একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে দিশেহারা শহীদ বিপ্লবের পরিবার

বাসস
প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৪
শহীদ বিপ্লব -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : মহিউদ্দিন সুমন

টাঙ্গাইল, ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : স্বপ্ন ছিল চাকুরি করে পরিবারের স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনবে, বাবা কে আর দিন মুজরির কাজ করতে দেবে না।

অভাব-অনটনের সংসারে নিজে লেখা-পড়া করতে পারেনি। তাই ছোট ভাই কে লেখা-পড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করবে। মা’কে এ কথা গুলো ফোনে প্রায়ই বলতো বিপ্লব। কিন্তু বিপ্লব সে স্বপ্নগুলো আর পূরণ করতে পারল না। বড় অসময়েই না ফেরার দেশে চলে যেতে হলো তাকে। 

২০২৪-এর ৫ আগস্ট ছাত্র আন্দোলনের চূড়ান্ত দিনে গণঅভ্যুত্থানে বিজয় মিছিলে অংশ নিতে গিয়ে আর বাড়ি ফেরা হয়নি বিপ্লবের। আনন্দ মিছিলে বিজিবি’র ছোঁড়া গুলিতে মারা যায় বিপ্লব (১৬)। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে যেন পুরো পরিবারেই অন্ধকার নেমে এসেছে। বিপ্লবের স্মৃতিকে ধরে রাখতে তার বাড়ির সামনে দিয়ে যাওয়া কদমতলী রাস্তাটির নামকরণ করা হয়েছে শহীদ বিপ্লব সড়ক। ধনবাড়ি 

পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট সকাল থেকেই গাজীপুর মাওনা চৌরাস্তা ছিল ছাত্র-জনতার দখলে। হাজারো জনতা পল্লী বিদ্যুৎ মোড় এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অররোধ করে রাখে। দুপুরে দিকে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পালানোর খবরে আনন্দ মিছিল বের হয়। কারখানা বন্ধ থাকায় সহ-কর্মীদের সঙ্গে সকাল থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের রাস্তা অররোধে যোগ দেয় বিপ্লবও। 

বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে বিজয় মিছিল পল্লী বিদ্যুৎ মোড় এলাকা অতিক্রম করার সময় আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের লোকজনের উসকানিতে সেখানে বিজিবি’র সদস্যরা নির্বিচারে এলোপাতাড়ি গুলি চালাতে থাকে। এ সময় একটি গুলি বিপ্লবের চোখের সামনের অংশে ঢুকে মাথার খুলি ভেদ করে চলে যায়।

সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বিপ্লব। তখন বন্ধুরা বিপ্লবকে সেখান থেকে উদ্ধার করে গুরুতর আহত অবস্থায় মাওনা আল-হেরা মেডিকেল সেন্টারে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। পরের দিন ৬ আগস্ট সকালে জানাজার নামাজ শেষে নিজবাড়ি কদমতলীতে দাফন করা হয় বিপ্লকে। 

সম্প্রতি সরেজমিনে টাঙ্গাইলের ধনবাড়ি উপজেলার বীরতারা ইউনিয়নের কদমতলী পশ্চিম পাড়া গ্রামে কোটা আন্দোলনে নিহত বিপ্লবের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বাড়িটিতে সুনসান নীরবতা। বাড়ির সামনে দাফন করা হয়েছে বিপ্লবের লাশ। কিছু লোক বিপ্লবের পরিবারের সাথে দেখা করতে তার কবরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। বিপ্লরের বাবা-মা একটি কাঁচা টিনের ঘরে পাঁচ বছরের ছোট ছেলেকে নিয়ে বসবাস করেন। আব্দুল খালেক ও বিলকিস বেগম দম্পতি দুই ছেলের মধ্যে বিপ্লব ছিল সবার বড়। বড় ছেলে কে হারিয়ে শোকে পাথর হয়ে গেছেন বিপ্লবের মা-বাবা। শোকে কাতর হওয়ায় তারা খুব বেশি কথা বলতে চাচ্ছিলেন না। এর মধ্যে কথা হয় বিপ্লবের মা-বাবা সাথে।

