী ২ লাখ টাকা দিয়েছে।
এ ঘটনায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ২০১ জনের নামে হত্যা মামলা দায়ের করেন বাবা আজমত হোসেন।