প্রিয়জনের অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারছেন না শহীদ মো. রশিদের পরিবার সদস্যরা

বাসস
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:৩৪
শহীদ মো. রশিদ -ছবি : বাসস

প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসেন

ঢাকা, ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ (বাসস) : শহীদ মো. রশিদের পরিবার সদস্যরা এখনও চরম শোকের মধ্যে রয়েছেন, প্রিয়জনের অনুপস্থিতি মেনে নিতে পারছেন না তারা। 

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর রাজধানীর উত্তরা এলাকায় বিজয় মিছিলের সময় রশিদকে ‘গুলি করে হত্যা করা হয়’।

মেডিকেল রিপোর্ট অনুযায়ী তার মাথায় গুলি লাগে। এতে তার খুলি চূর্ণ হয়ে যায়।

তিনি গাজীপুরের বিশ্ব ইজতেমা মাঠের ঠিক বিপরীতে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় একটি ভাঙ্গারির দোকান চালাতেন। স্ত্রী সালমা (৩৫), ছেলে সাইফুল ইসলাম সালমান (১৭) এবং মেয়ে সাবিহা (৮) নিয়ে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।

তবে তার বাবা মো. ইসমাইল হোসেন (৭৫), মা রশিদা বেগম (৬৫), ছোট ভাই মো. শাহিদ (৩৮) এবং অবিবাহিত বোন লাকি (৩০) শহরের যাত্রাবাড়ীর শ্যামপুর এলাকায় থাকেন।

রশিদের স্ত্রী সালমা কান্নাজড়িত কণ্ঠে মর্মস্পর্শী স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘আমার স্বামী ৫ আগস্ট সকাল ৮টার দিকে দোকানে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বের হন। কিন্তু পরে আমরা জানতে পারি যে তিনি শেখ হাসিনার দেশ ছাড়ার পর বিকাল ৩টার দিকে বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছেন।’

তার ছেলে সালমান স্মরণ করেন যে তিনি সেই দিন বিকেলে তার বাবার সাথে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় বিজয় মিছিলে যোগ দিয়েছিলেন।

সালমান বলেন, ‘আমরা সেখানে ফ্লাইওভারের নিচে পৌঁছে দেখি একজন মোটরসাইকেল আরোহী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন। তাই, আমার বাবা প্রথমে সেই ব্যক্তিকে টঙ্গী মেডিকেলে নিয়ে যান এবং পরে তাকে তার গন্তব্যে পৌঁছে দিতে উত্তরা যান। তখন আমি বাড়ি ফিরে আসি।’

তিনি গভীর শোকের সাথে স্মৃতিচারণ করেন যে মাগরিবের নামাজের পর বাড়ি ফেরার পথে উত্তরা ১ নং সেক্টর মসজিদের সামনে তার বাবা গুলিবিদ্ধ হওয়ার মর্মান্তিক খবরটি জানতে পারেন তারা।

রশিদের বাবা ইসমাইল হোসেন স্মরণ করেন যে সেই দিন বিকেলের দিকে তার এক দূর সম্পর্কের আত্মীয় তাকে ফোন করে জানান যে রশিদকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নগরীর আগারগাঁওয়ের জাতীয় নিউরোসায়েন্সেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে।

রশিদের শোকাহত বাবা বলেন, ‘কিছু অপরিচিত লোক আমার ছেলেকে বিকেল ৫টার দিকে আগারগাঁও হাসপাতালে নিয়ে যায়, যেখানে ডাক্তাররা খুব ভালো চিকিৎসা দেন।’

তিনি আরও বলেন, চিকিৎসা সত্ত্বেও রশিদ ভর্তির মাত্র ৯০ মিনিট পর সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটের দিকে মারা যান।

শোকাহত ইসমাইল বলেন, তিনি মধ্যরাতের দিকে হাসপাতাল থেকে তার ছেলের লাশ নিয়ে শ্যামপুরের বাসায় নিয়ে আসেন। পরে, তারা ৬ আগস্ট জোহরের নামাজের পর রশিদকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করেন।

রশিদের মৃত্যু তার পরিবারকে হতাশায় ফেলে দিয়েছে। তার বাবা ইসমাইল একসময় একটি ছোট জুতার ব্যবসা চালাতেন। তিনি তার সঞ্চয়ের টাকা রশিদের ভা্গংারি ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছিলেন। এখন, কোন স্থিতিশীল আয় নেই। ফলে তিনি এখন তার প্রয়োজনীয় ওষুধও কিনতে পারছেন না।

