শিরোনাম
প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ (বাসস) : সতেরো বছর বয়সী আবদুল্লাহ আল রোমানের স্বপ্ন ছিল সাদামাটা, কিন্তু গভীর। সে চেয়েছিল লেখাপড়া শেষ করে একটি সরকারি চাকুরি নিয়ে পরিবারের ভাগ্য বদলাতে।
কিন্তু সেই স্বপ্ন নিদারুণভাবে ভেঙে গেল গত ৫ আগস্ট। চনপাড়া এলাকায় বিজয় মিছিল চলাকালে গুলিতে তার জীবন শেষ হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে, প্রায় ১৬ বছর ধরে চলা ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর ওই বিজয় মিছিলে গুলি চালায় আওয়ামী লীগ সমর্থকরা।
পরিবারের আশার আলো ছিল রোমান
রোমান রূপগঞ্জের চনপাড়ার নবকিশলয় উচ্চ বিদ্যালয় ও গার্লস কলেজের দশম শ্রেণির ছাত্র ছিল। সে ছিল চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড়। তার বাবা আনোয়ার হোসেন (৩৯) পেশায় প্রাইভেটকার চালক। আর মা রোজিনা (৩৬) একজন গৃহিণী।
পরিবারটি রূপগঞ্জের চনপাড়া এলাকায় খাস জমির ওপর টিনশেডের ঘরে বসবাস করত এবং আর্থিক অনটনের মধ্যে দিন কাটাত। রোমান মনে করত, লেখাপড়াই পারে তার ভবিষ্যৎ গড়তে এবং পরিবারের দুঃখ মোচন করতে।
রোমানের ছোট ভাইদের মধ্যে আবদুল্লাহ (৭) স্থানীয় স্কুলের প্রথম শ্রেণির ছাত্র, আর আহমেদ (৫) ও মোহাম্মদ (৩) এখনো স্কুলে ভর্তি হয়নি।
রোজিনা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে সরকারি চাকুরি করতে চেয়েছিল। সে চেয়েছিল তার ছোট ভাইদের পড়াশোনা করাতে। কিন্তু আওয়ামী সন্ত্রাসীরা তার সেই স্বপ্ন পূরণ করতে দিল না। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগেই তারা আমার ছেলেকে হত্যা করেছে।’
শেখ হাসিনার দেশত্যাগে বিজয় মিছিল
তিনি জানান, শেখ হাসিনার দেশত্যাগের পর স্থানীয় বিএনপি নেতাকর্মীরা বিজয় মিছিলের আয়োজন করেছিল। বছরের পর বছর আওয়ামী লীগের শাসনে বিএনপি সমর্থকরা আতঙ্কে ছিল এবং তারা এলাকায় টিকে থাকতে পারেনি। শেখ হাসিনা পদত্যাগ করার পরও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হুমকি দিয়েছিল যে, বিএনপি নেতাকর্মীরা এলাকায় ঢুকতে পারবে না।
বিজয় মিছিল থেকে ফেরা হলো না
৫ আগস্ট সন্ধ্যায়, চনপাড়ায় স্থানীয় মসজিদের মাইকে বিএনপি নেতারা বিজয় মিছিলে অংশ নেওয়ার জন্য এলাকাবাসীকে আহ্বান জানান। রোজিনা বলেন, সেই ডাক শুনে তার ছেলে রোমান বাড়ি থেকে বের হয়।
‘বের হওয়ার আগে আমার ছেলে তার নানিকে বলেছিল, সে ফিরে এসে পরোটা খাবে। কিন্তু আমার ছেলে আর ফিরে আসেনি,’ কান্নায় ভেঙে পড়েন রোজিনা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে কাঁদছিলেন তার মা, রোমানের নানি তাসলিমা।
গুলিতে ১৫ জন আহত, রোমান নিহত
মিছিল এগিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ গুলি ছোড়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ সমর্থিত সশস্ত্র ব্যক্তিরা গুলি চালায়, যাতে অন্তত ১৫ জন আহত হয়। তবে ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারায় রোমান।
‘একপর্যায়ে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা মিছিলে গুলি চালায়, এতে কমপক্ষে ১৫ জন আহত হয়। আমার ছেলের শরীরে ১৮টি ছররা গুলি বিদ্ধ হয়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই, কিন্তু চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন,’ বিলাপের সুরে বলেন রোজিনা।
তিনি বলেন, পরে তারা হাসপাতাল থেকে লাশ নিয়ে আসেন এবং ৬ আগস্ট সকালে চনপাড়ার স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করেন।
শূন্যতায় ভুগছে পরিবার
রোমানের শাহাদাত তার পরিবারকে এক গভীর শূন্যতার মাঝে ঠেলে দিয়েছে। তার স্মৃতি এখনো তাড়া করে পরিবারের সদস্যদের। তার মা এখনও অনুভব করেন, যেন রোমান তার কাছেই আছে। আর ছোট ভাইয়েরা তাকে ভীষণভাবে মিস করে।
রোমানের মা যখন এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন তার ছোট ভাইয়েরা মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনছিল এবং প্রতিবেদকের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল।
১০৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা
বিচার দাবিতে রোমানের পরিবার রূপগঞ্জ থানায় ১০৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে, যার মধ্যে ৪৫ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে এবং ৫০-৬০ জন অজ্ঞাতনামা। প্রধান আসামিদের মধ্যে রয়েছেন শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের ও গোলাম দস্তগীর গাজী প্রমুখ।
হত্যাকারীদের ফাঁসি চাই
‘আমি আমার ছেলের ন্যায়বিচার চাই। আমি তার হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড চাই। আমি তাদের ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে দেখতে চাই,’ দাবি করেন রোজিনা।