আনন্দ মিছিলে গিয়ে জীবন প্রদীপ নিভে গেল হাফেজ আনাস বিল্লাহ’র

বাসস
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:২৪
শহীদ হাফেজ আনাস বিল্লাহ’র পরিবারের সদস্য

প্রতিবেদন: মো. আসাদুজ্জামান

সাতক্ষীরা, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে বন্ধুদের সাথে আনন্দ মিছিলে যায় সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগরের মাদ্রাসা ছাত্র হাফেজ আনাস বিল্লাহ। আর এই আনন্দ মিছিল যে তার কাল হয়ে দাঁড়াবে তা সে স্বপ্নেও বুঝতে পারেনি। বুঝতে পারেনি যে তার জীবন প্রদীপ এভাবে নিভে যাবে। আনাস বিল্লাহ’র ইচ্ছা ছিল লেখাপড়া শেষ করে সে বিদেশ গিয়ে ভালো একটি চাকুরি করবে। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস ওই আনন্দ মিছিলে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের ছোড়া বুলেটে তার সে ইচ্ছা আর পূরণ হলো না।

হাফেজ আনাস বিল্লাহ (১৭) আশাশুনি উপজেলার প্রতাপনগর গ্রামের মো. আব্দুল আরেজ (৫০)-এর মেঝ ছেলে এবং স্থানীয় কাকবাশিয়া মদিনাতুল উলুম ফাজিল মাদ্রাসার দাখিল পরীক্ষার্থী। তার মায়ের নাম আনেয়ারা খাতুন (৪০। তিনি একজন গৃহিনী। এই দম্পতির বড় ছেলের নাম আরিফ বিল্লাহ (২৫)। সে প্রতাপনগর এবিএস ফাজিল মাদ্রাসার ১ম বর্ষের ছাত্র। আর ছোট ছেলের নাম আহসান উল্লাহ। তার বয়স মাত্র সাড়ে ৪ বছর।

হাফেজ আনাস বিল্লাহ’র বড় ভাই আরিফ বিল্লাহ জানান, গত ৫ আগস্ট স্বৈরাচার শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার খবর শুনে প্রতাপনগরের ছাত্র-জনতা স্থানীয় তালতলা বাজার একটি আনন্দ মিছিল বের করে। এই মিছিলে আমার ভাইসহ তার বন্ধুরা যোগ দেয়। 

তিনি বলেন, মিছিলটি ফুলতলা বাজার ও কল্যাণপুর বাজার হয়ে নাকনা গ্রামের স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ও সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেনের বাড়ির সামনে গেলে সেসহ আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী ওই শান্তিপূর্ণ আনন্দ মিছিলকে লক্ষ্য মুহুর্মুুহু গুলি ছোড়ে। এতে আমার ভাই আনাস বিল্লাহসহ কয়েকজন আহত ও নিহত হন। আমার ভাইয়ের শরীরে মোট তিনটা গুলি লাগে। 

তিনি আরও বলেন, এর মধ্যে একটি গুলি তার তলপেটের ভেতরে ঢুকে কিডনিতে লাগে। আরেকটি গুলি তার বুকে ও অপরটি তার ডান হাতে লাগে। এতে তার প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। একপর্যায়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। আমার এই ছোট ভাইয়ের মৃত্যুর শোক আমারা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আমার বৃদ্ধ মা বাবা এখনও তার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে।

তিনি বলেন, আমার বাবা একজন দরিদ্র মানুষ। স্থানীয় তালতলা বাজারে আমার বাবার একটি হাড়িপাতিলের দোকান আছে। সেটা চালিয়ে আমাদের পরিবারের সবারই জীবন জীবিকা নির্বাহ করতে হয়। 

তিনি এসময় আরো বলেন, আমার ভাই মারা যাওয়ার পর জামায়াত ইসলামীর পক্ষ থেকে দুই লাখ ও ঢাকার নারী ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে ৫০ হাজার টাকার অনুদান পেয়েছি। এছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ৫ লাখ টাকার একটি অনুদান পেয়েছি। 