ইসমাইল গভীর শোকের সাথে বলেন, ‘আমার বড় ছেলে রশিদ প্রতি মাসে আমাকে ১৫,০০০ থেকে ২০,০০০ টাকা পাঠাত, যা এখানে (শ্যামপুরে) আমার পরিবারের প্রধান অবলম্বন ছিল। কিন্তু, তার মৃত্যুর পর থেকে আমরা একটি কঠিন সময় পার করছি। এখন আমি আমার প্রয়োজনীয় ওষুধও কিনতে পারি না।’

তিনি বলেন, তার ছোট ছেলে মো. শাহিদ প্রতি মাসে প্রায় ১১,০০০ টাকা আয় করে, যা তাদের পরিবারের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়। আর তার দুই মেয়ের মধ্যে একজন এখনও অবিবাহিত।

ইসমাইল বলেন, খুব ছোটকালে ভোলার দৌলতখান উপজেলায় তাদের পৈতৃক বাড়ি মেঘনা নদীতে ভেঙে যাওয়ার পর রাজধানীতে চলে আসেন এবং শ্যামপুর এলাকায় থাকা শুরু করেন। তিনি এখন একই এলাকায় তার স্ত্রীর বাবার কাছ থেকে পাওয়া এক টুকরো জমিতে একটি ছোট একতলা বাড়ি তৈরি করে থাকেন।

রশিদের স্ত্রী টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় তার দুই সন্তান নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, তার স্বামীর ৬ থেকে ৭ লাখ টাকা ঋণ থাকায় তার পরিবারের প্রয়োজন মেটাতে কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছেন।

সালমা বলেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে আমরা দোকানটি ঠিকমতো চালাতে পারছি না। আমার কিশোর ছেলে এখন দোকানটি চালাচ্ছে। তাই, দোকান ভাড়া দিয়ে আমরা প্রতি মাসে মাত্র ১৫,০০০ টাকা বাঁচাতে পারি, যা আমাদের খরচ মেটানোর জন্য যথেষ্ট নয়।

তিনি তার সন্তানদের শিক্ষা খরচ মেটানোর জন্য সংগ্রাম করছেন। তার ছেলে সালমান এই বছর মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষা দেবে। আর মেয়ে সাবিহা স্থানীয় মাদ্রাসায় দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ে।

জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি ৫ লাখ টাকা দিয়ে কিছু ঋণ শোধ করেছি। আর কিছু টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছি।’

রশিদের ছেলে সালমান এখন তার বয়সের চেয়ে অনেক বেশি দায়িত্ব পালন করছেন। ২০২৫ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী সালমান পড়াশোনার পাশাপাশি তার বাবার ভাঙ্গারির দোকান চালাচ্ছেন।

সালমান বলেন, ‘আমরা এখন আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাকে আমার পরিবারের দায়িত্ব নিতে বাধ্য করা হয়েছে। এসএসসি পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি আমি আমার বাবার দোকান চালাচ্ছি।’

রশিদের পরিবার তাকে হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
সংস্কার ও জুলাই গণহত্যার বিচার ছাড়া জনগণ নির্বাচন মানবে না : গোলাম পরওয়ার
খালেদা জিয়ার গাড়িবহরে হামলার ঘটনায় মোশাররফ গ্রেফতার
আন্তঃবাহিনী আযান ও ক্বিরাত প্রতিযোগিতার সমাপনী অনুষ্ঠিত
পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যা করা দরকার তা করা হবে : মৈত্রী পানি বর্ষণ উৎসবে পার্বত্য উপদেষ্টা
বাঞ্ছারামপুরে  নির্যাতনের শিকার শিশুটির চিকিৎসা সহায়তায় এগিয়ে এলেন তারেক রহমান
আগামী ঈদের আগেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে কাজ করছে সরকার : জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা
জাফরুল্লাহ চৌধুরী তরুণদের কাছে অক্ষয় ও অমর হয়ে থাকবেন : ফারুক-ই-আজম
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে এনফ্রেল প্রতিনিধি দলের সাক্ষাৎ
জাফরুর নতুন কমিটি : অডেন সভাপতি ও আকতারুল সাধারণ সম্পাদক
দেশের মানুষ হাসিনার দৃশ্যমান বিচার ও সংস্কার দেখতে চায় : শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি
১০