 

পুত্রের শোকে পাথর বনে যাওয়া বিপ্লবের মা বিলকিস বেগম বাসস’কে জানান, ঘটনার দিন ৫ আগস্ট সকালে ছেলে বিপ্লবের সাথে ফোনে কথা হয় তার।

তখন সে জানায়, মা, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে যাচ্ছি। আমার জন্য দোয়া করো। তখন আমি বলেছিলাম, তোর এসব আন্দোলনে যাওয়ার দরকার নেই। আমরা গরীব মানুষ। আমাদের এসবের কী দরকার। কিন্তু বিপ্লব তখন আমাকে সান্তনা দেয়। 

বিলকিস বেগম বলেন, ‘তখন আমি বলি কেনো এসব ঝামেলার কাজে যাচ্ছিস? ঠিক আছে যা, তবে বাবা তুই খুব সাবধানে থাকিস। বেশি গুলাগুলি বা ঝামেলা দেখলে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরিস।’

এটাই ছিল বিপ্লবের সাথে মায়ের মুঠো ফোনে শেষ কথা। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে হঠাৎ বিপ্লবের ব্যবহৃত মোবাইল থেকে মায়ের ফোনে জানানো হয় আন্দোলনে সংঘর্ষে গুলি লেগে তার ছেলে হাসপাতালে মারা গেছে। সেদিন যানবহন বন্ধ থাকার কারণে আমরা বিপ্লবের লাশও আনতে যেতে পারেনি তার পরিবার। ওইদিন বিপ্লবের বন্ধুরা রাত দুইটার দিকে অ্যাম্বুলেন্সযোগে বিপ্লবের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে নিয়ে আসে। পরের দিন ৬ আগস্ট সকাল দশটায় জানাজার নামাজ শেষে নিজ বাড়িতে দাফন করা হয় বিপ্লবকে।

বিপ্লবের মা বিলকিস বেগম এই প্রতিবেদককে জানান, বিপ্লব ধনবাড়ি কদমতলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত লেখা-পড়া করেছে। ছেলের পড়া-লেখার খরচও আমরা ঠিকমত দিতে পারতো না আমরা। বিপ্লবের বাবা দিনমজুরের কাজ করে কোনোভাবে সংসারের সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে পারছিল না।

বাবার কষ্ট বিপ্লবকে সব সময় পীড়া দিত। তাই অভাব অনটনের সংসারের দূরঅবস্থা দেখে লেখা-পড়া বাদ দিয়ে এক বছর আগে জীবিকার তাগিদে চলে যায় গাজীপুর জেলার শ্রীপুরের মুলাইদ এলাকায়। সেখানে আল-মদিনা ব্যাটারি হাউজ নামে একটি প্রতিষ্ঠানে স্বল্প বেতনের কাজ নেয়।

বিলকিস বেগম বলেন, ‘নিজের খরচ মিটিয়ে বাড়িতে পরিবারের জন্য প্রতি মাসে কিছু টাকা পাঠাতেন। তা দিয়ে আমাদের সংসার ভালোভাবে কেটে যাচ্ছিল।

কিন্তু ৫ আগস্ট বিপ্লবকে হারিয়ে সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেল। ও আমাদের অভাবের সংসারের হাল ধরেছিল। কিভাবে চলবে আমাদের সংসার। এখন কে যোগাবে সংসারের খরচ? কে থাকবে আমাদের পাশে?’

