বাসস
  ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:৫৭
আপডেট : ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৬:১৩

‘হাসিনা না পালাইলে আমাদের পালাইতে হইতো’- শহিদ সজলের পিতা

শহিদ মো. সজল মোল্লা -ছবি : বাসস

 প্রতিবেদন: মোঃ মঞ্জুর মোর্শেদ

মুন্সীগঞ্জ, ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ( বাসস) : গত বছরের জুলাই-আগস্টে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ ছিল উত্তাল। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের ঢেউ লাগে মুন্সীগঞ্জেও। 

গত ৪ আগস্ট ছাত্র-জনতা সকাল থেকে শহরের সুপার মার্কেট এলাকায় অবস্থান নেয় এবং বিক্ষোভ অব্যাহত রাখে। এ সময়ে ছাত্র-জনতার সাথে আওয়ামী লীগ আর পুলিশের  চলে ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া। আন্দোলন দমাতে পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ আর ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ছাত্র জনতার ওপর নির্বিচারে হামলা  চালায়।  শুরু হয় সুপার মার্কেট এলাকায় ত্রি পক্ষের ব্যাপক সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে ছাত্র জনতা  পিটিআই রাস্তায় ঢুকে পড়লে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের গুলিতে  শহিদ হয় সদর উপজেলার উত্তর ইসলামপুরের আলী আকবর মোল্লার ছেলে মো. সজল মোল্লা।

শহিদ মো. সজল মোল্লা (৩০) এলাকায় রংয়ের কাজ করতেন। অল্প কিছুদিন আগে প্রিমিয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে চাকুরি নেন। গত ৪ আগস্ট তার ছুটি ছিল। সেদিন তিনি আন্দোলনে যোগ দেন এবং শহিদ হন।

তিন ভাইয়ের মধ্যে সজল ছিলেন মেজো। বড় ভাই সেলিম মাহমুদ নারায়ণগঞ্জে  মিশুক চালায়। ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম মুক্তারপুর এলাকায় প্রিমিয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে চাকুরি করে। বাবা আলী আকবর মোল্লা পাঁচ মাস আগে স্ত্রী শাহীদা বেগমকে  হারিয়েছেন। সে শোক কাটতে না কাটতেই আদরের ছেলেকে অসময়ে হারিয়ে এখন নির্বাক। 

শহিদ মো. সজল মোল্লার ছোট ভাই সাইফুল ইসলাম (২৭)। বাসস’কে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে নয়াগাও এলাকায়  আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ছাত্র জনতার ওপর হামলা করে। তারা ব্যাপক গুলিবর্ষণ এবং ককটেল মারে। গত ৪ আগস্ট সকাল থেকে ছাত্র জনতা শহরের সুপার মার্কেট এবং কৃষি ব্যাংক চত্বরে অবস্থান নেয়। 

পুলিশ,আওয়ামী লীগ, যুবলীগ আর ছাত্রলীগের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা ছাত্র জনতার ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। সেদিন সকাল সাড়ে ৯ টায় দু’ভাই মিলে ভাত খাচ্ছিলাম। কিন্তু  সজল কোন ভাবেই খেতে পারছিল না। বাড়ির পাশেই প্রধান সড়কে চলছিল ছাত্র-জনতার  বিক্ষোভ। কয়েক মিনিট পরপর বিকট শব্দ ও গুলির আওয়াজ শুনতে পাই। সজল অর্ধেক খেয়ে উঠে যায় আর বলে এবার স্বৈরাচার হাসিনাকে খেদাবো না হয় শহিদ হবো। এই বলে খাবার রেখে দ্রুত উঠে চলে যায়। আমিও তার সাথে যাই। 

সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ধাওয়া দিলে তারা পিছু হটে। পরে পুলিশের সহায়তায় আমাদের ওপর আক্রমণ চালায়। আমরা পিটিআই রাস্তায় চলে আসি। ওরা আমাদের ওপর গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। এ সময় ভাই সজলের পেটে গুলি লাগে। শার্ট খুলতে দেখি সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে গেছে। সজল রাস্তায় ঢলে পড়ে। তাকে পরে পেট গামছা দিয়ে বেঁধে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করি। সুপার মার্কেট চত্বরে পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা থাকায় সহজে নিতে পারছিলাম না। অন্য রাস্তায় সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই। সেখানেও ভালো চিকিৎসা পাইনি। ডাক্তার ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়। এম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নেওয়ার সময় মুক্তারপুরে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা  আবার হামলা করে। ঢাকায় নেওয়ার পথে সিরাজদিখান উপজেলার ইছাপুরায়  গেলে গাড়িতেই সজলের মৃত্যু হয়। 

এ সময়ে সাইফুল ডুকরে কেঁদে ওঠেন আর বলেন, দু’ভাই এক সাথে আন্দোলনে গেলাম। কিন্তু বড় ভাইকে জীবিত সাথে নিয়ে ফিরতে পারলাম না। চোখের সামনে বড় ভাইকে হারালাম। দেশ আজ স্বৈরাচার হাসিনা মুক্ত হলো। কিন্তু ভাই স্বৈরাচার মুক্ত দেশ দেখে যেতে পারলো না। 

পিতা আলী আকবর (৬৫) সজলের কথা বলতেই অঝোরে কাঁদতে শুরু করেন। কোন কথা বলতে পারছিলেন না। কাঁদতে কাঁদতে বাসসকে বলেন, ইছাপুরা হাসপাতাল থেকে বিকালে লাশ বাড়িতে আনা হয়। ঐ দিনই ইসলামপুর এলাকার তিন জন গুলিতে শহিদ হয়। সন্ধ্যায় পুলিশ এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা ইসলামপুর এলাকায় ঢুকে বাড়ি বাড়ি হুমকি দেয়। ভয়ে সকলে গ্রাম ছেড়ে চলে যায়। কোন পুরুষ মানুষ ছিল না। লাশ বাড়িতে উঠানে পড়ে ছিল। জানাজাও দিতে পারছিলাম না। ভয় ও আতংকের মধ্যে সময় পার করেছি। পরে কয়েকজনে মিলে কোন রকমে সজলকে দাফন করি। হাসিনা না পালাইলে আমাদের পালাইতে হইতো। আমি আল্লাহর কাছে  আমার সন্তান  হত্যার বিচার চাই।  

সজলের মামাত ভাই আশরাফুল বাসসকে বলেন, সজল ভাইকে জানাজা দেবার এবং দাফন করার মতো অবস্থা ছিল না। সবাই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে গেছে। আমরা ছয়জনে রাতে এলাকার সামাজিক গোরস্তানে  তাকে দাফন করি। 

শহিদ সজলের পিতা আলী আকবর জানান, জামায়াতে ইসলাম থেকে আড়াই লক্ষ টাকা, বিএনপি থেকে ৫০ হাজার টাকা এবং জেলা প্রশাসন থেকে ৬৫ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছি।

সাইফুল বড় ভাই সজলসহ সকল শহিদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেয়ার দাবি জানান।