বাসস
  ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ০৯:৫৭
আপডেট : ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৫:০৪

শিশু সন্তান সিয়ামকে নিয়ে অনিশ্চয়তায় শহীদ মানিকের স্ত্রী

শহীদ মানিক মিয়া -ছবি :বাসস

প্রতিবেদন : মামুন ইসলাম

রংপুর, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী অটোরিকশাচালক শহীদ মানিক মিয়া নিহত হওয়ার পর তার ২৩ বছর বয়সী স্ত্রী মুন্নি আক্তার এখন একমাত্র সন্তান মো. মিনহাজুল ইসলাম সিয়াম (২) কে নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন।

শহীদ মানিকের জীবন ও সংগ্রাম

গত বছর ১৮ জুলাই রংপুর মডেল কলেজ গেট এলাকায় শত শত ছাত্র ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নিয়ে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন মানিক মিয়া।

স্বামী শহীদ হওয়ার পর মুন্নির জীবন দ্রুত পাল্টে যায়। তিনি জানেন না, কীভাবে ছেলেকে বড় করবেন, কোথায় থাকবেন, কী করবেন।

পরিবারের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ

অনিশ্চয়তা, দুশ্চিন্তা ও কঠিন বাস্তবতার মুখে পড়ে মুন্নি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে বাবার সঙ্গে বসবাস শুরু করেন।

বর্তমানে তিনি তার বাবার সঙ্গে রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ ইউনিয়নের সদরপুর গ্রামে বসবাস করছেন।

শহীদ মানিক মিয়া ছিলেন রংপুর নগরীর ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের পূর্ব ঘাঘটপাড়া এলাকার বাসিন্দা। তার বাবা প্রয়াত সেকেন্দার আলী প্রায় ১২ বছর আগে মারা যান। তার মা মোস্ত নূরজাহান বেগম (৫৫) একজন গৃহিণী।

বাবার মৃত্যুর পর তিনি পূর্ব ঘাঘটপাড়ায় ৩০ শতাংশ জমি এবং ছয় শতাংশের ওপর নির্মিত টিনশেড বাড়ির মালিক হন।

দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে মানিক ছিলেন দ্বিতীয়। তার বড় বোন কুলসুম (৪০) এবং ছোট বোন শিউলি (৩০) বিবাহিত। তারা তাদের স্বামীদের সঙ্গে বসবাস করছেন।

মানিকের ছোট ভাই রতন (২৫)ও বিবাহিত। তিনি অটোরিকশা চালিয়ে তার পরিবার ও মাকে দেখাশোনা করেন।

মানিকের জীবনসংগ্রাম

পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপে  জানা যায়, মানিক অত্যন্ত ভদ্র ও বিনয়ী ছিলেন। তিনি ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। সবাইকে সাহায্য করতেন তিনি।

অতি দারিদ্রের কারণে তিনি পঞ্চম শ্রেণির বেশি পড়াশোনা করতে পারেননি।

এরপর তিনি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালানো শুরু করেন এবং পরিবারকে সাহায্য করতে নগরীর দর্শনা শুটকি মোড়ে অন্যের জমিতে ছোট্ট একটি চায়ের দোকান খোলেন।

বিয়ে ও নতুন জীবন

২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পারিবারিক সিদ্ধান্তে মানিক বিয়ে করেন মুন্নি আক্তারকে।

মুন্নি তার বাবা-মায়ের ছয় সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। তার চার ভাই ও এক বোন দিনমজুর এবং সবাই বিবাহিত। তার মা লায়লী বেগম (৬০) গৃহিনী।

বিয়ের আগে মুন্নি মিঠাপুকুরের পায়রাবন্দ সরকারি বেগম রোকেয়া স্মৃতি ডিগ্রি কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের প্রথম বর্ষ পর্যন্ত পড়াশোনা করেন।

বিয়ের পর তারা তিন বছর যৌথ পরিবারে বসবাস করেন। ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারির সময় তারা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ঢাকায় যান।

মানিক সেখানে মুন্নি জন্য একটি গার্মেন্টস কারখানায় চাকরি জোগাড় করেন এবং নিজে সবজি বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু ঢাকায় টিকে থাকা কষ্টকর হওয়ায় ২০২১ সালে তারা রংপুরে ফিরে আসেন।

মানিক আবারও অটোরিকশা চালানো শুরু করেন এবং দর্শনা শুটকি মোড়ে আগের জায়গায় চায়ের দোকান দেন। মুন্নি স্বামীকে সাহায্য করতে গবাদিপশু লালন-পালন করতেন।

রাজনৈতিক আন্দোলন ও শাহাদাত

মুন্নি বলেন, ‘মানিক শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে র‌্যালি ও বিক্ষোভ মিছিলে অংশ নিচ্ছিলেন, যাতে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসন থেকে জাতিকে মুক্ত করা যায়।’

