বাসস
  ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৮:৪৩
আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৯:০০

‘আমার আলভী যে ‘মৃত’ তা ভাবি নাই’ : শহীদ আলভীর মা

শহীদ মো. শাহরিয়ার হাসান আলভী -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : সেলিনা শিউলী

ঢাকা, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : জুলাই ২০২৪-এর গণ-আন্দোলনের প্রবল উত্তেজনা আর দেশপ্রেমের আবহ চারিদিকে মুক্তিকামী মানুষের জোয়ার তুলেছিল। এই প্রেক্ষাপটে অল্পবয়সী আলভীও তার নিজস্ব স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে যোগ দিয়েছিল আন্দোলনে। ছোটবেলার স্বপ্ন আর দেশপ্রেমের আহ্বানে মুক্তিকামী মানুষের গণ-আন্দোলনে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিল আলভী।

আলভীর জীবন ও স্বপ্ন
‘আলভীর বাম পাঁজরের পাশ দিয়ে গুলি লেগে ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। গুলি খাওয়ার পরে নাড়িভুড়ি সব বের হয়ে যায়। দু’টি গুলি ছিল ওর শরীরে। একটা ওর শরীরে গেঁথে ছিল। আমি বারবার আলভীর মুখে চুমু দিয়ে জানতে চাইছি, বল কোথায় তোর কষ্ট হচ্ছে, কোথায় ব্যাথা পেয়েছিস বল আমারে। কিন্তু ও যে মৃত সেটা বুঝতে পারি নাই। আমার মাথার ভেতরে ঘুণাক্ষরেও এই চিন্তা আসে নাই। মনে আসে নাই, আমার আলভী আর বেঁচে নেই।’

কথাগুলো বলছিলেন বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া মীরপুরের বাসিন্দা মো. শাহরিয়ার হাসান আলভীর মা সালমা বেগম (৩৬)। আলভীর বয়স ছিল মাত্র ১৫ বছর। স্বপ্ন ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার, কিন্তু সেই স্বপ্ন ফুল হয়ে ফোটার আগেই বৃন্তচ্যুত হয়ে ঝরে গেলো।

পরিবারে প্রতিক্রিয়া ও অভিজ্ঞতা
আলভীর মা বলেন, ‘কত সাবধানে আর যত্ন করে ওকে মানুষ করছি। বিপথে চলে যেতে পারে ভেবে ওকে মোবাইল কিনে দেই নাই। শুধু কয়েকজন বন্ধুর মোবাইল নম্বর ছিল, বিপদ-আপদের জন্য।’ ‘আলভীর কী অপরাধ ছিল?’- এমন প্রশ্ন করে তিনি বলেন, আলভী নবম শ্রেণিতে পড়ত। দিশা পলিটেকনিক্যালে। বিশেষ কোনো বন্ধু-বান্ধব ছিল না ওর।

তিনি জানান, ‘আমি কখনও ভাবি নাই যে সে আন্দোলনে যায়। কারণ বাসা থেকে বের হয়ে নির্দিষ্ট একটা স্থানে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে সে আড্ডা দিত। কখনও কোনোদিন আমার অবাধ্য হয় নাই। বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময় আমি লুকিয়ে দেখে আসতাম; সবসময় চোখে চোখে রাখতাম।’

তিনি আরও জানান, ‘এই ঘটনার পরে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা-কর্মী বাসায় এসে শাসিয়ে যায়। তারা বলে, ‘আমার ছেলে সন্ত্রাসী।’

‘তাদের কথায় মনে হয়, আমাদের আলভী আন্দোলনে গিয়ে মারা গেছে বলে আমরা অপরাধী। আমাদেরকে বাসা থেকে বের করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। ভয়ে আর আতঙ্কে ছিলাম।’

ঘটনার দিন: বাবার বিবরণ
আলভীর বাবা মো. আবুল হাসান (৪০) বলেন, ‘সেদিন ছিল ৪ আগস্ট, রোববার। বন্ধুদের সঙ্গে আন্দোলনে পথে নেমেছিল আলভী। মিছিল ও প্রতিবাদ করতে করতে মিরপুর ১০ নম্বরে যায়। সেখানে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়।’

