প্রতিবেদন : সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন
ঢাকা, ৭ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া ২৮ বছর বয়সী নির্মাণশ্রমিক জাহিরুল ইসলাম শুভর মৃত্যু তার পরিবারকে শুধু অর্থনৈতিক নয়, মানসিকভাবেও এক চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে।
গত বছরের ৫ আগস্ট দীর্ঘ প্রায় ১৬ বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের পতনের পর উত্তরা পূর্ব থানার সামনে আজমপুর এলাকায় বিজয় মিছিলে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ হন শুভ। সগুলিটি তার মাথা ভেদ করে চলে যায়, তার তা তার পরিবারে রেখে যায় এক অপূরণীয় শূন্যতা।
শুভ ছিলেন তার পরিবারের একমাত্র ছেলে। ক্যান্সার আক্রান্ত বাবা সিরাজুল ইসলাম (৬০) আর বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলের কর্মী মা নাজমা বেগম (৫০)। তার একমাত্র বোন মারজিনা আক্তার বিবাহিত এবং নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত।
শুভর মৃত্যু সবচেয়ে বড় ধাক্কা দেয় তার স্ত্রী আম্বিয়া বেগম (২৩) আর মাত্র সাত বছরের ছেলে আরিয়ান ইসলামকে। বাবাহীন আরিয়ান অন্য শিশুদের বাবা-মায়ের ভালোবাসা দেখতে দেখতেই বড় হবে, কিন্তু সেই অনুভূতি সে কখনোই পাবে না।
শুভর শহীদ হওয়ার পর রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর মাতুয়াইল উত্তরপাড়ায় ভাড়া বাসায় এই প্রতিবেদক কথা বলতে গেলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তার মা নাজমা বেগম। ‘আমার ছেলের দোষ কী ছিল? আল্লাহ কেন তাকে কেড়ে নিলেন? আমার কোনো ছেলে রইল না, কে আমাকে কবর দেবে?’ —কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন নাজমা বেগম।
তিনি জানান, সেই দিন সকালে শুভ কাজে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েছিল উত্তরার উদ্দেশ্যে। শুভর মৃত্যুর পর প্রথম তিন মাস প্রতিদিন রাতে ছেলেকে স্বপ্নে দেখতেন তিনি। কিন্তু শেষ দুই মাস ধরে শুভ আর স্বপ্নেও আসে না।
‘আমার ছেলের মুখে মা ডাকটা খুব মনে পড়ে। এখন আর কেউ ওভাবে মমতা নিয়ে আমাকে ডাকে না,’ বলেই আবার কান্নায় ভেঙে পড়েন নাজমা।
শুভর জন্যই তারা ওই দুই রুমের ভালো বাসাটা ভাড়া নিয়েছিলেন। ‘শুভ যেখানে থাকত, সেই রুমে আমি গত পাঁচ মাস ধরে ঢুকি না। রাতে ঘুমাতেও পারি না ছেলেকে হারানোর যন্ত্রণায়। এই বাসা শুধু শুভর কথা ভেবেই নিয়েছিলাম। এখন কে থাকবে এখানে?’ বলেন শোকে কাতর নাজমা।
শুভর ২৩ বছর বয়সী স্ত্রী আম্বিয়া বেগম এখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখে। সন্তান নিয়ে বেঁচে থাকার মতো কোনো অবলম্বন তার নেই। বাধ্য হয়ে তিনি এখন পঞ্চগড়ে নিজের বাবার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
‘আমার শাশুড়ির নিজেরই টিকে থাকা মুশকিল। আমি যেন ওদের জন্য বোঝা হয়ে গেছি। আমি আর আমার ছেলের কী হবে জানি না,’ কাঁদতে কাঁদতে বলেন আম্বিয়া।
তিনি জানান, জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা পেয়েছেন—তার ও শাশুড়ির জন্য আড়াই লাখ করে। কিন্তু কোনো টাকাই তো প্রিয়জনের জীবনের মূল্য হতে পারে না।
