প্রতিবেদন: আল-আমিন শাহরিয়ার
ভোলা, ১০ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : ‘গত কয়েক বছর ধরে আমি কিডনি রোগে ভুগতেছি। ছেলের আয়ের টাকায় সংসারের পাশাপাশি আমার চিকিৎসাও চলত। এখন ছেলে নাই, তাই ঠিক মতো ওষুধ কিনে খেতে পারছি না।’
কথাগুলো বলছিলেন চব্বিশের ৫ আগস্ট ছাত্র-গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ মো. সোহেল রানার মা সাফিয়া বেগম।
নিজের বুক চাপড়ে কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘আল্লায় আমার ছেলেরে নিয়া গেছে। ছোট বেলায় কোলে থাকা অবস্থায় মারা গেলে মনটারে বুঝ দিতে পারতাম। এতো কষ্ট পাইতাম না, যত কষ্ট পাইছি এই বয়সে এসে আমার বাজান মারা যাওয়ায়। অনেক কষ্ট করে ছেলেকে বড় করছি।’
২২ বছর বয়সী সোহেল রানা ভোলা জেলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার দেউলা ইউনিয়নের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের মৃত আব্দুল হকের ছেলে। ঢাকার আদাবর এলাকায় একটি থ্রি-পিস কারখানায় অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ করতেন তিনি।
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে সাফিয়া বেগম আরও বলেন, তিনি ৫ আগস্ট সকালে মেয়ে নুর জাহানের বাসায় যান। দুপুর ১২টার দিকে বাসায় ফেরেন। এ সময় ছেলে সোহেলকে এক বন্ধুর সঙ্গে রিকশায় যেতে দেখে কোথায় যাচ্ছে জিজ্ঞেস করেন। ছেলে উত্তরে বোনের বাসায় যাচ্ছে বলে জানায়।
মা সাফিয়া বেগম ছেলেকে বলেছিলেন, ‘বাবা বাইরে যাইও না। আর তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আইসো।’ এটাই ছিল ছেলে সোহেল রানার সঙ্গে তার শেষ কথা।
এর পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে এক অপরিচিত লোক ফোন করে জানায়, সোহেল গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছে। তার লাশ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আছে।
খবর পেয়ে দ্রুত সোহেলের বড় ভাই ইব্রাহিম হাসপাতালে ছুটে যান। সেখান থেকে রাতে লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে করে ভোলার উদ্দেশে রওনা হন। পরদিন ৬ আগস্ট বিকেলে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় সোহেল রানার লাশ।
ইব্রাহিম একবার কাজ করতে গিয়ে ছয় তলা থেকে পড়ে গিয়ে আঘাত পেয়েছিলেন। তাই এখন ঠিক মতো কাজ-কর্ম করতে পারেন না। ফলে অভাবের কারণে সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের।
শহীদ সোহেল রানার বড় ভাই মো. ইব্রাহিম জানান, আওয়ামী হিংস্রতার শিকার হয়ে ২০০৯ সালের দিকে পুরো পরিবার নিয়ে তারা ঢাকায় পাড়ি জমান। ঢাকার আদাবর ১০ নম্বর এলাকায় ভাড়া বাসায় বসবাস শুরু করেন তারা। বাবা আব্দুল হক রিকশা চালিয়ে তাদের মা ও তিন ভাই-এক বোনের সংসার চালাতেন।
জানা যায়, পারিবারিকভাবে তারা বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাই এক প্রকার বাধ্য হয়েই গ্রাম ছাড়তে হয় তাদের। এরপর আস্তে আস্তে তারা বড় হলে বড় ভাই ইব্রাহিম রাজমিস্ত্রীর কাজ শুরু করেন। আর মেঝ ভাই সোহেল রানা পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করে অভাবের কারণে আর পড়তে পারেননি।
এরই মধ্যে ২০১৮ সালে বাবা আব্দুল হকের ব্ল্যাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। আস্তে আস্তে তিনি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে সোহেল রানা আদাবর এলাকার একটি থ্রি-পিসের কারখানায় অ্যাম্ব্রয়ডারির কাজ নেন।
২০২০ সালে বাবা আব্দুল হক মারা যান। এরই মধ্যে সোহেল রানাকে গত দুই-আড়াই বছর আগে বিয়ে করানো হয়। সেই ঘরে তাইয়্যেবা নামে দেড় বছর বয়সী একটি কন্যা সন্তান রয়েছে তার।
সোহেল রানা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণ-অভ্ত্থুানের দিন দুপুর ১২টার দিকে বাসা থেকে বের হয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আদাবর এলাকায় আন্দোলনে যোগ দেন।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে হঠাৎ একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন করে বলা হয়, সোহেল আদাবর থানার সামনে পুলিশের গুলিতে গুরুতর আহত হয়েছে। স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। লাশ হাসপাতালে রয়েছে।
এ খবর পেয়ে তারা গিয়ে সেখান থেকে সোহেল রানার মরদেহ বুঝে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে এনে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করেন।
এ ঘটনায় বড় ভাই ইব্রাহিম বাদী হয়ে ২০ আগস্ট ঢাকার সিএমএম আদালতে ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতনামা আরও ৩০০ জনের নামে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
ইব্রাহিম তার ভাই হত্যার বিচার দাবি করেন। একই সঙ্গে ভাইয়ের রেখে যাওয়া অবুঝ সন্তান তাইয়্যেবার ভবিষ্যতের জন্য সরকারের কাছে কিছু করার জোর দাবি জানান।
ইব্রাহিম জানান, ভাই সোহেল রানার মৃত্যুর পর জেলা প্রশাসনের কাছ থেকে তাদের পরিবার সহযোগিতা পাননি এখনও। সরকারি কিম্বা কোনো ব্যক্তিগত সাহায্যও মেলেনি।