মেয়ের সমাবর্তনে উপস্থিত থাকার স্বপ্ন পূরণ হলো না শহীদ মুজিবের

বাসস
প্রকাশ: ০৯ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩০ আপডেট: : ০৯ মার্চ ২০২৫, ০৯:৩৩
শহীদ মুজিবুর রহমান সরকার - ছবি : সংগৃহীত

প্রতিবেদন: সৈয়দ এলতেফাত হোসাইন

ঢাকা, ৯ মার্চ, ২০২৫ (বাসস): পরিবারের সচ্ছলতা আর সন্তানদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণে জীবনের বেশিরভাগ সময় বিদেশে কাটিয়েছেন ৫৭ বছর বয়সী প্রবাসফেরত মুজিবুর রহমান সরকার। প্রবাস থেকে ফেরার পর থেকে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মেয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য, যাতে গর্বিত বাবার চোখে মেয়ের সাফল্য দেখতে পারেন।

কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয়নি। ২০২৪ সালের ২১ জুলাই ‘জুলাই বিপ্লব’-এর সময় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সাদ্দাম মার্কেট বাসস্টপ সংলগ্ন তুষারধারা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে তাকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়।

তার বড় মেয়ে মারওয়া রহমান সায়মা যখন কোভিড-১৯ মহামারীর সময় স্নাতক সম্পন করেন, তখন তিনি সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আসেন। সেই থেকেই মুজিব অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মেয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য, যাতে গর্বিত বাবার চোখে মেয়ের সাফল্য দেখতে পারেন।

মুজিবুরের বড় মেয়ে সায়মা ইতোমধ্যে গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। তার দ্বিতীয় মেয়ে মায়মুনা রহমান সাদিয়া একই কলেজে সম্মান তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন। আর একমাত্র ছেলে মো. মাহিবুর রহমান সরকার স্থানীয় একটি স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ছে।

সায়মা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাসসকে বলেন, ‘আমাদের বাবা বলেছিলেন, তিনি আমাদের তিনজনের সমাবর্তনে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু সেই স্বপ আর পূরণ হলো না।’

তিনি বলেন, ‘কলেজে যাওয়া-আসার পথে বাবা সবসময় আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। ১৬ জুলাই আমি বাবাকে অনুরোধ করেছিলাম যেন তিনি আমার সঙ্গে না যান, কারণ নগরীর পরিস্থিতি তখন ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর দমন-পীড়নের কারণে চারদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল।’

সায়মা বলেন, ‘আমি বাবাকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পারিনি। ২১ জুলাই পুলিশ আমাদের এলাকায় ঢুকে বাবাকে হত্যা করে।’

মুজিবুরের স্ত্রী নুরুন্নাহার পারভীন (৪৪) সেই ভয়াল দিনের কথা স্মরণ করে বলেন, ‘সেদিনটা আর পাঁচটা দিনের মতোই শুরু হয়েছিল। আমরা সকলে একসঙ্গে দুপুরের খাবার খেলাম, তারপর মুজিবুর আসরের নামাজ পড়তে বের হলেন তুষারধারা উচ্চ বিদ্যালয়ের বিপরীতে বাইতুশ শরফ জামে মসজিদে।’

তিনি বলেন, ‘আমি আর মেয়েরা তখন ঘুমিয়ে ছিলাম। ভেবেছিলাম, নামাজের আগে প্রতিদিনের মতো ছাদে গাছপালায় পানি দিতে গেছেন। কিন্তু পরে জানতে পারি, তিনি তুষারধারা জিরো পয়েন্টে গিয়ে ওই মসজিদে নামাজ পড়েছেন।’

প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে পারভীন বলেন, নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় পুলিশ এলোমেলো গুলি চালাচ্ছিল। মসজিদের ভেতর থেকে বাইরের পরিস্থিতি সম্পর্কে কিছু না জানায়, বাইরে বের হতেই একটি গুলি তাঁর বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন।

চারদিকে আতঙ্কের পরিবেশে কেউই সাহস করে তাকে উদ্ধার করতে এগিয়ে আসেনি বলে জানালেন পারভীন। পুলিশ চলে যাওয়ার পর এক রিকশাভ্যান চালক সাহস করে তার নিথর দেহ বাড়িতে নিয়ে আসেন।

পারভীন বলেন, ‘ভ্যান চালক যখন লাশ নিয়ে বাসার সামনে এল, তখন আমাদের ভবনের এক ভাড়াটিয়া চিৎকার করে বললেন, 'পারভীন, সব শেষ হয়ে গেছে।'

‘আমি তখনো বুঝতে পারিনি কী হয়েছে। কিন্তু নিচে নেমে যখন দেখি আমার স্বামী ভ্যানে শুয়ে আছেন, তখনও ভাবছিলাম, তিনি হয়তো বেঁচে আছেন, সামান্য আহত হয়েছেন। কারণ তাঁর চোখ খোলা ছিল, আর তিনি আমার দিকে তাকিয়েছিলেন।’