ছোটবেলা থেকে খুব সাহসী ছিল আলভী, বন্ধুদের সঙ্গে দিনবদলের অঙ্গীকারে পথে নেমেছিল। ভেবেছিল বৈষম্যহীন নতুন দেশ গড়ে জীবনের নতুন জয়গান গাইবে। সাহসের সঙ্গে বিনা বাধায় চলবে নিজের তৈরি করা পথে। কিন্তু হলো না। ইতিহাস গড়তে গিয়ে নিজেই হয়ে গেলো ইতিহাস।

তাকে হারিয়ে তার পরিবার এখনো বাকরুদ্ধ। হৃদয়ে সৃষ্ট ক্ষতে অহর্নিশ পুড়ছে। আলভীর বাবা-মা এখনও শোকবিহ্বল। প্রতিদিন প্রতি রাতেই তারা ভাবতে থাকেন, ‘কী হলো? কেনো হলো?’

একটি হাসপাতালের চাকুরিজীবী আলভীর বাবা বলেন, ‘ঘটনার দিন আলভীর সঙ্গে আমার দেখা হয় নাই। আমি সকাল ৯টায় কর্মস্থলে যাই। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ফিরে আসি। বাসায় এসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, আলভী বাসায় নাই। এ নিয়ে ওর মাকে বকাঝকা করি। সেদিন দেশের অবস্থা দেখে আমি ভয় পাচ্ছিলাম একমাত্র ছেলেকে নিয়ে।

এরপর বিকাল ৬টার দিকে আলভীর নাম ধরে কেউ চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘ও, আলভীর আম্মু আন্টি, আলভীকে নিয়ে আসছি।’

আমি চিৎকার-চেঁচামেচি শুনে দ্রুত চারতলা থেকে নামি, পেছনে পেছনে ওর মা। গিয়ে দেখি একটা অটোরিকশায় দুই বন্ধুর কোলের ওপর আলভীর নিথর দেহ।’ বলতে বলতে একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে আবার বলেন, 'আলভীর বন্ধুরা তার গুলিবিদ্ধ শরীরটা নামিয়ে ধরাধরি করে বাসার প্যাসেজে রাখার চেষ্টা করছিল। আমি তাকে পাশের ঘরে শুইয়ে দেই, শরীরে একটা চাদর জড়িয়ে দেই।’

‘বুঝতে পারছিলাম, আমার ছেলে আর বেঁচে নাই। আমার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছিল, কিন্তু কিছু বলতে পারছিলাম না।’ তিনি বলেন, ‘তখন বাসার সামনে হাজার হাজার মানুষ। কী এক ভয়ানক অবস্থা বলে বোঝানো যাবে না। ওই সময় আমার স্ত্রী এই পরিস্থিতি দেখে নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। আমি কী করব, কাকে কী বলব বুঝতে পারছিলাম না।’

একসময় আমার প্রতিবেশী মুন্না এগিয়ে এলো। সে কিছু ছেলেকে মসজিদ থেকে খাটিয়া আনতে পাঠায়। কিন্তু বাসার পাশের মসজিদ থেকে খাটিয়া দেয়া হয় না। বলছে এই ছেলে সন্ত্রাসী। আমি ডি-ব্লক থেকে খাটিয়া আনতে বললে সেখান থেকে আনা হলো। আমি ওই অবস্থায় মসজিদে চলে যাই। ভয়ে আমরা তাড়াহুড়া করে রাত ১০টার দিকে কালশী গোরস্তানে দাফন করি। লাশের মুখও অনেকে দেখতে পারে নাই।’