‘এত অল্প বয়সে স্বামীকে হারিয়ে আমি দিশেহারা। কীভাবে এই কষ্ট বোঝাব? যদি শুভ বেঁচে থাকতো, হয়তো কষ্ট করে চলতাম, কিন্তু অন্তত একে অপরকে দেখতে পারতাম,’ বলেন আম্বিয়া।
তিনি জানান, ছেলে আরিয়ানকে পঞ্চগড়ের একটি স্কুলে ভর্তি করানো হয়েছে। ছেলের জন্য সবার দোয়া চেয়েছেন তিনি।
শুভর অকাল মৃত্যুর পর পরিবারটি কীভাবে বেঁচে থাকবে তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় তার বাবা সিরাজুল ইসলাম। ‘শুভই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। ওর চলে যাওয়া আমাদের একেবারে নিঃস্ব করে দিয়েছে। আমার স্ত্রীর সামান্য বেতনে এই সংসার চলবে না। এখন সস্তা বাসায় উঠতে হবে,’ বলেন তিনি।
ভোলার চর সুলতানির গ্রামের বাড়িতে ফেরারও সুযোগ নেই, কারণ নদীগর্ভে তলিয়ে গেছে তাদের ভিটেমাটি।
শুভর মা নাজমা বেগম ছেলের মৃত্যুর আগের দিনের স্মৃতি স্মরণ করে বারবার ভেঙে পড়েন। ‘সেদিন সকালে কাজে বের হওয়ার সময় শুভ ঘুমাচ্ছিল। আমি বললাম, আমি বের হচ্ছি, দরজা বন্ধ করে দিস। ও তখন আমার কাঁধ ধরে বলেছিল, ‘মা, রাস্তাঘাট ভালো না, সাবধানে যেও।’ বুঝতেই পারিনি, এটাই ওর শেষ বিদায় হবে,’ কাঁপা গলায় বলেন নাজমা।
শুভ সেদিন সকাল ১১টার দিকে উত্তরার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে বের হয়েছিল।
সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরতে গিয়ে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি হন নাজমা। শহরজুড়ে ছিল গুলির শব্দ, আতঙ্ক আর বিশৃঙ্খলা। গণজোয়ারে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে রক্তাক্ত ছিল শহর।
নাজমা বলেন, ‘অফিসের লোকজন যেতে মানা করেছিল। কিন্তু আমি কোনোভাবে গলি-ঘুপচি দিয়ে বাসায় ফিরি। পথে যাত্রাবাড়ীতে দেখলাম, মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে ছোড়া গুলিতে এক ছেলেকে আমার সামনেই হত্যা করা হলো।’
মোবাইলে রিচার্জ না থাকায় এক অপরিচিত নারীর মোবাইল দিয়ে মেয়েকে ফোন করে বলি, শুভকে সাবধানে থাকতে বলিস।
‘সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটার দিকে বাসায় পৌঁছানোর পর জানতে পারি, উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল থেকে ফোন করে বলেছে, লাশ নিতে। প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে ফোন করে জানলাম, গুলিতে শুভ মারা গেছে,’ কান্নায় ভেঙে পড়েন নাজমা।
মৃত্যুর আগে শুভ হাসপাতালের ছাত্রদের নিজের বাবার মোবাইল নম্বর দিয়েছিল, যাতে পরিবারকে জানানো যায়।
সেই রাতেই চাচা আর কাজিনরা হাসপাতাল থেকে শুভর মরদেহ নিয়ে আসেন। পরদিন ৬ আগস্ট সকালে মাতুয়াইল কবরস্থানে তাকে দাফন করা হয়।
নাজমা তার ছেলেকে হত্যাকারীদের ফাঁসি চান। ‘আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সম্পদ ছিল আমার ছেলে। আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। আমার ছেলে আর ফিরে আসবে না,’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন নাজমা।