১৮ জুলাই সকালবেলায় মানিক তার অটোরিকশা নিয়ে বের হন এবং চায়ের দোকানে যান। কিছুক্ষণ পর মুন্নিও তাদের শিশু সন্তান সিয়ামকে নিয়ে দোকানে যান।

তিনি জানান, ‘১৬ জুলাই বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের মেধাবী ছাত্র আবু সাঈদ পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়ার পর রংপুরসহ পুরো দেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।’

১৮ জুলাই দুপুর দেড়টায় মানিক চায়ের দোকানে ফিরে আসেন, তার মুখ লাল হয়ে গিয়েছিল এবং শরীরে ময়লা লেগেছিল।

তিনি জানান, পুলিশ তাদের মিছিলের ওপর টিয়ার গ্যাস ছোড়ে ও গুলি চালায়, এতে কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। পরে মানিক তাকে ২৫ টাকা দিয়ে মডার্ন মোড়ে গিয়ে মিছিলে যোগ দিতে বলেন।

মুন্নি বলেন, ‘আমি তাকে কিছু খাওয়ার জন্য দিলাম এবং নিজে মডার্ন মোড়ে গিয়ে দেখি, এক আহত শিক্ষার্থীর চিকিৎসার টাকা নেই। আমি তাকে ২৫ টাকা দিয়ে রিকশায় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেই।’

মানিকের শহীদ হওয়া

দুপুর সাড়ে ৩ টায় মানিক আবার মিছিলে যোগ দিতে বেরিয়ে যান। বিকেল ৪:৩০টায় কিছু মানুষ এসে বলেন, রংপুর মডেল কলেজ গেটের কাছে পুলিশের গুলিতে একজন মানিক আহত হয়েছেন।

মুন্নি বলেন, ‘আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি, আর আমার ছেলে সিয়াম খুব বেশি কাঁদতে থাকে। কেউ একজন বলে, গুলিবিদ্ধ মানিক আমার স্বামী নন, অন্য কেউ।

আমি বারবার ফোন করতে থাকি, কিন্তু আমার মোবাইলের চার্জ শেষ হয়ে গিয়েছিল।’

মানিককে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই সন্ধ্যা সাড়ে ৬ টায় তার মৃত্যু হয়। পুলিশ নানা জটিলতা সৃষ্টি করে লাশ হস্তান্তরে বাধা দেয়।

শেষ পর্যন্ত শর্তসাপেক্ষে ১৯ জুলাই আসরের আগে জানাজা শেষ করার শর্তে লাশ হস্তান্তর করা হয়।

পরিবারের আহ্বান

মুন্নি বলেন, ‘আমার স্বামী কী দোষ করেছিল? কেন তাকে হত্যা করা হলো? আমার ছোট ছেলেকে কী উত্তর দেব? সে তো এখনো জানে না, তার বাবা আর ফিরবে না। আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’

মানিকের মা নূরজাহান বেগম বাকরুদ্ধ হয়ে গেছেন। তিনি শুধু বলেন, ‘আমার ছেলে মানিক আর নেই, আমার স্বামীও নেই। আমার পরিবার এখন কী করবে? আমি বিচার চাই।’

মানিকের ছোট বোন শিউলি বলেন, ‘আমাদের বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই মানিকই ছিল বাবার জায়গায়। কিন্তু তাকেও হত্যা করা হলো। আমার ভাতিজার কান্না কে শুনবে? এই কষ্ট সহ্য করা যায় না।’

মানিকের চাচা আবদুল বারি বলেন, ‘মানিক খুব ভালো ছেলে ছিল। সে প্রতিদিন আন্দোলনে গিয়ে সবাইকে পানি সরবরাহ করত। আমরা অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এই অসহায় পরিবারের জন্য কিছু করার আবেদন জানাই।’

সহায়তা ও ভবিষ্যৎ প্রত্যাশা

মুন্নি জানান, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন থেকে কিছু সহায়তা মিলেছে, তবে তা যথেষ্ট নয়। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, যেন তার স্বামীর হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।

তিনি বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে অনুরোধ জানাই, আমার যোগ্যতা অনুযায়ী আমাকে একটি সরকারি চাকরি দেওয়া হোক, যাতে আমি আমার সন্তান সিয়ামকে জুলাই বিপ্লবের চেতনায় গড়ে তুলতে পারি।’

শহীদের স্ত্রী হিসেবে গর্ব

কান্নাভেজা চোখে মুন্নি বলেন, ‘আমি গর্বিত, আমার স্বামী মানিক জাতিকে মুক্ত করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন।’