আইনি পদক্ষেপ
আলভী পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তার শেষ গোসলের সময় শরীরের ভেতরে একটা গুলি পাওয়া গেছে, অন্যটা বেরিয়ে গেছে।’ তিনি বলেন, ‘আলভী চলে যাওয়ার ২-৩ দিন পরে আজমল হাসপাতালে গিয়েছিলাম। ছেলের কথা বলতেই তারা আমার সঙ্গে চিৎকার-চেঁচামেচি করেন। এ সময় আলভীর ওই হাসপাতালে চিকিৎসার কথা অস্বীকার করেন। পরে ওর বন্ধুদের সাহায্যে দু-একটা ভিডিও ফুটেজ দেখাই এবং এন্ট্রি খাতা চেক করতে বলি, তখন তারা স্বীকার করে এবং ডেথ সার্টিফিকেট দেয়।’

তিনি বলেন, ‘আমি ১৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মামলা করেছি শেখ হাসিনা ও ২৫ জনসহ মোট ৫০০ জন অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে। ২৪ আগস্ট রাত ১০টার দিকে হঠাৎ আমার বাসায় ইট-পাটকেল পড়তে থাকে। এ সময় আমাদেরকে বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করা হয়। আমরা সবাই ভয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলাম। আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম তারা কারা। কিন্তু প্রাণের ভয়ে লুকিয়ে থাকার কারণে চিনতে পারিনিওদের। ভয়ে আমি সেসময় পল্লবী থানার ওসিকে ফোন দিয়েছিলাম।’

‘তিনি জনবল নাই, অজুহাতে সাহায্য করার জন্য কোনো পুলিশ পাঠাননি। পরের দিন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গেলে ওসি মামলা করতে বলেন এবং বাসায় পুলিশ পাঠান। এর পরে আর কোনো ঝামেলা হয়নি। আমি মনে করি, আমার ছেলেকে পুলিশ গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। আমি এর বিচার চাই।’

শহীদ মো. শাহরিয়ার হাসান আলভী -ছবি : বাসস

পরিবারে শোক ও বিদায়
আলভীর মা বলেন, ‘মারা যাবার পর শুনেছিলাম ১০ নম্বর গোল চত্বরের কাছে ওকে দেখে আমার বোনের ছেলে রাজু। ‘স তখন বলে, ‘তুমি এখানে কি কেন আসছো?’ তখন সে জবাব দেয়, ‘বন্ধুদের সঙ্গে গেছে।’ 

রাজু তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বক্তৃতা দিচ্ছিল। আলভীকে দেখে পানি নিয়ে আসতে বলে। রাজুকে পানি এনে দিয়ে ওখান থেকে সরে যায় আলভী। এর কিছুক্ষণ পরেই গুলিবিদ্ধ হয় সে।

যখন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়, তখন আমি একদিন ওকে ডেকে বললাম, ‘বাবা, তুমি কোনো আন্দোলনে যাও না-কি?’ সে বললো না, ‘আমি যাই না।’ ওর কথায় বিশ্বাস করেছিলাম, তাই কোনো সন্দেহ হয় নাই। ও যখন ক্লাসে যেতো, তখন আমি বা ওর বাবা আনা-নেওয়া করতাম।’

সামাজিক ও মানসিক প্রভাব
হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠে আলভীর মা বললেন, ‘আমার বাবাটারে আমি কোথায় পাবো?’ কিছুক্ষণ স্তব্ধ সবাই। তারপর বলতে শুরু করলেন,  ‘আমি আমার ছেলের সঙ্গে ঘুমাতাম।’ ওর বাবা বলতো, ‘ছেলে বড় হয়েছে, কেনো তুমি ওর সঙ্গে ঘুমাও?’ বলেছি, ‘আমার ছেলের চেয়ে বড় কেউ আমার কাছে নাই; ও তুমি বুঝবা না। ৩ আগস্ট রাতে শোবার আগে আমায় বললো, ‘আম্মু, সকালে ডেকে দিও।’ আমি ওকে ডাকি নাই।

সাড়ে ১১টার দিকে কিন্তু সে নিজে উঠল। একটু পর ফ্রেশ হতে গেলে আমি শুকনা কাপড় আনতে ছাদে যাই। এর মধ্যে ছোট মেয়ে ছাদে গিয়ে বলল, ‘বিশ টাকা দিতে, সে (আলভী) একটু বাইরে যাবে।’ আমি ছোট মেয়েকে ডেকে বললাম, ‘১০০ টাকার নোট আছে। ভাইয়াকে নিয়ে যেতে বল।’ 