তিনি আরও জানান, আমি ছেলের হত্যার বিচার চাই। বিপ্লব দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। যারা আমার ছেলেকে গুলি করেছে তাদের যেন কঠিন শাস্তি হয়।

ছেলের আত্মত্যাগের স্বীকৃতি যেন দেওয়া হয়। সরকার যেন বিপ্লবকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দেন এবং তার পরিবারের পাশে থাকেন। 

শহীদ বিপ্লবের বাবা আব্দুল খালেক বাসস কে জানান, সংসারের হাল ধরা বিপ্লককে হারিয়ে আমরা আজ দিশেহারা। বিপ্লব ছিল পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। আমার ছেলে সব সময় ফোন করে খোঁজ নিত আমাদের। ওর মা শোকে কাতর হয়ে গেছে। আমার ছেলেকে গুলি করে হত্যার বিচার চাই।

সবাই আমার ছেলে বিপ্লবের জন্য দোয়া করবেন আল্লাহ যেন ওকে শহীদি মর্যাদা দান করেন। 

তিনি আরও জানান, বিপ্লবের মৃত্যুর পর স্থানীয় প্রশাসন ও রাজনৈতিক দল আমাদের পরিবারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ফকির মাহবুব আনাম স্বপন (স্বপন ফকির) ৫০ হাজার টাকা এবং স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছেন তারা।

তিনি আরও জানান, সরকারি এবং মানুষের সাহায্য ছাড়া চলা একেবারেই অসম্ভব। তাই আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি আমাদেরকে সহযোগিতার আওতায় এনে যেন চলার মত ব্যবস্থা করে দেয়।  

বিপ্লবের প্রতিবেশী ইকবাল হোসেন এ প্রতিবেদক কে জানান, বিপ্লব আমাদের মহল্লার সন্তান। ছোট বেলা থেকে দেখেছি অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবসময়ই সোচ্ছার ছিল। বিপ্লব ছিলেন অদম্য ও সাহসী। তাকে কারও সাথে ঝগড়া বিবাদ করতে দেখিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিজয় মিছিলে গিয়ে গুলিতে শহীদ হয় বিপ্লব। তার হত্যা কান্ডের পর তার পরিবার মামলা করার চেষ্টা করেছে কিন্তু আর মামলা করতে পারেনি। এই পরিবারটি খুবই নিরীহ ও দরিদ্র। বিপ্লবের বাবা দিনজুরের কাজ করে সংসার চালান। এখন খুব একটা কাজ করতে পারেন না। দেশের জন্য বিপ্লবের এই আত্মত্যাগে সরকার এই পরিবারের পাশে থাকবে এটাই আমাদের একমাত্র প্রত্যাশা। 

ধনবাড়ি উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. আবু সাঈদ বাসসকে জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ধনবাড়ি উপজেলার ২ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হয়েছে। আমরা প্রত্যেককে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২৫ হাজার টাকা করে অনুদান দিয়েছি। নিহত বিপ্লব ধনবাড়ির অকুতোভয় বীর সন্তান। সে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। তার এই আত্মত্যাগ কখনো ভোলবার নয়। আমি তার পরিববারে প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। এ ছাড়া সরকারিাবে ঘোষণা আছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহতের পরিবারকে পাঁচ লাখ টাকা দেওয়া হবে। সেটা অনুমোদন হলো আমরা বিপ্লবের পরিবারকে বিতরণ করব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তারেক রহমানের বৈঠক অনেকের মনে জ্বালা ধরিয়েছে : রিজভী
জাতীয় পতাকা পরিবর্তনের দাবি, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন : প্রেস উইং
মিরসরাইয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১, আহত একই পরিবারের ৪ জন
নড়াইলে শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আলোচনা সভা
একাত্তর ও জুলাই অভ্যুত্থানের হত্যাকারীদের বিচার দৃশ্যমান করতে হবে : ওয়ার্কার্স পার্টি
বিএনপির রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফা প্রচারে লিফলেট বিতরণ দক্ষিণখানে
৯৭২২ দিনের অপেক্ষার অবসান দক্ষিণ আফ্রিকার
সাহিত্যিক আব্দুল মোমেনের মৃত্যুতে জামায়াতের শোক
আগামীকাল উদীচীর বর্ষা উৎসব
সোমবার সকাল থেকে ভারী বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা
১০