কাঁদতে কাঁদতে পারভীন বলেন, ‘আজও সেই দৃষ্টি চোখের সামনে ভাসে। তবে পরে ভ্যানচালক জানালেন, তিনি ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। এরপর আমি জ্ঞান হারাই।’ ওইদিন কারফিউ চলছিল এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মৃতদেহ গুম করে দিচ্ছে—এমন খবর পেয়ে স্থানীয়রা দ্রুত দাফনের পরামর্শ দেন।

পারভীন বলেন, ‘প্রথমে আমরা লাশটি মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু কোনো অ্যাম্বুলেন্স রাজি হয়নি মরদেহ পরিবহনে। প্রতিবেশীরা বলেছিলেন, দ্রুত দাফন করতে হবে, নইলে পুলিশ মরদেহ নিয়ে যাবে।’

অবশেষে সেদিন রাতেই তুষারধারা কবরস্থানে মুজিবুরকে দাফন করা হয়। সেদিনের স্মৃতি মনে করে সায়মা বলেন, ‘সেদিন বাবার সঙ্গে আমাদের ভালো কথা হয়েছিল। কখনো ভাবিনি, সেদিনই বাবাকে হারাব। নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন, আর লাশ হয়ে ফিরলেন।’

সায়মা বলেন, ২১ জুলাইয়ের আগে-পরে কখনও পুলিশ তুষারধারা এলাকায় আসেনি। শুধু ওইদিনই এসে বাবাকে হত্যা করে।

তিনি বলেন, ‘আমাদের বাবা আমাদের খুব ভালোবাসতেন। আমাদের কোনো কাজ করতে দিতেন না। আমরা কিছু বলার আগেই তিনি সব প্রয়োজন মেটাতেন। তিনি চেয়েছিলেন, আমি যেন ভালো চাকুরি করি। আজ আমরা বাবাকে ভীষণভাবে মিস করি।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের পরিবারে কোনো পুরুষ সদস্য নেই, তাই আত্মীয়স্বজনদের বাবার মৃত্যুর খবরটাও আমাকেই দিতে হয়েছিল। এটি ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত।’

মুজিবুরের ছোট মেয়ে মায়মুনা রহমান সাদিয়া বলেন, ‘বাড়ি থেকে বেরোনোর মাত্র ২০ মিনিটের মধ্যে বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। আমরা ঠিকমতো বাবার শোকে কাঁদতেও করতে পারিনি, কারণ বাবার দাফন নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। আমাদেরকেই সবকিছু সামলাতে হয়েছে।’

মুজিবুরের পরিবার এখন সরকারের কাছে তার কবর সংরক্ষণের আবেদন জানাচ্ছে, যাতে তারা যখন ইচ্ছে বাবার কবর জিয়ারত করতে পারেন।

পারভীন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে বলেন, তার বড় মেয়েকে যেন একটি চাকুরির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়, যাতে পরিবারের ভরণপোষণ চালানো সম্ভব হয়। তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত সব শহীদ পরিবারের পাশে দাঁড়ানো।’

মুজিবুরের পরিবার এখন ন্যায়বিচার চায়। পারভীন বলেন, ‘আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) মামলা করেছি। প্রকৃত অপরাধীদের বিচার চাই।’

শহীদ মুজিবের মেয়েরা দ্রুত বিচারের দাবি জানিয়ে বলেন, ‘আমরা এমন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই, যাতে পুলিশ আর কখনও নিরপরাধ মানুষকে হত্যার সাহস না পায়।’

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
ইলিশ সংরক্ষণে চাঁদপুরে কোস্ট গার্ডের জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম
গুণগতমান ঠিক রেখে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্প সম্পন্নের নির্দেশ সেতু সচিবের
নিম্নমানের কাগজে পাঠ্যপুস্তক মুদ্রণ করে সরকারি অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে দুদকের অভিযান
শ্রমিক জাগরণের লক্ষ্যে ঢাকায় মহাসমাবেশ সফল করতে শিমুল বিশ্বাসের আহবান
ডিএমপিতে সেপ্টেম্বর মাসে সংক্ষিপ্ত বিচারে ২৫৭টি মামলা নিষ্পত্তি
দ্বিপক্ষীয় প্রতিরক্ষা সহযোগিতা জোরদারে বাংলাদেশ ও তুরস্ক আলোচনা
শিক্ষার্থী হত্যা : সাবেক ধামরাই উপজেলা চেয়ারম্যান মোহাদ্দেছসহ পাঁচজন রিমান্ডে
লড়াই করে হারল বাংলাদেশ
ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদের সভাপতি পদে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক বিজয়ে শিক্ষা উপদেষ্টার অভিনন্দন 
গ্রিস উপকূলে নৌকাডুবিতে ৪ অভিবাসী নিহত
১০