প্রতিবেদন: আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : গণ-আন্দোলনে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে দিশেহারা সুরমা বেগম। তবে দুঃখের ভারে ভারাক্রান্ত হলেও হত্যার বিচার চান না তিনি, বরং সবকিছু আল্লাহর ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।
‘দুঃখের সংসারে সুখের মুখ দেখিনি কখনও। স্ত্রী, সন্তান আর বাবা-মায়ের মুখে হাসি ফোটাতে যে মানুষটি দিনরাত পরিশ্রম করতেন। নিজে না খেয়ে আমাদের খাবারের চিন্তা করতেন। আজ তাকে হারিয়ে আমরা আরও নিঃস্ব হয়ে গেছি। যারা আমার স্বামীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে, আমি দুনিয়ার কারো কাছে তাদের বিচার চাই না, আমি সবকিছু আল্লাহর হাতেই ছেড়ে দিয়েছি।’
কথাগুলো বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনে শহীদ হওয়া ভোলার বাবুলের স্ত্রী সুরমা বেগম (২৮)। সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম স্বামীকে হারিয়ে স্ত্রী সুরমা এখন বাকরুদ্ধ, হতবিহ্বল।
জানা যায়, মেঘনা নদীর ভাঙনে ভিটেমাটি হারিয়ে ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে জন্মস্থান ছেড়ে ঢাকায় পাড়ি জমান ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা ইউনিয়নের নাদের মিয়ারহাট এলাকার আবুল কাশেমের ছেলে মো. বাবুল (৪০)। ঢাকার মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরের ‘ভোলাইয়া’ নামক বস্তিতে বসবাস করতেন তিনি। সেখানে একটি বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তার প্রাইভেটকার চালাতেন।
এক ছেলে, দুই মেয়ের বাবা ছিলেন বাবুল। বড় মেয়ে লিজা আক্তারকে বিয়ে দিয়েছেন। একমাত্র ছেলে মো. শুভ একটি হেফজ মাদ্রাসায় ১৩ পারা কুরআন মুখস্থ করেছে। ছোট মেয়ে নূরজাহান প্রথম শ্রেণিতে পড়াশোনা করে। বাবা-মা ও স্ত্রী-সন্তান নিয়ে তার ছিল সুখের সংসার।
গত ১৮ জুলাই ২০২৪ ঢাকার উত্তরায় গুলিবিদ্ধ হয়ে ১৯ জুলাই দিবাগত রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় তার। শহীদ বাবুলের মৃত্যুতে সুখের সংসার নিমেষেই দুঃখের সাগরে পরিণত হয়। স্বামী হারিয়ে স্ত্রী সুরমা বেগমের দুঃখের শেষ নেই। সংসারের খরচ জোগাতে ফুটপাতে চায়ের দোকান চালাচ্ছেন তিনি।
শহীদ বাবুলের স্ত্রী সুরমা বেগম বাসসকে জানান, ছোটবেলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ঢাকায় যান তার স্বামী বাবুল। প্রতিষ্ঠিত হতে জীবনে অনেক সংগ্রাম করেছেন তিনি। জীবনযুদ্ধে জয়লাভের আগেই বুলেটের কাছে হেরে যান।
পরিবারের পক্ষ থেকে জানা গেছে, ১৮ জুলাই সকাল ৯টার দিকে বাসা থেকে সকালের নাশতা খেয়ে গাড়ি চালাতে বেরিয়ে যান বাবুল। যাওয়ার সময় ছেলে শুভকে বলেন, ‘বাইরের অবস্থা ভালো না, ঘর থেকে বের হওয়ার দরকার নেই।’ এটিই ছিল পরিবারের সঙ্গে তার শেষ কথা। এরপর তিনি মালিককে নিয়ে ঢাকার উত্তরা এলাকায় যান। মালিক ব্যাংকে প্রবেশ করলে তিনি নিচে অপেক্ষা করছিলেন।
দুপুর ১টার দিকে আজান দিলে পাশের একটি মসজিদে নামাজ পড়তে যান। নামাজ শেষে বের হওয়ার পর পুলিশ ও ছাত্রদের সংঘর্ষের মাঝখানে পড়ে যান তিনি। সংঘর্ষের সময় পুলিশের ছোড়া গুলি তার চোখ ও বুকে লাগে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি।
পরে স্থানীয় এক পরিচিত ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করে একটি হাসপাতালে নিয়ে যান এবং মোবাইল ফোনে তার বাসায় খবর দেন। খবর পেয়ে পরিবারের সদস্যরা হাসপাতালে ছুটে যান। সেখানেই ১৯ জুলাই দিবাগত রাত আড়াইটার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। পরদিন সকালে তার মরদেহ মিরপুরের দুয়ারিপাড়া কবরস্থানে দাফন করা হয়।
স্ত্রী সুরমা বেগম জানান, তাদের বাসার পাশে ফুটপাতে একটি চায়ের দোকান ছিল। বাবুল প্রাইভেটকার চালানোর ফাঁকে দোকানটি চালাতেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারে অভাব নেমে আসে। বাধ্য হয়ে স্বামীর রেখে যাওয়া চায়ের দোকান চালাচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘স্বামী মারা যাওয়ার পর শুধু ভোলা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছি। সরকারি-বেসরকারি কোনো সংস্থা আমাদের খোঁজ নেয়নি। তবে আমি দুনিয়ার কারও কাছে স্বামীর হত্যার বিচার চাই না। আল্লাহর কাছেই বিচার দিয়েছি।’
এদিকে ছেলে বাবুলের মৃত্যুতে তার বৃদ্ধ বাবা আবুল কাশেম (৬২) ও মা রাবেয়া বেগম (৫৩) বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। সংসারে অভাবের কারণে তারা ছোট ছেলে আলামগীরের কাছে চলে গেছেন।
ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে তারা বলেন, ‘মৃত্যুর আগে অন্তত বাবুলের হত্যাকারীদের শাস্তি দেখে যেতে চাই।’ একই সঙ্গে শহীদ বাবুলের পরিবারের জন্য সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তারা।