আনাস বিল্লাহ’র মা আনোয়ারা খাতুন কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমার মেঝ ছেলে হাফেজ আনাস বিল্লাহ এভাবে আমাদেরকে ছেড়ে দুনিয়া থেকে চলে যাবে তা আমি কখনও ভাবতে পারিনি। ছেলে আমার দুপুর বেলা বাড়ি থেকে ভাত খেয়ে দোকানে গেল। আমি তাকে যত্ন করে খাওয়া-দাওয়া করালাম। এরপর সে দোকানে চলে গেল। তারপর কীভাবে কী হয়ে গেল জানি না। আমার ছেলে মারা গেছে এটা আমি কিছুতেই মেনে নিতেই পারছি না। আমি এখনও পথ চেয়ে বসে থাকি আমার ছেলে ফিরে আসবে বলে।

তিনি তার ছেলের মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের বিচার করেন।

আনাস বিল্লাহ’র বাবা আব্দুল আরেজ আবেগ জড়িত কন্ঠে বলেন, গত ৫ আগস্ট দুপুরে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা বিমানে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে এটা আমি দোকানে বসে টিভিতে দেখছি। দেখতে দেখতে আমি একপর্যায়ে দোকানের বাইরে এসেছি। বাইরে এসে দেখি আমার বড় ছেলে ভ্যানের উপর বসে রয়েছে।

কিন্তু আমার ছোট ছেলে আনাস বিল্লাহ সেখানে নেই। 

এরই মধ্যে অনেকেই বলছে দোকানদার আজ ঈদের মতো আনন্দ লাগছে। তুমি আমাদেরকে কিছু খেতে দাও। আমি সঙ্গে সঙ্গে তাদেরকে মুড়ি ও চানাচুর এনে খেতে দিলাম।

এরই মধ্যে খবর আসলো আমার ছেলেসহ তার বন্ধুরা ছাত্র-জনতার আনন্দ মিছিলে গেছে। আর ওই আনন্দ মিছিলে আওয়ামীলীগ নেতা সাবেক চেয়ারম্যান জারিকসহ তার লোকজন গুলিবর্ষণ করছে। 

একথা শুনে আমি দৌড়াতে দৌড়াতে জাকির চেয়ারম্যানের বাড়ির দিকে যেতে লাগলাম। এরই মধ্যে আমার কাছে অসংখ্য বার ফোন আসছে। কিন্তু ফোনটা আর আমার ধরার কথাও মনে পড়েনি। হঠাৎ আমার এক প্রতিবেশী পথিমধ্যে মোটরসাইকেলে তুলে নিয়ে আমাকে বলল আমার ছেলের গায়ে গুলি লাগছে।

একথা শুনেই আমি আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলাম না। 

আমি তাকে বললাম আমার ছেলের গুলি কোথায় লেগেছে? সে বললো বুকে লেগেছে। তখন আমি বললাম তাহলে আমার ছেলে আর বেঁচে নেই। আমরা যখন ঘটনাস্থলে গেলাম এর আগেই ঘটনাস্থলে থাকা স্থাণীয় লোকজন আমার ছেলেকে নিয়ে সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছে। 

একপর্যায়ে বামনডাঙ্গায় গিয়ে তাদের সাথে আমার দেখা হলো। সেখানে আমাদের এলাকার গ্রাম্য ডাক্তার খায়রুজ্জামান বলল, আনাস বিল্লাহ মারা গেছে। আর তাকে মেডিকেলে নেয়ার প্রয়োজন নেই। সেখান থেকে তাকে নিয়ে ফিরে এসে বাড়িতে নিয়ে জানাজা নামাজ শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করি। 

তিনি এসময়, ছেলে হারানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকেন এবং বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। তিনি বলেন, আমার ছেলেকে যারা গুলি করে হত্যা করেছে তাদের বিচার মহান আল্লাহ পাকের ওপর ছেড়ে দিলাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার ছাড়া জনগণ নির্বাচন মানবে না : গোলাম পরওয়ার
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় মোশাররফ গ্রেফতার
আন্তঃবাহিনী আযান ও ক্বিরাত প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠিত
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করা দরকার তা করা হবে : মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসবে পার্বত্য উপদেষ্টা
বাঞ্ছারামপুরে  নির্যাতনের শিকার শিশুটির চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে এলেন তারেক রহমান
আগামী ঈদের আগেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার : জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
জাফরুল্লাহ চৌধুরী তরুণদের কাছে অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবেন : ফারুক-ই-আজম
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে এনফ্রেল প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ
জাফরুর নতুন কমিটি : অডেন সভাপতি ও আকতারুল সাধারণ সম্পাদক
দেশের মানুষ হাসিনার দৃশ্যমান বিচার ও সংস্কার দেখতে চায় : শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি
১০