প্রতিবেদন: নুসরাত সুপ্তি
নারায়ণগঞ্জ, ১০ মার্চ, ২০২৫ (বাসস) : ‘সক্কাল সক্কাল উইঠা আমারে কয়, মা আজকা ফুচকা বেঁচতাম না। আন্দোলনে যামু। আমি কইলাম, নারে বাপ এসবে যাইছ না। আমার ঢর লাগে। সেই ঢরডারে সত্যি কইরা দিয়া ওয় চইলা গেল আমারে ছাইড়া।’
ছেলের মৃত্যুর সাত মাস পেরোলেও আহাজারি থামেনি শহীদ বিল্লালের মায়ের। ছেলের কথা মনে পড়লেই অঝোরে কাঁদেন তার মা তাসলিমা বেগম।
ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শহীদ হয়েছেন বিল্লাল (২০)। যার কাঁধে ছিল তার পুরো পরিবারের ভরণপোষণের দায়িত্ব। বিল্লাল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও থানার কলতাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন।
বিল্লালের পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, হোসেন মিয়া (৫৩) ও তাসলিমা বেগম (৪০)-এর তিন সন্তান। বিল্লাল তাদের মেঝো ছেলে। সিদ্ধিরগঞ্জের হিরাঝিল এলাকায় ফুচকার দোকান ছিল তার। ফুচকা বিক্রির অর্থে চলতো তার পরিবাবারের সাংসারিক খরচ।
চব্বিশের ৫ আগস্ট মায়ের বারণ না মেনে আন্দোলনে যোগ দেন তিনি। যাত্রাবাড়িতে আন্দোলরত অবস্থায় পুলিশের গুলিতে আহত হন বিল্লাল। মাথায় গুলি লাগে তার। রাতে আসে তার মৃত্যুর সংবাদ। তার মৃত্যুতে পরিবারে নেমে এসেছে অনিশ্চয়তার ঘন অন্ধকার। খেয়ে না খেয়ে অভাব-অনটনে কাটছে তাদের জীবন।
সোনারগাঁ উপজেলার কলতাপাড়া গ্রামের একটি টিনশেড বাড়িতে ভাড়া থাকেন বিল্লালের পরিবার। সেখানেই আলাপ হয় রাষ্ট্রীয় বার্তা সংস্থা বাসসের প্রতিবেদকের সঙ্গে।
এ সময় তাসলিমা খাতুন বলেন, ‘বিল্লালে সকালে কয় আন্দোলনে যাইব, আজকা ফুচকা বেঁচত না। আমি কইলাম, বাপ চারদিকে এত গণ্ডগোল, তুমি যাইও না। ওয় কয়, না, মা সবাই দেশের জন্য যাইতাছে। সবাইরে মাইরা ফেলতাছে। আমারে যাইতে দাও। আমিও যামু। একদিন ফুচকা না বেঁচলে কিছু হইব না।’
‘সকালে ডাইল-আলু ভর্তা করছি। এডি খাওয়ার সময় কয়, মা আজকা মুরগি রাইন্দ। মুরগি দিয়া ভাত খামু। আমার পোলারে আর মুরগি দিয়া খাওয়াইতে পারলাম না,’ আফসোস করেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমার এই ছেলেডা বাকি দুইডার মতন নাহ। ওর সবার জন্যই অনেক মায়া আছিল। সবার খেয়াল রাখত। আমার স্বামী অসুস্থ। আমার বড় ছেলে মামুন (২৬) কাজ-কাম কিছু করে না। ছোট ছেলে মানিক (১৭) বিল্লালের মরণের পর নতুন কাজে লাগছে। ছোট ভাইরে কাজ করতে দিত না বিল্লাল।
বিল্লালের মা বলেন, ‘ওয় কইছিল মা তোমারে আমি বাড়ি কইরা দিমু। ভাড়া বাসায় থাকন লাগত না। আমাগো একদিন নিজেগো বাড়ি হইব। তোমাগো আর কষ্ট করতে দিমু না। এই পোলায় আছিল আমার সব আশা-ভরসা। আল্লাহ ওই পোলাডারেই লইয়া গেলগা।’ এই বলে অঝোরে কাঁদতে থাকেন তাসলিমা বেগম।
বিল্লালের বড় ভাই মামুন বলেন, ‘আমি শনিআখড়ায় থাকতাম। ৫ আগস্ট দুপুরে খবর পাই, আমার ভাইয়ের গায়ে গুলি লাগছে। কোনো গাড়ি না পাইয়া হাঁইটা গেছি ঢাকা মেডিকেল। গিয়া দেখি ভাই আমার পইড়া আছে।’
মামুন জানান, ওর মাথায় গুলি লাগছে। রক্তে ফ্লোর ভিজতাছে। কিন্তু ওর কোন চিকিৎসা হইতাছে না। একজনের থেকে ধার কইরা ৮ হাজার টাকা নিয়া গেছিলাম পরে ডাক্তাররা ২ ব্যাগ রক্ত রেডি রাখতে বলছে। আমি ৪ জন রেডি রাখছিলাম রক্ত দিতে।
মামুন আরও বলেন, ‘আমারে যা যা ঔষধ আনতে বলছিল, সব আনছি। কিন্তু ওনারা গাফলতিতে চিকিৎসা ঠিক মতো করে নাই। পরে রাত ১ টায় আমার ভাই আমাগো ছাইড়া চইলা যায়। ওরে আমাদের গ্রামের স্থানীয় কবরস্থানে দাফন করছি।’
বিল্লালের বাবা হোসেন মিয়া বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুর পর আমরা মামলা করতে চাই নাই। কিন্তু সবাই বুঝাইল ছেলের হত্যার বিচার চাওয়া দরকার। আমার পোলার মত কত মানুষরে ওই খুনি হাসিনা খুন করল। এরপর ওয় পলাইছে।’
পোলায় মরণের পর জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে ৫ লাখ টাকা পাইছি। কিন্তু পোলার হত্যার বিচার হয় নাই। টাকা লাগবে না, পোলার হত্যার বিচার চাই আমরা।