‘বাইরে থেকে এসে নাশতা  করবে বলে ওর জন্য পরোটা আর ডিমভাজি নাস্তা তৈরি করে রাখলাম। অন্যদিন আমি খুঁজতে যাই।  সেদিন আর যাই নাই। ভাবলাম, টাকা আছে ওর কাছে, কিছু হয়তো খেয়ে নিয়েছে;  তাই নাশতা খেতে আসে নাই। বন্ধুদের সঙ্গে হয়তো আড্ডা দিচ্ছে। তাই নিশ্চিন্তে ছিলাম।’

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
আলভীর নানী বেগম রোকেয়া (৮৩) বলেন, ‘ঘটনার দিন বেলা তিনটা নাগাদ আলভী নিজের বাসায় না গিয়ে একই ভবনের নিচতলায় আমার কাছে আসে। আমার তখন মন খারাপ। হয়তো চোখে পানি ছিল। তা দেখে বললো, ‘নানী, তুমি কাঁদছো কেন?’ বললাম, ‘শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, হয়তো বেশিদিন বাঁচব না।’ ও বলল, ‘কেনো মন খারাপ করে কাঁদছ? তুমি মরে গেলে আমি কার কাছে থাকব?’

আমার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল, ‘লেখাপড়া শেষ করে আমি চাকরি নিলে তোমায় ভালো ডাক্তার দেখাব। তুমি চিন্তা করো না। মন খারাপ করো না।’ আমি দেখি ওর বড় বড় চোখ থেকে পানি ঝরছে। তনি বলেন, ‘আলভী দুপুরের খাবার খায় নাই। খাবার দিতে চাইলে বলল, পরে এসে খাবে। এরপর আমার মোবাইল থেকে এক বন্ধুকে ফোন দিলে জানল, ওরা আমাদের বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে আছে। বললাম, ‘তুমি এখন যেও না, ভাত খেয়ে বের হও।’

সে জবাব দিলো, ‘নানী, বেশি দূর যাবো না।’ চিন্তা কইরো না, আমি কোনো গ্যাঞ্জামের মধ্যে নাই। বললাম, ‘একটু পর তোমাকে সিপারা পড়াতে হুজুর আসবে। ‘চলে আসবো’ বলে বের হয়ে গেল।’

আলভীর মা বলেন, ‘আমি এখন আফসোস করি, ও মায়ের এখানে ছিল। আমার সঙ্গে দেখা হয় নাই। সেদিন বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে ওর বাবা বাসায় এসে ছেলে-মেয়েকে খুঁজতে লাগল। যখন শুনলো আলভী বাসায় নাই, তখন আমার সঙ্গে রাগারাগি করে। এক পর্যায়ে বলল, ‘চারদিকে গন্ডগোল হাইতেছে, ছেলে কই গেলো, কী করে এসব কোনো খোঁজ রাখ না, কেমন মা তুমি?’'

তিনি বলেন, ‘আমি মনে মনে বলি, ছেলে-মেয়ে বড় হলে সবসময় কথা শোনে না। কিন্তু কোনো জবাব দেই না আলভীর বাবাকে। কিন্তু মনটা খারাপ হয়ে যায়। বিছানায় চুপচাপ শুয়ে থাকি। হয়তো সামান্য চোখ লেগে আসছিল, কি যেন একটা স্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে উঠে বসি।’

এরপর আলভীর বাবা চা বানিয়ে দিতে বললে সবার জন্য চা বানিয়ে মুড়ি দিয়ে সেলাই মেশিন নিয়ে বসি। আলভীর বাবা মোবাইলে দেশের খবর দেখছিল শুনল, মিরপুর ১০ নম্বরে গোলাগুলি হইছে।

ছয়টায় ও মাগরিবের নামাজের ওজু করতে যায়। আমিও ওজু করার জন্য রেডি হচ্ছি। তখন শুনি কেউ একজন চিৎকার করে বলছে...এরপর তো সব শেষ!